আমার চোখ ধরে আছে জাহাঙ্গির চাচা। আমার বাবা র ছোট্ট ঔষধ এর দোকানের কম্পাউন্ডার উনি। বসে আছি কাঠের তৈরি উঁচু একটা চেয়ারে। আমার গায়ে জরানো সাদা কাপড়, গলার পেছনে গিট দেয়া যাতে চুল গায়ে না ভরতে পারে। চুল বড় হলেই বাবা পাশের নাপিতের দোকানে পাঠিয়ে দিতেন এই চাচা র সাথে। এখন কার ছোট ছোট বাচ্চা দের চুলেরও কত নামের ছাট। রাহুল ছাট, এই কাট সেই কাট আরও কত। তখন বাবা র বলে দেয়া একটা ছাট ই আমার জানা ছিল আর্মি ছাট। আমার মেজ চাচা বেশ বড় চুল রাখতেন সাথে বেশ কায়দা করে কাটা চিপ। আমার খুব ইচ্ছা করত কিন্তু বলা হত না। বাবা র কড়া হুকুম অমান্য কেন প্রশ্ন করারও সাহস নেই। আর্মি ছাট এ চুল পিছন থেকে প্রায় চেছে তুলে চাদি বরাবর একটু বড় থাকত সেই বড় এমন যে আঙ্গুল দিয়ে চিমটি কেটেও চুল ধরা যেত না। চিপ বরাবর শুধু চুলের কিছু রেখা ভেসে থাকা। সহজ কথায় ন্যাড়ার ঠিক আগের পর্যায় বলা যায়। আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। শুধু এ টুকু মনে আছে আমি তখনও স্কুল এ ভর্তি হইনি।
চুল কাটছেন অনিল কাকা। এক বার ঘার ডান দিকে কাত করে কোমর সোজা করে দিতেন নড়াচড়া করা যেত না। সেই সাথে চোখ ধরে থাকায় ঘাড় লেগে যেত, চুল গড়িয়ে কখন নাকের উপর গিয়ে সুরসুরি দিত কিন্তু নড়াচড়া করা যাবে না। কখন বা গায়ে জরানো কাপড় ভেদ করে চুল গুলো ফুটত শরীরে। শরীর নড়ানো যেত না এদিকে সুরসুরি আর চুলের খোচায় পা মুচড়ে যেত। নড়লেই কাকা বলত এই ন্যাড়া করে দিব কিন্তু। সেই কথা শুনে দাতে দাত চেপে নাকের উপরের সুরসুরি আর চুলের খোচা হজম করতে থাকি। যত যাই হোক ন্যাড়া করে দিলে বন্ধুরা মিলে মাথায় চাটি মের ছড়া কাটবে
“নাড়ে মাথা চার আনা,
চাবি দিলে ঘুরে না,
একটা চাবি নষ্ট ,
নাড়ে মাথার কষ্ট”
উফ সে কথা চিন্তা করতেই যেন কিছু সব হজম হয়ে যায়। কয়েকদিন আগে লুকোচুড়ি খেলতে গিয়ে বুড়ি হয়ে ছিল এক ন্যাড়া মাথার বন্ধু, ওকে এত জোরে মাথায় চাটি মেরে তিলা দিছি যে ও আমার ন্যাড়া হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা শুরু করে দিছে। তাই যাই হোক ন্যাড়া হওয়া যাবে না।
দোকানে দুটি মাত্র চেয়ার। একটা লাল কালো রেক্সিনে ঢাকা নারকেলের ছোবড়ার গদি ওয়ালা, সেটার ও কোথাও কোথাও রেক্সিন উঠে ভেতরের ছোঁবরা গুলো বেরিয়ে আছে। সেটাতে আমাকে বসায় না, বসায় পাসের কাঠের টাতে। সামনে লম্বা টানা কাঠের তৈরি টেবিল, সেখানে চার কোনা দুটি আয়না ঠেস দেয়া। আয়না গুলোর অবস্থা যাচ্ছে তাই। পেছনের পারা উঠে গেছে কোথাও কোথাও। তারপরও এত বড় আয়নায় মুখ দেখতে আলাদা মজা লাগত। মাঝে মাঝে কাকা র এ দোকানটি তে এসে আয়নায় নিজের মুখ দেখতাম। চোখের পাতা উল্টিয়ে মুখ ভেংচিয়ে নানা ভাবে মুখ দেখতে আলাদা মজা লাগত। টেবিলের উপর রাখা কয়েকটি প্লাস্টিকের চিড়ুনি, কেচি, ক্ষুর, কলপ এর ছোট ছোট বোতল গুলো আয়নার সামনে সার করে সাজানো থাকত। একটা পিতলের বাটি। পাশে বালতি তে করে পানি আনা থাকত। টেবিলে আরো থাকত আফটার শেভ লোশন, ফাইভ স্টার সেভিং ক্রিম, ফিটকিরি। প্রথম প্রথম ফিটকিরি টাকে