" প্রত্যেকটা মানুষের ভেতরেই একটা খুনি বাস করে ! "
বিছানায় শুয়ে এ কথাটা বলতেই আমার এই ধারণাকে শম্পা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালো মত রগড়ে ধীরে ধীরে যাতে ময়লাটা কেটে যায় এই আশায় সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমাবার অভিপ্রায়ে জানায় – এবার ঘুমাও তো !
হয়ত পাশ ফিরতে ফিরতে শম্পা আরও অনেক কিছুই বিড়বিড় করে বলে যা অস্পষ্টতার ধুম্রজালের ভেতর থেকে প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ে । শম্পার মুখ থেকে টুকরো টুকরো হয়ে বের হওয়া কিছু শব্দকে জোড়া দিলে হয়ত শুনতে পেতাম – প্রায়ই একই কথা বলো । পাগলের গুষ্ঠি কোথাকার !
আমার মাঝে 'পাগল' শব্দটা সাময়িক স্মৃতি হীনতা এনে দেয়। ওর এই কথাটা বলার আগ পর্যন্ত আমার মাঝে সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। শম্পা বিছানায় আমার পাশে এসে শোবার আগে আমার মাঝে একটা ফুরফুরে ভাব বুকের উঁচু নিচু পাঁজরে সমান্তরাল ভাবে বুঝিবা খেলেও যাচ্ছিলো ।
আমি চিন্তা করতে চাই বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে কী করে কিংবা ঠিক কী কী কারণে একজন স্বামী তার স্ত্রীর কাছে পাগল বলে গণ্য হতে পারে । যদিও চিন্তার জন্য আমার রাতকেই বেছে নিতে হবে এমন না। কারণ অনেকেই আছে যারা কোলাহলের মাঝে কোনো চিন্তার মাঝে ডুব দিতে পারে না । যেহেতু শম্পা ঠিক বিছানাতে শুয়েই আমাকে পাগল বললো সেহেতু আমি এখন এটা নিয়ে ভাবার জন্য খুব সুন্দর একটা সুযোগ পেলাম। আমার চিন্তা-ভাবনার জন্য দিন বা রাত বলে বিশেষ কোনো সময় নেই বরং অনেকের ভিড়ে মিশে থেকেই ভাববার মজা আলাদা , তাই আমি চাইলেই এখন ভাবনার সাগরে ডুব দিতে পারি অনায়াসেই।
এই যে শম্পা আমার পাশে শুয়ে আছে যদিও আমার দিক থেকে বিপরীতে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে বলে আমি দেখতে পারছি না ওর চেহারাটা কিন্তু শম্পার ঘুমের সময় মুখ অল্প একটু খোলা থাকে, যা আমি শম্পাকে কখনো বলি নি । এমনকি এটা বলেও ওকে আমি আঘাত করি নি কিছু কিছু মানসিক প্রতিবন্ধী আছে যারা ঘুমের সময় হাঁ করে মুখ খুলে ঘুমায়, বালিশ নষ্ট করে মুখের লালায় যারা কিনা তোমার ভাষায় “ পাগল ”! আমি পারতাম বলতে এরকম আরও অনেক কিছুই কিন্তু মেয়েদের একটা চিরাচরিত স্বভাব আছে যুক্তিতে হেরে গিয়ে হয় কেঁদে দিবে না হয় বলে বসবে “ এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না কিংবা প্লিজ লিভ দিস টপিক ” এবং নাক ঘষে ফ্যাত ফ্যাত করে নাক টানার শব্দ চলতেই থাকবে যাকে বলা হয় নাকি কান্না !
তবে শম্পা আমাকে পাগল বলায় আমি যে আঘাতপ্রাপ্ত হই বা হয়েছি কখনও এটা ঠিক নয়। আমি মজা পাই যদিও মুখে থাকে চরম উদাসীনতা ! শম্পার সাথে রাত্রিকালীন বা সময়ে অসময়ে বিশেষ আবেগ ঘন মুহূর্ত ছাড়া আমি শুরু থেকে একই রকম আছি অর্থাৎ আমার চলাফেরা, কথার স্টাইল, চিন্তার ধারা, চাহনি ইত্যাদি। শম্পার পরিবর্তন এসেছে। বরং এটাই বলা যায় আমি আসলে দেখতে চাচ্ছিলাম ওর পরিবর্তন কতটা সময় পর আসে, কীভাবে আসে ! শম্পা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ! বোকা মেয়ে একটা ! প্রথম দিকে আমার বলা কথায় ও বড় বড় চোখ করে শুধু তাকিয়ে থাকত। না , ওর চোখ আসলে বড় বড় না। ছোটই, চোখের দু’ প্রান্তে কাজল টেনে সে বড় বানিয়ে রাখতো। নিজের বেশভূষা, রূপ সচেতনতা তার যথেষ্টই ছিল; এখন আরও বেড়েছে সময়ের সাথে। নিজেকে পলিস করেছে। হয়ত নির্লিপ্ত , নিরাসক্ত থাকা স্বামীকে বাজিয়ে দেখার প্রয়াস ; নিজের রূপ-লাবণ্য , কামনা-মদিরতায় গলতে গলতে।
বোকা মেয়েটা জানত না , সব পুরুষমানুষ মাত্রই নারীর ছলা-কলায় সবসময় ভুলবার নয় । বিশেষ করে ওর ভাষায় যারা আমার মতো “ পাগল ।” আসলেই কি আমি পাগল নাকি আমার কাছের মানুষগুলোর এই বিশেষণ আমার মাথার কোন এক জায়গায় ঘাপটি মেরে থেকে ক্ষণে ক্ষণে আমাকে জিজ্ঞেস করে বোঝাপড়া করে নিতে ভেতর থেকে কিছু পাগলামির বীজের জন্ম দিয়েছিলো কিনা কে জানে !
