“ বুকের মাঝে গোপন কোনো ঢেউ, মেঘমালার রুপোলি চাদর গায়ে দিয়ে অজস্র জোনাকির উষ্ণতায় অন্ধকারে পথ ভেঙ্গে চলা। চোখে একরাশ তৃষ্ণা কিংবা নিজেকেই প্রবোধ দেয়া – ঐ তো আর বেশী দূরে নয়, আরেকটু পথ পেরোলেই পেয়ে যাব অদেখা কোনো নদী, স্বর্গীয় সৌরভ আর সেই অলীক মানুষের দেখা – যে গভীর রাতে তার দু’হাতের ভাঁজে ঢেকে রাখবে আমার বুক ছেঁড়া দীর্ঘশ্বাস ! আমি যার জন্য এখনো আমার নিজেকে জ্বালিয়ে রেখেছি পিদিমের মতো ।
তাই জাগো অলীক মানুষ , জাগো ! দেখো, অনুভব করো তোমাকে ঘিরে আমার চিন্তা আর ইচ্ছের স্রোত, দেখো কী করে আমার নাভী থেকে আর্তনাদের শব্দ ছিটকে বের হয়ে আসছে তোমার অপেক্ষায় থেকে থেকে ! আশা আর নিরাশায় কী করে কাঁপছি আমি । কাঁপছি ভয়ে, আকাঙ্ক্ষায়, নিরাপত্তাহীনতায়। শুনতে পাচ্ছো কি আমার স্নায়ু ও রক্তের কথা বলে ওঠা ?
এই তো তুমি জাগছ ! হ্যাঁ প্রিয়তম , ধীরে ধীরে এভাবেই জেগে ওঠো। আমার ভবিষ্যৎ শিল্পের ভাষা তুমি। কথা বলো। দেখো আমার চোখ কীভাবে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো তোমার নীরবতায়। দেখছ আমি কত দীর্ঘ, দীর্ঘ দিন ধরে শুন্য হয়ে ছিলাম তোমাকে না পেয়ে পেয়ে ! আমি মরিয়া হয়ে উঠবার আগেই প্লিজ তুমি কথা বলো।
আমি সেই কবে থেকে তোমার অসহ্য প্রেমে পড়ে আছি অলীক মানুষ !
তোমার প্রণয়ে আমার চোখ পুড়ে পুড়ে যেতো। তাই রোজ ঘুম ভেঙেই দেখতাম একটা মেঘ আমার দু’চোখের পাতায় ছায়া দিতে বসে থাকতো !”
উপরের কথাগুলো যদিও আমার নয় । ঠিক এইরকম হচ্ছে আমাদের রুনু আপা। আমাদের মহল্লার রুনু আপা কিংবা আমাদের ব্যথিত রুনু আপা। ধূসর শহরের রুনু আপা, যার যাত্রাধ্বনি, আকুলতা কিছুই সেই অলীক মানুষটার কাছে পৌঁছাত না ।
অগাধ নিঃসঙ্গতায় মুখ গুঁজে থাকতো আমাদের রুনু আপা। কে যেন একবার দুষ্টুমির ছলে রুনু আপাকে বলেছিল জানালা খুললেই সকালের প্রথম টিয়ে পাখির ঝাঁকটা দেখতে পেলেই তোর মনের ইচ্ছে পূরণ হবে। তখন কত আর তার বয়স হবে পনের কিংবা ষোল।
কিন্তু জানালা খুলে রুনু আপা দেখেছিল শিমুলের শেষ পাতাটাও ঝরে গেছে। পাখি পাতাহীন শিমুল গাছে তাই আর বসেনি। কিন্তু বোকা রুনু আপাটার সে কী কান্না। সে তখন দৌড়ে ছাদে গিয়েছিল যদিবা আকাশে অন্তত একটা টিয়েও দেখা যায় ! কিন্তু সেদিন আকাশে ছিল হতাশাব্যঞ্জক, ভীতিকর কিছু শব্দ !
