গত পরশুদিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় উপস্থাপন করেছেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান। আমার ধারণা, আমরা যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে যাচ্ছি, তাদের অনেকেই এই বিষয়টি লক্ষ্য করিনি।
আমরা সবাই সাধারণভাবে জানি যে, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও জেনারেল জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করার মাধ্যমে কারাগারে আটক ও দন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়েছিলেন এবং একাত্তরের পরাজিত শক্তি তথা যুদ্ধাপরাধীদেরকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এটি সত্য। কিন্তু এর বাইরেও অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। সেই বিষয়টিতেই দৃষ্টিপাত করেছেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান।
আমরা জানি যে, স্বাধীনতার পরপরই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বঙ্গবন্ধু সরকার দালাল আইনের অধীনে প্রায় ৩৭০০০ মানুষকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দেয়ার পরও ১১ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল যারা ছিল সাধারণ ক্ষমার আওতাবহির্ভুত। এই ১১ হাজারের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৭৫২ জনকে আদালত দন্ডদান করেন। এর মধ্যে অন্তত ৩০জনের বেশি ছিলেন যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী।
১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম দালাল আইন বাতিরকরণ অধ্যাদেশ জারি করেন। এই অধ্যাদেশটিতে মাত্র ২টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ১ম অনুচ্ছেদে অধ্যাদেশটির নামকরণ করা হয়েছে "দালাল আইন বাতিলকরণ অধ্যাদেশ"।
[1. This Ordinance may be called the Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) (Repeal) Ordinance, 1975.]
এরপর রয়েছে ২য় অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদে আবার তিনটি উপ-অনুচ্ছেদ রয়েছে।
১ম উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- দালাল আইন-১৯৭২ বাতিল করা হলো।
[2. (1)The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (P.O. No. 8 of 1972), hereinafter referred to as the said Order, is hereby repealed.]
২য় উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- এই আইন বাতিলের আগে যাদের নামে যেকোনো আদালতে বা কর্তৃপক্ষের সামনে মামলার কার্যক্রমবিষয়ক যাই চলতে থাকুক না কেন, তা আর সামনে এগুবে না। যেখানে যা কিছু আছে, তা মৃত্যু মুখে পতিত হবে।
[2. (2) Upon the repeal of the said Order under sub-section (1), all trials or other proceedings thereunder pending immediately before such repeal before any Tribunal, Magistrate or Court, and all investigations or other proceedings by or before any Police Officer or other authority under that Order, shall abate and shall not be proceeded with.]
এরপর রয়েছে ৩য় উপ-অনুচ্ছেদ। আমার ধারণা, এটি-ই আমাদের অধিকাংশের অজানা। ৩য় উপ-অনুচ্ছেদের আবার দুটো অংশ রয়েছে- 'ক' ও 'খ'। ৩য় উপ-অনুচ্ছেদের প্রথম অংশ অর্থাৎ 'ক'-তে বলা হয়েছে-
যারা দালাল আইনে ইতোমধ্যে দন্ডিত হয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে আপিল করেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই বাতিল অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবে না।
[2. (3) Nothing in sub-section (2) shall be deemed to affect -
(a) the continuance of any appeal against any conviction or sentence by any Tribunal, Magistrate or Court under the said Order;]
এর সরল অর্থ দাড়ায় যে- যারা ঐ সময় যুদ্ধাপরাধী হিশেবে দালাল আইনের অধীনে দন্ডিত হয়েছেন অর্থাৎ ৭৫২ জন দন্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের জন্য এই দালাল আইন বাতিলকরণ অধ্যাদেশটি কার্যকর নয়। শুধু তা-ই নয়, ৩য় উপ-ধারার দ্বিতীয় অংশে অর্থাৎ 'খ'-তে সুনির্দিষ্টভাবে জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টের ৬ দফা দিয়ে যথোপযুক্ত রক্ষাকবচ সৃষ্টি করা হয়েছে।
এতক্ষণের আলোচনার পর যা দাড়াচ্ছে, তার মূল কথা হল- দালাল আইন বাতিলকরণ অধ্যাদেশের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করে দেয়া হয়। কিন্তু দালাল আইন বাতিলকরণ অধ্যাদেশটি দালাল আইনে দন্ডিত ৭৫২ জন যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ৭৫২ জন দন্ডিত যুদ্ধাপরাধীরা পূর্ণ সাজা ভোগ করবে। কিন্তু আমরা জানি, জেনারেল জিয়াউর রহমান তাদেরকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হল- এই যুদ্ধাপরাধীরা জেল থেকে মুক্তি পেলেন কিভাবে? জিয়াউর রহমান তাদের কোন ক্ষমতাবলে মুক্তি দিলেন? এর আইনি ভিত্তি কোথায় রয়েছে? যদি এর কোন আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহলে দন্ডিত অনেক যুদ্ধাপরাধীরাই এখন প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন; তাদেরকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না?
প্রথম আলো-তে প্রকাশিত মিজানুর রহমান খানের কলাম
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১২:২৩