ষাট বছর আগে, মার্চ ১৯৪৯ সালে, সাদাত হাসান মান্টোর ‘ঠান্ডা গোশত’ গল্পটি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়। ছাপা হওয়ার পরপরই গল্প ‘অশ্লীল’ এই অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং মান্টোকে অপরাধীর কাঠগড়ায় তোলা হয়।
দেশ বিভাগের সময় দাঙ্গার ওপর লেখা এই গল্পটি মান্টোর আরও অনেক গল্পের মতোই, প্রবল দাঙ্গাবিরোধী। আমাদের বিবেকের ওপর কশে চাবুক দেয় সে।
খোলামেলা ভাষায় শরীরী সম্পর্কের বিবরণ থাকায় পাকিস্তানের রক্ষণশীল মহলের পক্ষে এ গল্প হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে মুম্বাই থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পাকিস্তানে চলে আসার পর লাহোরে বসে এই গল্পটি তিনি লেখেন। পাকিস্তানে সেটিই ছিল তাঁর রচিত প্রথম গল্প।
বন্ধু আহমেদ নাদিম কাসমির অনুরোধে তাঁর মাসিক পত্রিকা নাকুশ-এর জন্য গল্পটি লেখা, কিন্তু সে গল্প পড়ে কাসমি এককথায় তা নাকচ করে দেন। ‘এ গল্প বড় উত্তেজনক’—এই ছিল তাঁর যুক্তি। এই গল্প এরপর আরও চার-পাঁচ হাত ঘুরে আসে, কেউই তা ছাপাতে সাহস পান না বলে জানালেন।
অবশেষে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য আরিফ আবদুল মতিন তাঁর সদ্য প্রকাশিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা জাভেদ-এর এক বিশেষ সংখ্যায় গল্পটি ছেপে দেন। সম্ভবত কর্তাদের কারও চোখে পড়েনি, এক মাস পরও এ নিয়ে কোনো মহলে চেঁচামেচি নেই দেখে মান্টো ধরে নিয়েছিলেন, ফাড়া বোধহয় কেটে গেছে।
আর ঠিক তখনই তথ্য দপ্তরের নির্দেশে জাভেদ-এর অফিসে পুলিশ এসে হানা দিয়ে সে পত্রিকা অফিস বন্ধ করে দেয় ও পত্রিকার সব কপি বাজেয়াপ্ত করে। প্রথমে প্রেস অ্যাডভাইজরি বোর্ডে এ নিয়ে মামলা উঠল। সে বোর্ডের প্রধান ছিলেন কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ।
তিনি বললেন, এই গল্প মোটেই অশ্লীল নয়, তবে কোথাও কোথাও আপত্তিকর ভাষার ব্যবহার আছে, যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু বোর্ডের একাধিক সদস্য বললেন, এমন অশ্লীল গল্প পাকিস্তানে কোনো পত্রিকায় ছাপা হবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় বিষয়টি পাঠানো হয় এক নিম্ন আদালতে। একই সময় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় সে পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক এবং মান্টোর বিরুদ্ধে। আগাম জামিন নেওয়ার ফলে তাঁদের অবশ্য জেলে ঢুকতে হয়নি।
নিম্ন আদালতে দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের পর (যার বিবরণ তাঁর স্বভাবসুলভ পরিহাসময়তায় মান্টো নিজেই দিয়ে গেছেন) লেখক এবং পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক দোষী সাব্যস্ত হলেন। অশ্লীল গল্প লেখার অপরাধে শাস্তি হিসেবে মান্টোর জন্য নির্ধারিত হলো তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৩০০ রুপি জরিমানা।
সে রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আপিল করা হলো। নির্ধারিত জরিমানা দিয়ে আগাম জামিন পেলেন মান্টো ও সহযোগীরা। এরপর সে মামলা উঠল সেশন জজের আদালতে। পরপর তিনজন বিচারক একের পর এক নানা অজুহাতে মান্টোর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানালেন।
অবশেষে মামলা উঠল অতিরিক্ত সেশন জজ এনায়েতুল্লাহ খানের আদালতে। অতি-ধার্মিক বলে পরিচিত এই সেশন জজের হাতে ন্যায়বিচার পাবেন এমন কোনো আশা মান্টো করেননি।
বিচারক নিজেও মান্টোকে বললেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে রায় দিলে যত দোষ পড়বে আমার চাপদাড়ির ওপর।’ বিস্তর নয়-ছয় করার পর সে বিচারক যে রায় দিলেন, তাতে মান্টো ও বাকি দুজন আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
শুধু তাই নয়, যে জরিমানা তাঁরা আগে দিয়েছিলেন, তাও ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। মান্টো স্মরণ করেছেন, এই রায় বেরোনোর দিন কয়েক পর কোহাট থেকে প্রশিক্ষণরত এক ক্যাডেটের কাছ থেকে পাওয়া এক পত্রে তিনি জানতে পারেন, চৌধুরী মোহাম্মদ হোসেন নামে যে ভদ্রলোক তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম মামলা ঠুকেছিলেন, কিছুদিন হলো তিনি মারা গেছেন।
সে কথা শুনে মান্টো মন্তব্য করেছিলেন, মৃত লোকের বিরুদ্ধে কথা বলতে নেই, কিন্তু পাকিস্তানে তো উন্মাদের অভাব নেই। তাদের কেউ যদি ফের এ নিয়ে মামলা ঠুকে, তো তাকে বলব: ‘হে বন্ধু, তোমার দীর্ঘ জীবন কামনা করি, (যাতে প্রেমাস্পদের ঘাড়ে) ছুরি চালানোর মতো সময় ও সুযোগ তোমার থাকে।’ (সার-ই-দস্তাঁ সালামাত, কেহ তু খাঞ্জর আজমায়ি।)
এখানে ‘ঠান্ডা গোশত’ গল্পের যে বাংলা ভাষান্তর মুদ্রিত হলো, তা খালিদ হাসানের করা ইংরেজি অনুবাদ অনুসারে রচিত।
সূত্রঃ প্রথম অালো
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১০ সকাল ১১:১৬