রুনু আপা সম্পর্কে বলতে গেলে আমাকে আরও আগে থেকে শুরু করতে হবে তার কথা। তার পুরো নাম যদিও আমার মনে নেই। তবে তার দাদাজান নাকি তাকে ‘ রুনঝুন ’ নামে ডাকতো। সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত হয়ে হয়ে এখন শুধু ‘ রুনু ’ নামটাই আছে। তার দাদাজানও এখন আর বেঁচে নাই তাই রুনঝুন নামটাও চাপা পড়ে গিয়েছে ।
রুনু আপা কোনো একসময়ে বোধহয় হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে ছিল , যদিও আমার তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখার সৌভাগ্য বেশীদিন হয়নি। সৌভাগ্য না বলে মনে হয় এখানে সুযোগ শব্দটাই মানানসই হবে। যখন থেকে সে তার শারীরিক সৌন্দর্য হারাতে শুরু করাটা বুঝতে পেরেছিল সম্ভবত তখন থেকেই তার স্বতঃস্ফূর্ততা মিইয়ে যাচ্ছিলো।
কীভাবে কীভাবে যেন রুনু আপা মোটা হয়ে যাচ্ছিলো। একে তো তার গায়ের রঙ শ্যামলা তার উপর এভাবে মোটা হয়ে যাবার কারণে কলেজে প্রথম বর্ষে পড়লেও তাকে মনে হতো গৃহিণীদের মতো যারা ইতিমধ্যেই দুই/তিন বাচ্চার মা হয়েছেন এবং গায়ের মজুদকৃত চর্বির কারণে সুখেই আছেন।
রুনু আপা যখন নবম কি দশম শ্রেণীতে পড়তো তখন শুনতাম তাদের বাসা থেকে অঞ্জন দত্তের খুব জনপ্রিয় এক গান বারবার বাজতো ‘ রঞ্জনা আমি আর আসবো না !’ পরে জেনেছিলাম রুনু আপাই নাকি এ গান শুনত। অঞ্জন দত্তের ‘রঞ্জনা’কে শুনতে শুনতেই সে তখন কাল্পনিক রঞ্জনার মতোই হতে চাইতো। রঞ্জনা হয়ত খুব সুন্দরী ছিল যে কারণে রঞ্জনার মেজ দাদা পাড়ার ছেলেদের ঠ্যাং খোঁড়া করে দিবে বলে হুমকি দিয়েছিল কিংবা যে কারণে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেও নিষেধ করত। তাই আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে রুনু আপা নিজেকে সেই রঞ্জনা ভাবতো বলেই সেই গান বারবার শুনত। সেও চাইতো আমাদের মহল্লার সুদর্শন ছেলেদের আড্ডার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে। হয়তবা এটাও আশা করতো তার নামেও কোনো নীল খামের চিঠি আসুক যা রাতে ঘুমোবার আগে পড়ে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখবে কিংবা বান্ধবীদের কাছে গর্ব করে বলবে তার নামেও কোনো চিঠি আসে।
তবে রুনু আপা আমাদের মহল্লায় আলোচনার একটা বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল বটে। তবে শফিক ভাই, সজল ভাইদের মতো সুদর্শন ছেলেদের আড্ডায় না। আর এটা যখন রুনু আপা বুঝতে পেরেছিল তার ছোট ভাই রেজার কাছে –
‘ ধুর, তোমারে তো সজল ভাইরা মুটকী বইলা ডাকে। তুমি তাদের কথা জানতে চাইও না তো আর !’
ঠিক তারপর থেকেই অঞ্জন দত্তের ‘ রঞ্জনা’কে রুনু আপা ঈর্ষা করতে শুরু করেছিল। শুধু রঞ্জনাই না আশেপাশের যাবতীয় সুন্দরী, তন্বী মেয়েদের প্রতিই তার একটা বুনো রাগ জন্মাচ্ছিলো। এ কারণে প্রায়ই কোনো সিনেমা বা পথেঘাটে সিনেমার পোস্টার কিংবা নাটক দেখতে বসলে দেখা যেতো সে মাঝপথ থেকেই উঠে চলে গেছে সেটা দেখা সম্পূর্ণ না করে , বিশেষত নায়িকার আগমন ঘটলেই।
রুনু আপা নিজে মোটা হবার হবার কারণে সেই সব সুন্দরী মেয়েদের কারণে তার যে নিয়ত অন্তর্দহন সেটা কাউকে মুখ ফুটে বলাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না । তাই তাদের বাসার তেমন কেউ শুরুতে তার অস্বাভাবিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল করেনি তার ছোট ভাই রেজা ছাড়া। কারণ রেজা যখন মহল্লার বখাটে বুইট্টা শাহীন গ্রুপের ছেলেদের আলোচনা বাইরে থেকে শুধু রুনু আপাই না, ঘরের জিনিসপত্রও ভাংচুরের অক্ষম চেষ্টায় ফোঁস ফোঁস করতো কিংবা তার চুল টান দিয়ে দৌড় দিত, তখন রুনু আপাও রেগে যেতো, বিগত দিনে রেজাকে কত টাকা টিফিন খেতে দিয়েছিল কিংবা কবে তার ভাগের মিষ্টিটা , শখের ডাকটিকিটের এ্যালবাম সহ পুরনো যা যা কিছু তার ভাইকে দিয়েছিল সব দাবী করতো । এভাবে দুই ভাইবোনের ঝগড়া হাতাহাতিতে পৌঁছালে একপর্যায়ে রেজাকে বলতে শোনা যেতো –
- ‘ তুমি কম খাইতে পারো না ? দিন দিন ধুমসী হইতাছ । মহল্লার মানুষ কি তোমারে নিয়া ভালো কথা বলে নাকি ?’