এই যে আমি কোনোরকম নড়াচড়া না করে ঠায় একই ভঙ্গীতে শুয়ে থাকতে পারি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার তাতে কোনো সমস্যা না হলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম শম্পা মুখে কিছু না বললেও খুব অস্বস্তিতে থাকতো ব্যাপারটা নিয়ে। বিয়ের পর প্রথমদিকে আমার গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে সে পরখ করেও দেখত আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি কিনা এই ভেবে। কিন্তু ও যতদিনই আমার গায়ে হাত দিয়ে পরখ করতে চেয়েছে আমি মারা গিয়েছি কিনা বা আসলেও ঘুমাচ্ছি কিনা আমি ঠিক সাথে সাথে ওকে জিজ্ঞেস করেছি কিছু বলবে ? ও উত্তর না দিয়ে শুধু ছুঁয়ে থাকতো আমার হাতের বা কাঁধের একটা অংশ। কিন্তু এখন আর সেখানে ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার নেই। অবশ্য আগেও সেই ছুঁয়ে থাকার মাঝে আমি কোন নির্ভরতা পেতাম না। বরং অনুভব করতাম শম্পার মাঝেই কোনো ভয় কাজ করছে আর সেটা আমাকে ঘিরেই। কারণ আমার ঘুমের মাঝে ও আমার গায়ে হাত রেখে যখন টের পেত আমি সজাগ আর সেটা যত রাতই হোক, ও কেমন কেঁপে উঠত। কারো সুস্থতা নিয়ে মনের মাঝে সারাক্ষণ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চলতে থাকলে শম্পার মতো কেঁপে ওঠার রোগ যে কারোই হতে পারে বলে আমার ধারণা।
এই মাঝরাতে আমার মাঝে পাগল শব্দটা ক্রমেই তার শাখা –প্রশাখা বিস্তার করতে লাগলে একপর্যায়ে অনেকটা ঘোরের মাঝে চলে যাই। যেখানে দেখতে পাই ঠিক দেখতে না মানে শুনতে পাই সেই সময়ে একগাদা মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচির মাঝে কেমন রিনরিনে স্বরে কান্না করতে করতে একটি মেয়ে আমার পিছু পিছু গাড়িতে উঠে বসেছে, তাও আমার পাশেই। হুম এই রিনরিনে স্বরে কান্না করা মেয়েটা আমার বৌ – শম্পা। বাসায় ফিরে সমস্ত কোলাহল আর আনুষ্ঠানিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে যখন ফুল দিয়ে সজ্জিত ঘরটায় ঢুকলাম তখনও শম্পার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। সাজসজ্জা নষ্ট হবার ভয়ে আজকাল মেয়েরা খুব একটা কাঁদে না বলে যে ধারণা ছিল আমার তা কিছুটা কি বদলে গিয়েছিল ওর কান্না দেখে ! তবে ঘরে ঢোকার পর থেকে ওর কান্নার আওয়াজ ইতিমধ্যে ক্ষীণতর হয়েছিল ।
আমি খুব মন দিয়েই শম্পার কান্না-পরবর্তী চেহারাটা দেখছিলাম আমার ইজিচেয়ারটায় বসে। দেয়াল জুড়ে আমার বিশাল বুকশেলফের দিকে নজর পড়তেই ও জানতে চায় –
- সব বই পড়া শেষ হয়েছে ?
- হুম, শেষ হয়েছে।
- মনে থাকে সব বইয়ের কাহিনীই ?
আমি উত্তর না দিয়ে অপেক্ষা করি ও আরও কিছু বলে কি না।
- আমিতো এক বই পড়লে আরেক বইয়ের কাহিনীই ভুলে যাই – কিছুটা হাসতে হাসতে বলে ও। সাথে যোগ করে অনেক বই পড়লে কেউ কেউ নাকি লেখক বা কবিও হয়ে যায় ?
আমাকে এবারও চুপ থাকতে দেখে শম্পা কিছুক্ষণ আগের চপলতা একপাশে সরিয়ে রেখে কিছুটা গাম্ভির্জ চেহারায় আনার চেষ্টা করে জানায় ওর খাপছাড়া কথায় আমি যেন কিছু মনে না করি।
আহা শম্পা ! কেন কিছু মনে করব আমি ! খাপছাড়া কথাই তো আমার প্রিয়। আমি তো অনর্গল বলি নিজেই নিজের সাথে। যদিও আমার মনে মনে বলা এই কথাটা শম্পার শুনতে পাবার কথা না। তবে শম্পার কথায় মজা পেয়েছি এমন ভঙ্গী করে চোখ বন্ধ করে ইজিচেয়ারে এবার পুরোপুরি গা এলিয়ে দেই। হয়ত থেমে থেমে পা-ও নাচাতে থাকি । চোখ বন্ধ রেখেই ওকে জানাই –
- আমিতো লিখিও।
সাথে সাথেই ওর ঈশ বলার শব্দে চোখ খুলে আমি ওর দিকে তাকাই। ওর চোখে আমার লেখনী প্রতিভা নিয়ে অবিশ্বাসী ছায়া দেখলে জানাই ও চাইলে প্রমাণও দিতে পারব। শম্পা মাথা নাড়িয়ে জানায় আমাকে প্রমাণ দিতে। আমি নিজের ভেতর চাপা উত্তেজনা অনুভব করতেই কাগজ বের করি কিছু লিখে ওকে দেখাব বলে। যদিও আমি কখনো লিখি নি আগে। অচেনা একটা মেয়ের কাছে নিজের বাহাদুরির প্রমাণ দিতে সিডিউশিং টাইপ কিছু লেখার ইচ্ছে না থাকলেও দেখলাম লিখে ফেলেছি সেরকম কিছুই –
“সে আমার সাথে মেশে। দিনরাত বহমান দিগভ্রান্তির কাজল যেন। কান, চুল, নখ বেয়ে বেয়ে নামে সে। আমার প্রেমে পড়ে আমূল। ভালো লাগে নারদ-পাখি, বলে গাঢ় নৌ-নীল জানালার পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে সে আমাকে কাছে টেনে নেয়। চুমু খায় সশব্দে। বলে, চুমু খেতে হয় শব্দ করে। এভাবে …. এভাবে … বলে সে আরও চুমুতে তার নিঃশ্বাস আটকে রাখে আমার বাদামী ভাঁজে। যেন এখানেই তার আসার কথা ছিল। গাঢ় সঙ্গম আকাঙ্ক্ষার জ্যোৎস্না ক্লেদে স্নাত হয় রোদ-পাখি।
তারপর …..
তারপর সে চলে যায় আবার রাতে আসবে বলে। অন্ধকার বনে ফের অপেক্ষার গান, মরণ মুখী রাখালিয়া বাঁশির টান।
তার উন্মত্ত মুগ্ধ শ্বাস, অস্থির আঙুলের আঁচ – সব শঙ্খ-লাগা ঘোর। মিশে যায় বিরহের খোঁয়ারিতে। তার নিষাদ-চুম্বন বোঝে আমাকে জাগিয়ে তোলার মন্ত্র। জারুল চোখের শ্রাবণে – প্লাবনে। ”
আমার লেখা শেষ হবার অপেক্ষায় থেকে থেকে ওর মাঝে ঝিমুনি দেখা গেলেও আমার লেখা পড়তে পড়তে আমি দেখি তার ভেতরের জেগে ওঠা। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যেভাবেই হোক না কেন আমার ভাবতে ভালো লাগছিল , কোনো কিছু গলে যাচ্ছে। পর মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল ধারালো কোনো ফলা চিরে ফেলছে বুকের খঞ্জনী। ক্রমে ক্রমে কোথাও লিপিবদ্ধ হতে থাকে দুমড়ে মুচড়ে থাকা আকাঙ্ক্ষা কোনো নৈঃশব্দ্যের পাতায়।
আমাদের মধ্যরাতের সমুদ্র-বিছানায় একটা সময় ভোরের আলো ফোটে।
পরদিন সকালে শম্পা আমাকে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দেখে জানতে চায় ঘুম কেমন হলো, কখন উঠলাম !
আমি ঘুমালেই এ প্রশ্ন উঠতে পারতো যে আমার ঘুম কখন ভাঙল। শম্পাকে এ কথা বলার প্রয়োজন মনে করি না। চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে ওকে বলি , আচ্ছা তোমার কি মনে হয় না, আমাদের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপ ? এ পাপের জায়গা কোথায় জানো ? কিংবা বলতে পারবে এর উৎপত্তি কোথা থেকে হলো ?
আমি ওকে প্রশ্ন করে চলি ঠিকই কিন্তু ওর উত্তর শোনার জন্য আমি মোটেও উদগ্রীব ছিলাম না।
আসলে পাপ থাকে আমাদের মনে আর মস্তিষ্ক তা সংরক্ষণ করে রাখে – বলতে থাকি আমি। একটা শোধনাগার মানে পাপমোচনের হাসপাতাল হলে ভালো হতো। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মেশিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছেড়ে দিয়ে শুদ্ধ করার প্রক্রিয়া নিয়ে আমি জানাতে থাকি শম্পাকে এবং এও বলি আমার একটা সুচিন্তিত পুর্ণাঙ্গ রিপোর্টও আছে যা তৈরি করতে আমার সময় লেগেছে প্রায় দু’বছর।
এসব শুনে শম্পার অভিব্যক্তিতে মনে হলো এতক্ষণ ও আমার কোনো কথাই শোনে নি । বরং জানালো ও শাওয়ার নিতে যাবে । তবে যাওয়ার সময় আমাকে ঘিরে ওর চেহারার উদ্বেগ ও লুকোতে পারে না। অনেকদিন পর আমি আমার পাপ বিষয়ক চিন্তাভাবনার ফসল নতুন একজনকে জানাতে পেরে একটু হালকা বোধ করছিলাম।
শম্পার চলাফেরা, বিভিন্ন কাজের মাঝে আমি ওর চোরা চাহনি খেয়াল করতে থাকি । হঠাৎ হঠাৎ ওর চোখে চোখ পড়লে অস্বস্তিতে ওর চোখ সরিয়ে নেয়া কিংবা ওর এভাবে গোপনে গোপনে আমাকে ফলো করে ধরা পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা এড়াতে ওর বলে ওঠা , দেখো তো আজ ফালুদা বানিয়েছি, খেয়ে বলো কেমন হয়েছে – বলে দ্রুত হাতে ফালুদার উপরে স্ট্র-বেরি, বাদাম আর রুহআফজা মেশাতে মেশাতে আমার দিকে ফালুদার বাটি এগিয়ে দেয়া - এসবের কিছুই আমার চোখ এড়ায় না। আমি ওর বানানো ফালুদার সবটুকুই খুব যত্ন নিয়ে খাই, ওর প্রত্যাশিত প্রশংসা করার মতো বাক্য হাতড়ে বেড়াই। আর দিন দিন আমাকে ঘিরে ওর অস্বস্তি বাড়তেই থাকে।
একদিন দুপুরে ও খেতে বসে টুকটাক কথা বলতে বলতে জানায় ওর একটা বুটিক শপ করার স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নের কথা বলতে বলতে ওর দু’চোখ আমি প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে দেখি এবং ‘ এ স্বপ্ন বোধহয় কখনই পূরণ হবার নয় ’- এই শেষ বাক্যটি বলার মধ্যেই ওর প্রাণবন্ত চোখ দুটির মৃত্যুও হতে দেখি অল্প সময়ের ব্যবধানে।
ওকে বলি –
স্বপ্ন দেখাটা যদিও খুব আহামরি ব্যাপার না। চাইলে যে কেউই দেখতে পারে। শম্পার বুটিক শপের স্বপ্নটা কোন পর্যায়ের ছিল আমি জানতে চাই।
কোন পর্যায়ের আবার হবে ! আশ্চর্য তো ! স্বপ্ন তো স্বপ্নই !
ওকে ব্যাখ্যা করতে চাই স্বপ্ন বলতে আসলে কি বোঝায়। জিজ্ঞেস করি ওর স্বপ্নের মাঝে কোনো তাড়না, তাগিদ বা আলোড়ন ছিল কিনা। আমার কথা বুঝতে ও ব্যর্থ হলে আরও স্পষ্ট করে ওকে বলি বুটিক শপের স্বপ্নটা কি ওর কাছে অনিবার্য কোনো খুনের নেশার মতো ছিল , একাগ্র চিত্তের কোনো চাওয়া ছিল কি না?
ধ্যাত কি সব পাগলামি কথা বলো তুমি ! এর মাঝে খুন-খারাবী এলো কোথা থেকে ! আমার কোন স্বপ্ন – ফপ্ন নেই। লাগবে না বুটিক শপ ! বলে শম্পা টেবিল গোছাতে থাকে যেহেতু (ওর ভাষায় এসব পাগলামি কথার ফাঁকে) আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল ।
তাহলে বলা যায় শম্পা, তোমার স্বপ্নটা আসলে যথেষ্টই তরল ছিল - হাত ধুতে ধুতে বলি আমি।
শম্পা আমার কথার জবাব দেয় না। বরং স্বপ্ন বিষয়ক আলোচনা কিংবা বুটিক শপ সব মিলিয়ে ও অনুভব করে ওর ব্যর্থতা। যে প্রীতিময় চোখ নিয়ে ও খাবার টেবিলে এসে ভাত,তরকারীর সাথে একটু একটু করে ওর স্বপ্ন তুলে দিয়েছিল আমার প্লেটে, সেই প্রীতিময় চোখেই হয়ত ধীরে ধীরে জন্মাবে বিতৃষ্ণা।
ব্যাপারটা ভাবতেই আমি হেসে ফেলি। কিন্তু আমার ভেতরের খ্যাক খ্যাক হাসির শব্দটা ওর কাছে গোপনই থাকে।
আচ্ছা , তুমি এমন কেন বলো তো ? প্রেমময়ী শম্পার কাল্পনিক জিজ্ঞাসা আমার কাছে।
- হুম ! আমি কেমন ?
- কেমন জানি ! বুঝি না তোমাকে।
- বুঝার দরকার কি ? মুখের হাসিটা ধরে রেখেই আমি কাল্পনিক কথাবার্তার সমাপ্তি টানি। আমার ভয়ানক ক্রোধ হতে থাকে কাল্পনিক কথাবার্তার রেশ ধরে। শম্পার স্পর্ধার একটা সীমা থাকা উচিত ছিল ! কি দরকার ওর আমাকে বুঝে !!!
আমার ক্রোধ বাড়তে বাড়তে তা ঘাম আকারে বের হতে থাকে। আমি বিছানায় এসে শুই। প্রচণ্ড পানি পিপাসা বোধ হচ্ছে। সাইড টেবিলেই হাত বাড়ালে পানির বোতল আমার নাগালে হলেও সীমাহীন ক্লান্তি এসে জাঁকিয়ে বসে আমার হাতে। একপর্যায়ে মনে হয় পানি না, আমি এ মুহূর্তে অভাব বোধ করছি এক গ্লাস লেবুর ঠাণ্ডা শরবত, সাথে দেয়া থাকবে একটু ইসবগুল, এক ফোঁটা গোলাপ পানি আর বরফ-কুঁচি। গ্লাসে শরবতের প্রেজেন্টেশন টা এমন হবে যে গ্লাসের বরফ আর ঠাণ্ডা পানির যে শীতলতা তার ফোঁটা ফোঁটা বিন্দু থাকবে পুরো গ্লাস জুড়ে যা দেখে আমার আমার ঘাম, ক্রোধ আর পিপাসা শরবত পান না করেও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। ঠিক এমন এক গ্লাস লেবুর শরবতের তাড়নায় আমার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হতে থাকলে সে শব্দে শম্পা দৌড়ে আসে ডাইনিং থেকে , যা তার কানে ধরা দেয়া শ্বাসকষ্টের শব্দ হিসেবে। জানতে চায় আমার অ্যাজমা আছে কি না !
ওর মনস্তত্বের ভয়াবহ করুণ দশা দেখে আমি মজা পাই। বিছানা থেকে উঠে বসতে বসতে ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে দেই।
মানুষের চেতনার গভীরে যে আরেকটা অবচেতন থাকে, যেখানে সামাজিক চিন্তাভাবনার বিপরীতে তার স্বাধীনতাপ্রিয় সত্ত্বার আরেকটা অংশ ক্রমাগতই তাদের অস্তিত্বের জানান দিতে থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশ, উদ্দীপকের সংস্পর্শে আসলে তার প্রকাশও ঘটতে পারে – এ ব্যাপারটার সাথে শম্পার পরিচয় নেই বলে আমার চিন্তার সাথে ওকে দ্বিমত পোষণ করতে দেখা যায়। এসব বলেও ওকে বোঝানো যাবে না বলে ওকে জিজ্ঞেস করি –
মন সম্পর্কে তোমার বিশ্লেষণ কি - সিগারেট ধরাতে ধরাতে ওকে জিজ্ঞেস করি ।
হয়ত আমি এ ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করতে পারি ভেবে শম্পার আমার কথার উত্তর দেয়ার সময় হয় না। হাই তুলতে তুলতে বলে – ঘুম পাচ্ছে, একটু সরে বসো তো !
আমি ভীষণ বোরিং একজন মানুষ। আমার সাথে পরিচয়ের শুরুতে এটা অনেকেই বুঝতে পারে না। তবে ইদানীং শম্পা এটা টের পেতে শুরু করেছে। ভাবতে বরাবরই আমার ভাল লাগে। ভালো লাগার ব্যাপারটা এভাবে তুলনা দিতে পারলে হয়ত শম্পার বুঝতে সুবিধা হবে – প্রচণ্ড শীতের মাঝে ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে লেপের নিচে উষ্ণতা খোঁজার মতো আরামদায়ক কোনো ব্যাপার । ছোটবেলা থেকেই আমি মাঝে মাঝে ভাবনার সমুদ্রে হারিয়ে যেতাম। ভাবনাগুলো একটা সময়ে পাখা মেলত। তখন আমার আশেপাশে থাকা মানুষগুলোকে বাস্তবের কেউ মনে হতো না। ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকার সময় কেউ আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললেও তাদের মুখনিঃসৃত শব্দগুলোকে একেকটা শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণের মতো মনে হতো । তখন আমার ভাবনার অতল থেকে ভেসে ওঠা উদভ্রান্ত চাহনি দেখে যে কারোই মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় যে চোখের সামনে খোলা বই, এক কাপ চা আর আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের সাথে আমার কোনই পার্থক্য নেই ; কারণ মনটা যে সবসময়ই উদাস ! এ প্রসঙ্গে চায়ের কথাও মনে পড়ল। আমার ভেতর কবে, কেমন করে এ ধারণা গেড়ে বসেছিল ঠিকঠাক মতো এক কাপ চা বানিয়ে খেতে পারলে কারো ভেতরেই কোনো হতাশা থাকবে না , অন্তত চা পানের সময়টুকুতে।
আমি খেয়াল করেছি আমার তাড়িয়ে তাড়িয়ে চা খাওয়া উপভোগ করাকে বিশেষ করে প্রতি চুমুক চা মুখে দিয়ে যখন চোখ বন্ধ করে আমি যে সুখানুভবে আচ্ছন্ন হই সেটা শম্পা ভালো চোখে দেখছে না ইদানীং। মনে মনে হয়ত পাগল বলেই গালি দেয় আমাকে !
ভাবনা-চিন্তার জন্য আমার কখনো বিষয়ের অভাব হয় না। এক বিকেলে নতুন আরেকটা ভাবনার খোরাক নিয়ে শম্পা আমার সামনে দু’কাপ চা নিয়ে বসলো। আমি আমার আশেপাশের সবকিছুই গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করি বলেই শম্পার এত ফুরফুরে মনে বসার ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারি ও সময় নিয়ে কিছু বলতেই বসেছে। ওর চা নিয়ে আসার আয়োজন, আসমানি –নীল সুতি শাড়ি, কপালের আসমানি আর সাদার মিশেলে টিপ যা কিনা সাধারণ নয় , সাধারণ নয় এ অর্থে যে টিপটা ছিল কুমকুমের। সচরাচর কুমকুমের টিপ আজকাল কাউকে পড়তে দেখি না ।
আমি ডাকার আগেই ও নিজ থেকেই আমার কাছে আজ কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে সেটা আন্দাজ করতে চেষ্টা করার সময়েই ও বলে ওঠে –
আজকের বিকেলটা খুব সুন্দর , তাই না ?
আমি বিকেলটার সৌন্দর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করি। বিকেল বলতে শম্পা আকাশকে বোঝালো নাকি রোজ আমাদের বিল্ডিং এর আশপাশটার যতটুকু বোঝায় নাকি আমাদের মুখোমুখি চা পানের সময়টার দিকে ইঙ্গিত করল সেটা বুঝতে বুঝতে বেশ কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল আমার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। কারণ রোজ এই বিকেল, সন্ধ্যা বা রাতের সৌন্দর্যকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শম্পাকে আবিষ্কার করতে দেখি নি কখনো ,তাই ভাবছিলাম আমার চোখই কি কিছু এড়িয়ে গেল কি না !
- হুম সুন্দর ! প্যাচপ্যাচে ঘর্মাক্ত আকাশটা সমুদ্রের গর্জনে ডেকে উঠলে তুমি অনায়াসেই একে রোম্যান্টিক বিকেলও বলতে পারতে।
- এরকম সুন্দর বিকেল আসলে একা একা উপভোগ করার কোনো মানেই হয় না ! বলে শম্পা আমার দিকে তাকায় ।
দুজন কাছাকাছি থেকেও ‘একা একা ’ হয় কি করে সেটা বোঝার এবং আমি ওর পরবর্তী বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় মধ্যবর্তী অংশে হঠাৎ করেই মনে করতে পারি শম্পা গত কয়েকদিন ওর মায়ের বাড়ি কাটিয়ে এসেছে। ওর শুভাকাঙ্ক্ষীরা ওই সময়ে নিশ্চয়ই সংসার জ্ঞানে ওর দক্ষতা বাড়াতে সাহায্যও করেছে। তাই আমি ওর একাকীত্বের মানে এক নিমিষেই এবার বুঝতে সক্ষম হই ।
বুঝতে পেরে আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসি।
বলি – একাকীত্ব !
এই সুন্দর বিকেলটা যেন আমার দুর্বোধ্য কথায় ভারী হয়ে না ওঠে, নষ্ট হয়ে না যায় তাই শম্পা ওর শাড়ির ভাঁজ নাড়াচাড়া করে সেখান থেকে কিছুটা সুগন্ধি, চুলের মেহেদীর সুগন্ধি, কাজল বা আই-লাইনার টানা চোখ আমার চোখে রেখে বলতে চায়, অন্তত ওর ইনিয়ে বিনিয়ে বলা থেকে আমি উদ্ধার করে শুনতে পাই –
- আমাদের একটা ফুটফুটে বাচ্চা দরকার !
ফুটফুটে বাচ্চাটা ওর দরকার তাই ও “ আমাদের ” শব্দটায় একটু বেশীই জোর দিলো। কেননা আমি এই মুহূর্তে এই প্রয়োজনটা অনুভব করছিলাম না ।
- হুম বাচ্চা ! ফুটফুটে বাচ্চা !
আমার হেঁয়ালি কথা শম্পার মাথায় ঢোকে না। আমার দিকে ওর আকুল হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে মনে হয় অনেকদিন ধরেই একটা মানবিক আবেদন নিয়ে আমার সামনে বসে আছে ও। ধীরে ধীরে এই সুন্দর বা রোম্যান্টিক বিকেলের দৃশ্যপট বদলাতে থাকলে বুঝি বারান্দাটা ভীষণ অগোছালো লাগে , বিছানার যে প্রান্তটা এখানে বসেই দেখা যাচ্ছে সেটিও কেমন আলুথালু হয়ে মেঝের দিকে ঝুলে পড়েছে, টেবিলে রাখা পাঁচ ছয়দিনের উচ্ছিষ্ট খাবারের দুর্গন্ধে বমি বমি ভাব হতে থাকে আমার। পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে কেমন জৈবিক বা আধা জৈবিক অপ-গন্ধে আমার মাথা ভীষণ ভার মনে হতে থাকে।
একটা বাদামী রঙের হৃষ্টপুষ্ট বাচ্চার শরীরের অস্তিত্ব, গায়ের দুধ-দুধ গন্ধ আমার ভেতর থেকে কেমন যেন ঠেলে বের হয়ে আসতে চায় । বাচ্চাটার নাম মাথায় হাতুড়ি পিটিয়েও মনে করতে পারি না । মনে করার প্রাণপণ প্রচেষ্টায় আমি এই সুন্দর বিকেলেও ঘামতে থাকি।
শম্পা জানতে চায় – তারপর ? বলো , আমাদের কি একটা ফুটফুটে, সুন্দর বাচ্চার দরকার নেই , বলো ?
বলো ?
বলো?
শম্পার এই বলো,বলো পাগলা ধ্বনিতে আমি দৌড়াতে থাকি। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় পৌঁছে যাই একটা গোপন ঘরে ; সেই ঘরে এবং সেই সময়টায়। আমার পেছন পেছন কেউ আসছে না জেনে নিশ্চিন্ত হই। সাথে আছে সেই বাদামী রঙের পাঁচ মাস বয়সী বাচ্চাটা। ধ্যাত এই বাচ্চাটা কোলে রাখাটাই তো এখন সমস্যা। বাচ্চার মা কী করে এত উদাসীন হয় বুঝে পাই না । তা না হলে বিয়ে বাড়ির ভিড়ের মাঝে কি করে ওই মহিলা আমাকে বলে –
- সুদীপ্তকে একটু ধর দেখি, আসছি এখুনি
ইয়েস ! বাদামী রঙা পাঁচ মাস বয়সী বাচ্চাটার নাম সুদীপ্ত , মনে পড়েছে এখন।
সুদীপ্তকে খুন করলে কেমন হয় ! কোন একটা ছবিতে দেখছিলাম এরকম একটা বাচ্চাকে খুন করতে গিয়ে খুনি কতটা উল্লসিত বোধ করেছিল! আমিও নিরানন্দের মাঝে একটু আনন্দ খুঁজতে লোভী হয়ে উঠি । ফাঁকা ঘর এই তো সুযোগ ! আর বিয়ে বাড়ির কোলাহলে কেউ বাচ্চাটার কান্নাও শুনতে পাবে না। ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন উত্তেজিত বোধ করি। খুন ! হুম খুন করা সহজ বা জটিল প্রক্রিয়া কিনা সেটা জানার এটাই মোক্ষম সুযোগ । বাচ্চাটার গলায় আঙুল ছোঁয়াতেই কেমন একটু হাসির মত শব্দ করল। আর ওর হাসিটা কে তাচ্ছিল্য মনে করেই আমি সুদীপ্তের গলায় আমার আঙুলের চাপটা বাড়িয়ে দিলাম আরও। একটা অমানুষিক শক্তি যেন আমার মাঝে ভর করেছে। ঘামতে ঘামতে মনে হচ্ছে এভাবেই যেন পার হয়ে যাচ্ছে অনন্ত কাল !
ঘুমন্ত মানুষের গায়ের ওজন এমনিতেই ভার অনুভূত হয় , আর এ তো মৃত । মৃত সুদীপ্ত ! আমার ঘাড়ে ওর কাঁত করে রাখা মাথাটা তাই আরও ভারী লাগছিল। আহ শান্তি ! এ ঘরে দেখি একটা বিছানাও আছে। সুদীপ্তকে বিছানায় শুইয়ে আমি ভারমুক্ত হই কিছুটা। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের খুনের মত একটা শক্তি ক্ষয়ে নিদারুণ ক্লান্তি আমাকে আচ্ছন্ন করে ক্রমেই বিছানার দিকে টানছিল। গুনে গুনে দশ মিনিট ঘুমোলেই আমার ক্লান্তি চলে যাবে জানি। তারপর নিরাপদ কোথাও গিয়ে লুকোতে হবে হত্যার দায় এড়াতে।
আহা , কি রে ! তোরা দুজনেই দেখি ঘুমিয়ে গেছিস !
সুদীপ্তর মায়ের গলায় আমার ঘুম ভাঙে। দরজা কি তাহলে না লাগিয়েই ঘুমিয়ে গেছিলাম ! সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার , সব লোম দাঁড়িয়ে গেল ! পিট পিট করে চোখ খুলে দেখি ঘর অন্ধকার , জানালায় পর্দা টানানো। কখন যে এসব করেছিলাম কিছুই মনে করতে পারি না। শুধু মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে এক্ষুনি না পালালে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাবো ।
কি রে, ঘামছিস ক্যান ? স্বপ্ন দেখছিস নাকি ? আমাকে এই কথা জিজ্ঞেস করতে করতে সুদীপ্তর মা হাত বাড়ায় ঘুমন্ত কিংবা নিথর সুদীপ্তের দিকে। আমি শিরায় শিরায় টান টান উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি মৃত পুত্রের জন্য কখন গগনবিদারী চিৎকার শুনবো মহিলার ।
ঘড়ির কাঁটা মনে হচ্ছে থেমে গেছে। আমি শব্দহীন হচ্ছি ধীরে ধীরে , তাই বোধহয় শুনতে পেলাম না ক্ষুধার্ত সুদীপ্তর চুক চুক করে ওর মায়ের দুধ খাবার শব্দ। আমি হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে ছুটতে থাকি ; পালাতে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। অন্ধকার ঘরের গুমোট বাতাস পেছনে ফেলে বারো বছর বয়সী এক কিশোরের মনো-দৈহিক অবস্থা কেমন ছিল সেটা বোঝার অনুভব আমার সমূল কাঁপিয়ে দিলো আবার এই মুহূর্তে । আমি দেখতে পাই বারো বছরের কিশোরটির হাত কাঁপছে, গা কাঁপছে। আমারও হাত কাঁপছে, কাঁপছে গা-ও। মাথায় দুঃসহ যন্ত্রণা হচ্ছে। আহ ! আমি চিৎকার করে উঠি ।
এদিকে শম্পা আমার গা ধরে ঝাঁকায় প্রবলভাবে। এই ঝাঁকুনি কতটা দীর্ঘ সময় ধরে চলছে আমার কাছে সময়ের হিসেব নেই।
বাচ্চা চাই, বাচ্চা । কিছু বলছ না ক্যান ?
আমার নীরবতা ওকে যথেষ্ট অধৈর্য করে তোলে। কানের সামনে বাজতে থাকে ওর খ্যানখ্যানে একটানা একঘেয়েমি সুর।
আমার নিশ্চল হয়ে বসে থাকা, নিশি পাওয়া দৃষ্টি দেখে শম্পা ক্ষেপে ওঠে। মানুষের চোখের দৃষ্টিতে যদি কণা পরিমাণ শক্তিও থাকত হয়ত আমি আজ শম্পার চোখের রশ্মিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতাম।
ধ্যাত , পাগল কোথাকার ! পাগলের গুষ্ঠি একটা !
বাইরে ততক্ষণে অন্ধকার তার রঙ ছাড়তে শুরু করেছে। বারান্দায় বসেও ফ্ল্যাটের মেইন গেট সশব্দে খোলার এবং কিছুক্ষণের মাঝেই আটকে দেবার শব্দ পাই। শম্পা কি কোথাও যাচ্ছে ? চলে যাচ্ছে একেবারে আমাকে ছেড়ে ? হয়তোবা , হয়তোবা না ! আমার এখন অন্য কোথাও মনোযোগ দেবার সময় নেই ।
আমার বুকের মধ্যে ঝড়ো বাতাস, হাতের মুঠোয় দুমড়ানো কুঁচকে থাকা সিগারেট যা কিছু সময় আগেও মসৃণ হয়ে আমার কাছে জ্বলে ওঠার প্রতীক্ষায় ছিল। সব কিছু এখন যেন উল্টে গেছে। একটা বাচ্চা, একটা বাদামী রঙের বাচ্চার চাওয়ার এবং নিজের করে পাবার কারো আর্তনাদে। মাথার ভেতরে কারা যেন একটাই হুল্লোড়ের অনুরণন তুলে যাচ্ছে ! একটাই শব্দ – পালাও ! পালাও !
সমাপ্ত