আমাদের চবি ক্যম্পাসের এক ছেলে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে গেলে তাঁকে একপর্যায়ে ফ্যমিলি ব্যকগ্রাউন্ড সম্পর্কে বলতে বললে সে বলেছিলো, ‘My grandfather was a farmer. Later on his son became a university professor. And I am his son Shourab Islam.' কোন তদবির ছাড়াই তাঁর চাকুরীটি হয়েছিলো।
এ ঘটনাটা এ জন্য উল্লেখ করলাম যে, আমার দাদাও একজন কৃষক ছিলেন। অতি নিরীহ একজন কৃষক। আমার বাবা স্কুল থেকে এসে কৃষিকাজে তাঁর পিতাকে সহযোগিতা করতেন। আমার মনে পড়ে, ইউনিভার্সিটির হল থেকে বাসায় গেলে মাঝে মাঝে আমি কাঁচি নিয়ে গরুর ঘাস কাটতাম। আমার বড় ভাই আজকের উপ-সচিব, ছোট বেলায় আমাদের সাথে বিলে না-ড়া (ঘান কাটার পরে পরিত্যক্ত গোড়া) কাটতাম। আমরা ৯ ভাই-বোনের সবাই পড়া-লেখায় ছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মা টানা-পড়েনের মাঝে তাঁদের সংসার চালাতেন। জ্ঞাতি ভাই-বোনেরা যাদের পিতার টাকা ছিল, যারা দামী কাপড়-চোপড় পড়তেন, তাঁদের বলতে গেলে কেউই আমাদের পরিবারের মতো উঠতে পারেনি। বাবা-মা’র কড়া শাসন, অর্থনৈতিক টানাপড়েন এর মাঝে আমরা বুঝেছি পড়ালেখা ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর নাই।
আমার বাবা ১৯৪৬ সালে ম্যট্রিক পাস। মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডী পেরুনোর সুযোগ পান নি। বড় বোন ছিলেন অতি-সুন্দরী, এখনও। অথচ তাঁকে গ্রামের রেওয়াজ অনুযায়ী বিয়ে না দিয়ে অতি কষ্টে পড়াতে থাকেন। এভাবে শুরু। বাবা-মা’র এই বিরাট পরিবারে এমনকি মেয়েরাও সবাই ফ্রম দ্য এন্ড অফ দেয়ার স্টুডেন্ট লাইফ, চাকুরী করে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে তাঁরা দাপটের সাথে চাকুরী করে। আমাদের পরিবারে ব্যবসায়ী নাই।
আমার অত্যন্ত কষ্ট লাগে আমরা আমাদের সন্তানদেরকে সেভাবে বড় করতে পারছিনা যেভাবে আমাদের বাবা-মা আমাদের গড়ে তুলেছেন। আমার বোনেরা পড়ালেখা, ছোট ভাইবোনদের সামলানো, বাড়িতে অব্যাহত মেহমানদের চাপকে সামলেছেন, ঘরের কাজ করতেন। অবশ্য আমরা ছেলেরা পুত্র-সন্তান হয়ে বসে থাকি নাই। উপরে সে কথা কিছুটা বলা আছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা, যাদের বাবা-মা’রা এক একজন এলিট, তাঁরা পড়ালেখার পাশাপাশি ঘরের কাজ করবে – এটি ভাবতেও পারে না। ঠিক যেভাবে আমাদের জ্ঞাতি ভাই-বোনেরা ভাবত, তাঁদেরতো কোন অভাব নাই, কেন তাঁরা কাজ করবে ! পার্থক্য এতটুকু যে , আমাদের সন্তানেরা উঠে যাবে; অর্থাৎ এলিট হয়ে উঠবে।
এই ‘ক্যরিয়ারিজম’ কে আমি ভয় পাই। আমি চাই সন্তানেরা পৃথিবীর যোগ্য নাগরিক হোক, লড়াকু হোক। চাইনা তাঁরা ‘যোগ্য পৃথিবীর নাগরিক’ হোক। যেভাবে সিদ্ধার্থ বলেছিল, সত্যকে গ্রহন ও অনুসরণের পরিবর্তে সে সত্যকে খুঁজে নেবে।
যাহোক, নিজের কষ্টের অতীতকে স্মরণ করে, স্বীকার করে আমি উদ্দীপ্ত হই, আলোড়িত হই। স্বপ্ন দেখি সবাই বড় হওয়ার পরিবর্তে, বড় হয়ে উঠুক। যেভাবে উঠেছেন আমার বাবা, মা, আমরা ভাইবোনেরাসহ অনেকে…। এই ছড়া/কবিতাটি কতোবার মা’র মুখে শুনেছি, ‘এমন জীবন করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন…।’