- কি বলে মানুষ ? রুনু আপার সে সময়ের আর্ত জিজ্ঞাসা শুনলে যে কেউ বুঝবে নিজের সম্ভাব্য অন্ধকার দিনগুলোর আগমনে যেন ডানাভাঙা পাখির মতো তলিয়ে যেতে যেতে বেঁচে থাকার আশায় খড়কুটো আঁকড়ে ধরে রাখা এক অসহায় মানুষ ।
- কি বলে সেইগুলি শুইন্যা তুমি কি করবা আজাইরা
রুনু আপা বেদনার্ত হয়। রেজা তার ঘর থেকে বের হবার আগে বিছানায় পাতা চাদরটাও উল্টে দিয়ে যায়; হয়তবা তার বোনের জন্য রাগে, কষ্টে কিংবা অভিমানে। রেজা কি আর বলতে পারে বদমাইশ শাহীন , জনি, সাগররা সেদিন বলছিল –
“ রেজার বইনটারে দেখছস ? শালীর শইল ভরা মাংস। ধইরা মজা পাওন যাইব ! আর দেখ অর ….”
উফ রেজা আর ভাবতেও পারে না ।
আসলে নিজের বেঢপ স্বাস্থ্য নিয়ে রুনু আপার কান্না, রেজার কষ্ট পাওয়া ,এভাবে পথেঘাটে অপমানিত হওয়া কিছুই যেন তার বেয়ারা স্বাস্থ্যের গতিকে দমিয়ে রাখতে পারে না। খাবার টেবিলে ক্রমাগত তার অনুপস্থিতি তার মাকে ভাবিয়ে তুললে তার মায়ের চোখেও মনে হতে থাকে একপর্যায়ে –
- আসলেই তো তোর শরীরটা কেমন ভারী হইয়া গেছে । এত বেলা কইরা বিছানা ছাড়লে তো এমন হইবই বলতে গিয়ে তার মা তাকে পরামর্শ দিতে ভোলেন না তার সমবয়সী পলি, গলির মুখের বাসার আফরোজা আর তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী রেবেকাদের অনুসরণ করতে। যাদের প্রত্যেকেরই বেশ কয়েকটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ইতিমধ্যে এবং বিয়ের বাজারে তারা নিজেদের মূল্যবান প্রমাণ করে দেখাতে সমর্থও হয়েছে তাদের একহারা গড়নের জন্য ।
একটা ভালো বিয়া না হইলে কি মাইয়া মানুষের এই জীবনের দাম আছে ? শরীর-স্বাস্থ্য দেখনের মতো না হইলে কি আর ঘরের ব্যাটা মানুষ ধইরা রাখন যাইব ? – এ কথা বলতেও তার মা দ্বিধা করেন না ।
এ কথা যদি শুধুমাত্র রুনু আপার মা একাই বলতো তাহলেও না হয় কথা ছিল । কিন্তু কে না শোনায় তাকে এ নিয়ে কথা !