দেখে অবাক হতাম, মনে হত বরফ অথচ কি আশ্চর্য সেটা গলে যায় না। পরে যাখন চুল কাটার পর ফিটকিরি পানিতে চুবিয়ে ঘাড় দিয়ে চুলের ধার ঘেসে ঘষে দিত তখন এমন জলা জলত যে ওই ফিটিকিরি দেখলেই ভয় লাগত। সব চেয়ে মজার জিনিস হল আফটার শেভ লোশন। আমরা দেখতাম শেভ শেষ করে সেটা গালে ভরিয়ে দেয়। ত আমরা কয়েক জন তখন লুকিয়ে সাবান দিয়ে গালে ফেনা তুলে কাঠিদিয়ে রেজার এর মত বানিয়ে শেভ করার মত করতাম। আর তার পর ওই দোকানের আশপাশ ঘোরাঘুরি করতাম, কাকা যখন একটু বাহিরে যেত আমরা আফটার শেভ লোশন হাতে নিয়ে গালে দিতাম। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগত। একদিন আমার এক বন্ধু র হাত কাটা ছিল ও সেই অবস্থাতেই লোশন হাতে নিছে গালে মাখার জন্য। লোশন ওর কাটা যায়গায় ভরতেই এমন চিৎকার করেছিল যে আমরা সে দিন ধরা পরে গিয়েছিলাম। গন্ধ টা আরো ভালো লাগত।এখন কত ব্র্যান্ড এর লোশন ব্যাবহার করি কিন্তু সেই গন্ধ টা ভুলতে পারিনি।
আর একটা স্পেশাল চিরুনি ছিল স্টেইনলেস স্টিলের। সেটার দাত গুলো বেশি বড় না। একদিকে প্রসস্থ আর এক দিকে সরু। সেটা ব্যাবহার করত চুল গুলো নির্দিষ্ট সাইজ দিতে। যখন ওটা মাথার পিছনে ব্যাবহার করত তখন ভয় লাগত। পিছনে নিচ থেকে কাটতে কাটতে চাদি পর্যন্ত এসে হঠাৎ উপরে উঠে আবার নিচে আসত। নিচে আসার সময় অনেক সময় টকাস করে চাদিতে লাগত।
দোকান টি ছিল বাশের চাটাইয়ে ঘেরা উপরে টিন। কিন্তু এ অনিল কাকা র কাছে এলাকার মোটামুটি নাম ডাক ওয়ালা সব মানুষ ই আসে। বা বড় কোন অফিসার হলে বাসায় ডেকে পাঠায়। আর কারো আকিকা তে মাথা ন্যাড়া করানোর জন্য তার ডাক পরে।
মানুষটি হাল্কা পাতলা গড়নের। পড়া লেখা মেট্রিক পাশ। তার দোকানে খবর এর কাগজ অনেক লোকের প্রতিদিনের পাঠ্য। চার ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার সুখেরই বলা যায়। তার মাঝে মেজ ছেলেটি মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধি।
পুজোর সময় অবস্বম্ভাবি ভাবে সে আমাদের দাওয়াত দিত। আমাদের আসেপাশের কয়েক বাসার সবাই মিলে ভ্যানে করে পুজো ডুবানোর দিন দুপুর এর পর যেতাম। যাওয়ার পরপরই প্রথমে আমাদের থালা ভর্তি জলপানি দেয়া হত। সেটা খেতে গিয়ে আমাদের এক এক জনের যা অবস্থা হত, তা দেখার মত। তবে হাড্ডির মত শক্ত নারকেলের এক প্রকার এর নারু টা আমাদের সবার ই খুব প্রিয় একটা খাবার। আমরা আসার সময় কাকি আমাদের বাসার জন্যও দিতেন। বিকালে পুজো ডুবানো দেখতে যেতাম। বিশাল একটা বিলের ধারে দাঁড়িয়ে ঢাকের শব্দে আর উলু ধ্বনি তে বেশ ভালো লাগত। আমরা ছোট রা নানা ব্যাপার নিয়ে শুধু কথা বলতাম। এত কষ্ট করে বানিয়ে ডুবায় কেন? ডুবানোর পর কি হয়? এমন আরো নানা প্রশ্ন। সন্ধ্যায় সেখান থেকে কাকা দের বাড়িতে ফেরার সময় বাড়ির সামনে এসে ভয় লাগত। সেখানে একটা গাছের নিচে মন্দির ছিল। সেটার ভেতরের দেবী টি র সামনে কেরোসিনের প্রদিপ জালিয়ে রাখত। সন্ধ্যার অন্ধকারে দেবীর সুন্দর মুখটিও পাশের পেচার মুখটির সাথে কেমন যেন ভয়ঙ্কর জীবন্ত লাগত। কাকা র গাছের বড়ই ধরলেই আমাদের খবর দিত। সব মিলিয়ে আত্মিয় না হয়েও তার সাথে আত্মার সম্পর্ক আমাদের।