অবশ্য রুনু আপার এসব একান্ত কষ্টের কথাগুলো আমি জেনেছি তার মুখেই তবে আরও পরে। যখন সে তার বেয়ারা স্বাস্থ্যের লাগাম টেনে ধরতে দিনরাতের বেশীরভাগ সময়টায় ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করতো খাবার দাবার নিয়ন্ত্রণ এবং শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে। রুনু আপা বরাবরই মেধাবী ছাত্রী ছিল। সে অনার্সে পড়ার শুরু থেকেই টিউশনি করতো।
সে আমাকে সপ্তাহে চারদিন পড়ালেও শুক্রবারে শুধু দুপুরে আসতো তিনটার একটু আগে । আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম গ্রীষ্মের তীব্র রোদের মাঝে ছাতা মাথায় ধীর পায়ে তার এগিয়ে আসা। ঘরে ঢুকে প্রায় মিনিট দশেক ফ্যানের নীচে বসে একটু ঠাণ্ডা হয়ে তবেই শুরু হতো তার কাছে আমার পড়াশুনা । তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র।
মাঝে মাঝে রুনু আপা হঠাৎ করেই একটা , দুইটা সাবজেক্ট পড়িয়ে বলতো আজ আর পড়াবে না কিংবা ভূ-গোল পড়াবার মাঝপথেই পড়া বন্ধ করে দিয়ে বলতো –
- আজ আর পড়তে হবে না । আয় গল্প করি!
আর এটাই রুনু আপার কাছে আমার প্রাইভেট পড়ার সবচেয়ে বড় আগ্রহের কারণ ছিল। শুধু তাই নয় তার অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরাও তাকে এই কারণে খুব পছন্দ করতো । অবশ্য পড়তে হবে না এ কথা শুনে আমার জিজ্ঞাসু চোখ দেখে সে বলতো –
- আরে টেনশন করিস না । তোর মা বকবে না । রোজ রোজ কি পড়তে হয় নাকি ? এটা জানিস তো ঘণ্টার পড় ঘণ্টা ধরে পড়াশুনা করলে ছেলেমেয়েরা গাধা হয়ে যায়। ব্রেইনেরও রিফ্রেশমেন্ট দরকার আছে বুঝলি ?
কোনো শিক্ষক যে এভাবে পড়ায়, বলতে পারে ভাবতেই অবাক হতাম আমি ! কিন্তু স্কুলের গোঁসাই স্যার বিজ্ঞানের প্রশ্নের উত্তর না পারলে কিংবা ফখরুল স্যার বোর্ডে অংক করতে দিলে না পারলে প্রায়ই বলে –
- তোর বাপটাতো ভালো মানুষই। তুই এমন অমানুষ হইছিস কেমনে ? বাসায় কি বাপ- মা পড়াশুনার খোঁজ খবর রাখে না ?
তখন রুনু আপার কথাগুলো তাদের শোনাতে ইচ্ছা করলেও চুপ করে মাথা নিচু করে রাখা ছাড়া কিছু করার থাকে না । স্কুলের স্যারদের চেয়ে সে হিসেবে রুনু আপাতো অতুলনীয়। হয়তবা এ কারণেই তার প্রতি আমি মমতা অনুভব করতে থাকি। তীব্র গরমে ঘামে ভিজে যাওয়া তাকে এক গ্লাস শরবত খাওয়াতে আমি আমার মা’কে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলি ।
একবার রুনু আপা আমার কাছে জানতে চেয়েছিল –
- কি রে কমল , তুই প্রেম – ট্রেম করিস না ? কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিস না ?
উফ কি ভীষণ লজ্জার কথা । এ কথা যদি আমার চাচাতো ভাই আরিফ কিংবা বন্ধু সজীব, মামুন, বাবু ওরা জিজ্ঞেস করতো মনে হয় আমার কাছে ঘুসি খেতো , নাকই ভেঙে দিতাম ওদের। আমি তো কোনো মেয়ের দিকেই তাকাই না তারউপর প্রেম তো অনেক পরের ব্যাপার ! কিন্তু এ কথা শুনে রুনু আপাকে ঘুসি মারতে ইচ্ছে করেনি , তার নাক ভাঙতেও ইচ্ছে হয়নি। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছিল। বললাম –
- ধ্যাত কি যে বলো না তুমি ! আমি মেয়েদের সাথে তো কথাই বলি না
- ঠিক আছে বুঝলাম । কিন্তু প্রতিটা মানুষেরই তার নিজের বলে কাছের কেউ একজন থাকতে হয় যাতে সময়ে অসময়ে একা একা না লাগে । তাই সময় থাকতেই একটা প্রেম করে ফেল। আমাকে দেখে বুঝিস না ! বলে রুনু আপা কেমন উদাস হয়ে যায় ।
- তুমি কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলো খালি । প্রেম করা ভালো না । বলে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকি। রুনু আপার দিকে কেন যেন লজ্জায় আমি তাকাতেই পারছিলাম না তখন ।
সেদিন এসব বলে রুনু আপা হাসতে হাসতে চলে যায়। পরে বুঝেছিলাম এটা নিয়ে তার আক্ষেপ ছিলো বলেই সে কান্নাকে হাসিতে রুপান্তরিত করে নিয়েছিলো।
আরেকদিন সে আমার হাতে একটা চিঠির খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল –
- এটা পোস্ট করে দিস তো ! দেখিস আবার কেউ যেন না দেখে !
খামের উপরে দেখি তার নিজের নাম আর তাদের বাড়ির ঠিকানা লেখা। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই বললো
- আমি তো আর নাটক-সিনেমার নায়িকাদের মতো এত সুন্দরী না , তন্বীও না , তাই আমার নামে কোনো প্রেম পত্রও আসে না । তাই নিজেই নিজেকে পাঠাই। তোর পোস্ট করে দিতে আপত্তি থাকলে দে আমারটা আমিই করে নিবো বলে রুনু আপা আমার কাছ থেকে চিঠিটা ফেরত নেবার জন্য আবার হাত বাড়ায় মন খারাপ করে ।
তার আক্ষেপে কতটা যন্ত্রণা মিশে ছিল সেটা ঐ কৈশোরে আমি তার মতো করে ততটা অনুভব করতে না পারলেও বিশালদেহী শ্যামলারঙা রুনু আপার জন্য সে মুহূর্তে ভীষণ মায়া হচ্ছিলো। আসলে সে ছিল নিঃসঙ্গ এক মেয়ে ! তাই তার জন্যও আমার একটু একটু মন খারাপ হতে থাকে।
কে বলে সে সুন্দরী না ? এই যে তার কি সুন্দর দুটো চোখ , দেখলেই মনে হয় কাজল টানা । এরকম চোখকেই কি কাজলকালো চোখ বলে ? একরাশ চুল কত মসৃণ ভাবেই না তার পিঠ বেয়ে নেমে গেছে। তার চোখের স্বচ্ছ মনি দিয়ে হয়ত বানানো সম্ভব গলায় পড়ার কোনো স্যুররিয়াল মালা !
আমি সান্ত্বনা দেয়ার জন্য হলেও কি এসব কথা আর তাকে বলতে পারি ? যদি ভাবে আমিই তার প্রেমে পড়ে গেছি ?
আমার সেই বয়সের অগাধ কৌতূহল থেকে ভীষণ ইচ্ছে হতো খুলে দেখি সেই খামের মাঝে কোন সোনালি-মায়ার চিঠি লেখা হয়েছে যা নিজেই নিজেকে রুনু আপা লিখে পাঠায়। কেন যে তার একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসছে না কিংবা নিদেনপক্ষে একটা প্রেম !
ক্রমাগত রুনু আপার নিজের লেখা চিঠি তার বাসার ঠিকানায় পোস্ট করতে করতে একদিন সেই রহস্যের দ্বার আমি খুলে ফেলি জানতে তার অন্তর্গত দহন, সেই অচেনা অলীক মানুষের জন্য তার আক্ষেপ , অপেক্ষা, তাদের সংসারের খুঁটিনাটি সব খুনসুটির কথা !
“ আমার বহমান আত্মায়, অস্থি-মজ্জায় জেগে ওঠা তুমি বেদনাময় এক ইন্দ্রজাল, বিবিধ বৃক্ষের পাতার ফাঁকে জোছনা রঙ। আমার চুড়ি হয়ে যাওয়া কৈশোর আর যৌবনের ব্যক্তিগত ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস , কখনোবা জটিল সঙ্গীত।
তুমি কবে আসবে অলীক পুরুষ ! আমি মানুষের ক্রমাগত বাঁকা কথা শুনতে শুনতে সত্যিই খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি এখন। আর পারি না ! তোমার আহ্বায়িত স্বপ্নের সমাপ্তি কোথায় বলতেই হবে আমাকে।
যে শহরে তুমি নেই , আমিও আর সে শহরে থাকব না। শুধু একবার বলো তুমি আসছ তো আমার কাছে ? আজ তোমার একটি বাক্যেই নিষ্পন্ন হবে আমার সমস্ত সিদ্ধান্তহীনতা। ঠিক দু'সপ্তাহের মাঝে আমাকে তুমি না নিতে আসলে আমি সত্যিই এবার হারিয়ে যাব। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে ধুয়ে অরণ্যের মাঝেই মিশে যাব শেষাবধি।
আমার দু'চোখের নীল আজ ধারণ করব ভিক্ষার জল
যাবার পথটা যে আমাকেই খুঁজে নিতে হবে !
এখন যে আমার স্পষ্টতই আড়াল, বনবাস ।
-- তোমার বনজ্যোৎস্না ”
রুনু আপার অলীক মানুষের জন্য অপেক্ষা যে কতটা অলীক ছিল তা যদি তাকে বোঝানো যেতো ! সমাজ সংসারে থেকেও একটা মানুষ সবার কাছে শুধুমাত্র শারীরিক সৌন্দর্য হারিয়ে অন্যান্য গুণাবলী থাকার পরেও কি করে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতে পারে বন্ধুবান্ধবহীন হয়ে তার উদাহরণ হচ্ছে সে। দিনের পর দিন তার স্বপ্নগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছিল। মানুষ যেমন মারা যাবার আগের মুহূর্তেও ভাবে বেঁচে থাকার উপায়টা খুঁজে বের করতে তেমনি রুনু আপাও সেই অলীক মানুষকে ঘিরে তার মাঝে তৈরি করেছিল একটা নিজস্ব জগত যা ছিল তার বেঁচে থাকার একটা প্রেরণা । সে নিজেই জানত ঐ চিঠির কোনও উত্তর আসবে না কখনো অথচ নিজেই অপেক্ষা করতো অলৌকিক ভাবে হয়ত কেউ আসবে তার সেই চিঠি পেয়ে কিংবা কেউ তাকেও লিখবে ! বিয়ের বয়স তার পার হয়ে যাচ্ছিলো আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছিল তার পরিশ্রমের বোঝা ।
আমার মাথায় দিনরাত ঘুরতে থাকে রুনু আপার লেখা চিঠিটার কথা যেখানে লেখা ছিল তার অলীক পুরুষটাকে মাত্র দু’সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়েছে তাকে এসে নিয়ে যাবার জন্য। মনের মাঝে একটা চোরা অস্বস্তি ফুটে থাকে আমার মাঝে বৃষ্টির পানিতে না আবার সে অরণ্যের মাঝে হারিয়ে যায় ! ভয়ে ভয়ে থাকি কখন না আবার আকাশেরও কান্না শুরু হয়ে যায় আর বোকা রুনু আপাটাকে হারিয়ে ফেলি !
এক নিদারুন ভয়ে বা কিসের নেশায় আমি আমার বর্তমান ভুলে যেতে চাই। গল্পের মতো বলে যাওয়া কথোপকথনে আমারও ইচ্ছে করে লিপিবদ্ধ করে রাখি মুহূর্তের চৌকাঠে তার জন্য কিছু আশ্বাসবাণী। আরও ইচ্ছে করে রুনু আপার ঘুমন্ত ঠোঁটের ঠিক কাছাকাছি এসে স্বপ্ন হয়ে ঝুলে থাকি কিংবা তার ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিয়ে অলীক পুরুষ হয়ে তার দৃষ্টির মুগ্ধতা উপভোগ করি । তাকেও লিখতে ইচ্ছে করে –
“ হাওয়ায় যে পাতাটি উড়ে চলেছে তার চাওয়ার সীমানাটা কতটা সীমাহীন কখনো কি জানতে পারবে তুমি ? আমাদের ইচ্ছেগুলো যেমন অনিচ্ছার জালে আটকে পড়ে রোজ রোজ মার খাচ্ছে - অনেকটা সে রকম। তুমি উড়তে জানো না বলেই জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকো মাথাটা ঠেকিয়ে, নিষ্পলক চোখে ! কখনো বা কাঁদো। দূর থেকে দাঁড়িয়ে আমি দেখি তোমার কান্না, সংশয়। আমি চেঁচিয়ে তোমায় বলতে পারি না - আর কেঁদো না, মমতায় তোমার চোখের কোল মুছিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু পৃথিবীর আলো-বাতাসের মতোই মিশে আছি তোমাতে। তুমি হয়ত টের পাচ্ছ না। জানো না বুঝি , একেবারে কাছের মানুষটি কাছে না থাকলেও বুকে কখনো শূন্যতাকে বসতে দিতে নেই। বরং সম্পর্ক কখনো ফুরোবার নয় জেনেই সম্পর্কের গাঢ়ত্বকে ছুঁইয়ে রাখতে হয় সেই মানুষটির অনুপস্থিতেও !
তোমার কান্না ভেজা চোখের পাশে যে ক্ষীণ অভিমান মিশে আছে, মুছে ফেলো। মনে রেখো দূরত্বই কোনো সম্পর্কের শেষ পরিমাপ নয়।
আকাশ জুড়ে মেঘ করলে তুমি উদাস হও। বৃষ্টি ঝরলে তুমিও শ্রাবণের আকাশ হয়ে যাও। অথচ ইচ্ছে করলেই আমি বলতে পারি - ও বৃষ্টি তুমি আজ থেমো না। ঝরে যাও সারাদিন, অহোরাত্র। পথ হারানো হরিণীর চোখ যেভাবে কেঁপে কেঁপে ওঠে, ঠিক ওরকম করে তুমিও কেঁপে ওঠো। এদিক সেদিক তাকিয়ে আমাকেই খোঁজো শুধু। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠো।
আমি বৃষ্টিকে আরও বলতে পারতাম , বৃষ্টি তুমি অবিরাম ঝরো। আজ যেন কেউ বৈষয়িক কাজে ব্যস্ত হতে বাইরে বের না হয়। খিল এঁটে রাখুক শক্ত করে তাদের দরোজায়। আজ শুধু আমাদের মুখোমুখি হবার দিন। উন্মাদ পিয়ানোর মতো তোমার আজ বেজে উঠবার দিন।
কিন্তু এ সমস্ত কথার কিছুই তোমাকে বলা হয়নি আজও যা তোমার নিত্য কষ্ট পাওয়া দেখে সাজিয়ে তুলেছিলাম আমার মাঝে তোমার কষ্ট লাঘব করতে। আমি এখনো বুঝতে পারি না আমায় তুমি কতটা খুঁজে ফেরো !
আমার যত ব্যঞ্জনা-ধ্বনি , ফিসফাস তা মূলত তোমাকে ছুঁয়ে দেবার জন্যই ছিল, এখনো তাই আছে।
তাই বলব , ভালোবাসায় বাঁচো, শুদ্ধতায় বেঁচে থাকো।
হারিয়ে যেও না বনজ্যোৎস্না !!! ”
নিজেকে খুব ব্যর্থ মনে হতে থাকে আমার, বড্ড অপরাগতার ভারে নুয়ে থাকি আমি ! একটা মুমূর্ষু মানবীকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয় খুব। বিগত তিন/চার দিন ধরেই এই চিঠিটা লিখে পকেটে নিয়ে ঘুরছি। কতদিন লালরঙের এই চেনা ডাকবাক্সে রুনু আপার চিঠি পোস্ট করে দিয়েছি। কিন্তু আজ কেমন ভয় ভয় লাগছে আমার ! মনে হচ্ছে ভয়ংকর কোনো হিংস্র জন্তু হাঁ করে বসে আছে একটা সতেজ স্বপ্নকে গিলে নেবার আশায় ।
আমি জানি অলীক মানুষের চিঠিটা হাতে পেলে রুনু আপা আনন্দে হয়ত কেঁদেই দেবেন কিংবা শুনতে পাচ্ছিলাম যেন তার উচ্ছ্বসিত জিজ্ঞাসা –
- এতদিন কোথায় ছিলে তুমি ?
আমার বোবা চোখজোড়া থেকে একটা স্বপ্ন গড়িয়ে যেতে চায় দূরে … … …
কর্ণযুগল উন্মুখ হয়ে থাকে শুনতে –
এতদিন কোথায় ছিলে তুমি !
এতদিন কোথায় ছিলে তুমি !
তাই তো এতদিন কোথায় ছিলাম আমি বনজ্যোৎস্না ?
সমাপ্ত