রোজার সময় বাসায় ইফতার এর থালা সাজানোর সময় চেম্বার এর জন্য কয়েক টি আলাদা থালা সাজাতে হত। ইফতার এর আগে কেউ আসলে তাকে বাবা ইফতার না করিয়ে যেতে দিতেন না। আর অনিল কাকা র জন্য অবশ্যই একটা থালা থাকত। কখন কখন তিনি আমাদের সাথেই ইফতার খেতেন, কখন মনে হয় নি যে তিনি হিন্দু তার সাথে ইফতার করা যাবে না। আমাদের আশেপাশের বাসা গুলোতে যদি ভালো কোন রান্না হত অনিল কাকা র অবশ্যই ডাক পরত। তাকে আমরা শ্রদ্ধা, ভয় সবই করি আমাদের গুড়ুজন দের যেমন ভয় করি। কাকা যদি পুকুর থেকে মাছ তুলতেন সেটা কয়েক বাটি রান্না করে কাকি পাঠাতেন। সেই স্বাদ কেমন ছিল সেটা মনে করতে গিয়ে জিভে জল এসে যাচ্ছে।
তার দোকানের কেচির সেই আওয়াজ যেন এখন বেজে যাচ্ছে। বংশ গত পেশা ধরে রেখে সে দিব্যি আছে। দোকান টি আজও তেমনই আছে। শুধু আয়না টা আর ক্ষুর এর যায়গায় ব্লেড এসবের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। জমি জমা যা আছে তা চাষ করে আর এই দোকান দিয়েই দিন চলে যায়। হয়ত তার অনেক টাকা নেই, কিন্তু আন্তরিকতা, বা সন্তুষ্টির মাপ কাঠিতে সে অনেক উঁচুতে।
বয়সের ভারে নুয়ে পরেনি কিন্তু তার পরও শুকন মুখটিতে বয়সের বলি রেখার আকিবুকি এখন বোঝা যায়।
সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপারটা আগে বুঝতাম না। এখন কিছু কিছু বুঝি। কিন্তু আমার কাছে সেটা পরিষ্কার না। হিন্দু বলে আমরা ত কখন কাকা বা অন্য কারো সাথে খারাপ ব্যাবহার করিনি বা করা যায় সেটাও মাথাতে আসে নি। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের সবখানেই এমন, কিন্তু তার পরও কিছু ঘটনা যে গুলো ঘটছে সে গুলো স্বার্থপর কিছু খারাপ মানুষ দের সৃষ্টি। আমাদের বাঙ্গালী আবাহমান সংস্কৃতি পাশাপাশি থাকার, আবেগের আর ভালোবাসার। পৃথিবী র আর কোথাও অন্যান্য ধর্মালম্বী মানুষ এক সাথে পাশাপাশি এত বিশ্বস্ত ভাবে থাকতে পারে না, আমরা যত টা থাকি। শুধু সাম্প্রতিক রামু র ঘটনা না অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই অসহিস্নু ভাব। মানুষ এর মাঝে কিসের যেন এক ছাই চাপা আগুন। আমাদের কাছে কোন কিছুই পরিষ্কার না, কারন খারাপ শক্তিধর মানুষ গুলো সেটা কে ঘোলাটে করে রেখেছে। তাদের হীন স্বার্থে আমরা সাধারন মানুষ বলি হচ্ছি। আমাদের সংস্কৃতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ এসব হারিয়ে আমরা যেন দিশেহারা হয়ে আছি। সে দিশার সন্ধান আমাদের কেউ দেবে না, আমাদের ই খুজে বের করতে হবে।
পৃথিবীর সব খানেই আজ হিংসা খুনোখুনি, এসব বিকৃত রুচির কিছু মানুষদের ক্ষমতা নামক এক ফালতু জিনিস এর জন্য। আমরা সাধারন মানুষ রা যদি শুধু নিজেদের সাধারন মনে করে একে ওকে গালাগালি করি আর দোষারোপ করি তাহলে অনিল কাকা দের মত আত্মীয় দের আমরা হারিয়ে ফেলব। সে হারানো মানে হারিয়ে যাওয়া নয়, হারিয়ে ফেলব বিশ্বাস, হারিয়ে ফেলব আবেগ, হারিয়ে ফেলব আমাদের সংস্কৃতি। এগুলো ছাড়া আমরা কি মানুষ হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারব?