কাল ও ভূপাল
সাধারণ বর্তমান কাল:
‘মালুর বাচ্চারে সাইজ করা লাগবো, ধরতো শালারে মাইনকা চিপা দিয়া’কথা কটা শেষ করে আয়াত আলী মুন্সী অকারণেই হাঁপায়। যতোবার ভূপাল নামের এই ছেলেটাকে দেখে ততোবার আয়াতের ওর মায়ের কথা মনে পড়ে। ইশ্, কী জব্বর চেকনাই ছিল ঐ হিন্দু বেটির! উর্বশী-মেনকা-হুর কি লাগতো মাইয়াডার পাশে! ছেলেটাও হইছে পুরাপুরি মায়ের নাকমুখ বসানো। কতোবার কতো কিছু করলো আয়াত আলী, তবু যদি ছাওয়ালডা দেশ ছাড়ে! আরে বাপ, তোর জন্য বর্ডারের ঐ পার, তুই সেখানে গিয়ে দুর্গা কী লক্ষ্মীপূজা কর, কেউ কিছু বলবে না। এখানে তুই চোখের সামনে থাকলে আয়াত আলী কি স্থির থাকতে পারে! ভূপালের ভিটাটুকু আয়াত আলীর বিশাল সম্পত্তির মাঝে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাগড়া দিয়ে বসে আছে।
ভূপাল আয়াতের উচ্চারিত বাক্যগুলো শুনেও না শোনার ভান করে জোরে পা চালিয়ে পথটুকু পার হয়ে যায়। নিজের অক্ষমতা ঢাকার এর চাইতে সহজ উপায় তো ওর আর জানা নেই। অক্ষম! কে যে কী তা আজও ভূপাল ঠিকভাবে ঠাহর করতে পারলো না। মাঝে মাঝেই তাবত পুরুষদের ওর নপুংসক মনে হয়, নারীদের দেখলে এমন বোধ জাগে যে প্রত্যেকে নষ্ট গর্ভ নিয়ে হাঁটছে। পরক্ষণেই নিজের মায়ের চিন্তা মাথায় এলেই ভূপাল নারীদের প্রতি এমন মনোভাব পোষণের কারণে নিজেকে তিরস্কৃত করে। ভূপালের রক্তে ইদানীং খুব কমই দামামা বাজে। শুধু জুন মাসটা এলেই কী এক আক্ষেপে ওর পঁয়ত্রিশ পেরোনো শরীরটা আছাড়ি-বিছাড়ি করে ওঠে। ও তখন পিরোজপুর শহরের পথে পথে হাঁটে আর মুঠো মুঠো মাটি তুলে বাতাসে ওড়ায়। মাটিতে ভূপাল অনুভব করে ওর অদেখা মায়ের রক্তস্রোত।
নিত্যবৃত্ত বর্তমানকাল:
‘আব্বা, আপনি ভূপাল স্যারের সাথে এমন করেন ক্যান? উনি আপনার কী ক্ষতি করছে?’
আয়াত আলীর তৃতীয় বিবির একমাত্র কন্যা কুলসুম তার কৈশোরিক সারল্যে বাবার গোপন ডেরায় ঠোনা মারে।
‘খবরদার, ঐ ব্যাটার নাম মুখে আনবি না। গ্রামে ওর যন্ত্রণায় একটা কাজ করতে পারি না। বেবুশ্যের ব্যাটা, গত ইলেকশনে আমার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করলো। আরে ব্যাটা, তোর মা পাক আর্মির সাথে ঢলানি করা মাগি, তোর কিসের এতো রোয়াবি রে!’
কুলসুম বাবার ভাষার ধারে আড়ালে সরে দাঁড়ায়। ও মনে মনে ভেবে নেয় সুযোগ মতো ভূপাল স্যারকেই জিজ্ঞাসা করবে আসল ঘটনা কী।
‘কুলসুম, তুমি এই ভর সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে কেন?’
‘স্যার, আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার ছিল।’
‘তুমি বোঝো না ভূপাল দত্তের কাছে আয়াত আলীর মেয়ের কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাস্য থাকতে পারে না!’
‘কেন থাকতে নেই সেটাই আমি জানতে চাই।’
ভূপাল কুলসুমকে বলে ‘কেন’র উত্তর।
ঐতিহাসিক বর্তমানকাল:
ভাগীরথী দেবী মাত্র আঠার বছর বয়সে বিধবা হোন। বিয়ের এক বছরের মাথায় স্বামী বিয়োগে স্তব্ধ ভাগীরথী শিশুপুত্রসহ ফিরে আসেন পিত্রালয়ে, পিরোজপুর থানার বাঘমারা কদমতলী গ্রামে। মেনে নেন সুকঠিন বৈধব্য। এভাবে যাপিত নিস্তরঙ্গ জীবনে একদিন আসে অদ্ভুত আঁধার। একাত্তর সাল। মে মাসের এক বিকেলে ইয়াহিয়ার ঝটিকা বাহিনী চড়াও হয় ভাগীরথীদের গ্রামে। নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মাঝেও ভাগীরথীকে ওরা মারতে পারলো না। তার দেহলাবণ্য দস্যুদের মনে যে লালসা জাগালো তাতেই হার মানলো তাদের রক্তপিপাসা। পাক আর্মিরা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেলো, চালালো দিনের পর দিন অত্যাচার। পরিস্থিতি যখন এমনই বিরূপ তখন ভাগীরথী মৃত্যুকে বড় আপন ভাবতে থাকলো। এক সময় এলো নতুন চিন্তাভাগীরথীর মনে হলো মৃত্যুই যদি বরণ করবে তবে কেন সাথে পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে মরবে না! যেমন ভাবা তেমন কাজ। ভাগীরথী কৌশলের আশ্রয় নিল। আর্মির লোকদের সে দস্তুরমতো খুশি করতে থাকলো। অল্প দিনেই সে অর্জন করে নিল নারী লোলুপ ইয়াহিয়া বাহিনীর আস্থা। পাক আর্মিদের কাছ থেকে ভাগীরথী জেনে নিতে থাকলো সব গোপন তথ্য। এক পর্যায়ে বিশ্বাসভাজন ভাগীরথীকে পাক আর্মি বাড়িতেও যেতে দিল। সামরিক ক্যাম্পে যাওয়া আর নিজ গ্রামে ফিরে আসার কাজ করতে থাকলো ভাগীরথী চরম নিষ্ঠার সাথে। এরই মধ্যে ভাগীরথী তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো। গোপনে মুক্তিবাহিনীর সাথে গড়ে তুললো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
এরপরই এলো আসল সুযোগ। জুন মাসের একদিন ভাগীরথী পাকসেনাদের আমন্ত্রণ করলো নিজ গ্রামে। এদিকে মুক্তিবাহিনীকেও তৈরি রাখা হলো যথারীতি। ৪৫ জন খানসেনা এলো ভাগীরথীদের গ্রামে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে মাত্র চার-পাঁচ জন প্রাণ নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যেতে পারলো। ভাগীরথীর এরপর আর ক্যাম্পে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। পাকসেনারা ভাগীরথীকে ধরিয়ে দেবার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করলোএক হাজার টাকা। খানসেনাদের কারো হাতে নয়, ভাগীরথী ধরা পড়লো নিজ গ্রামের রাজাকারদের হাতে। তারা তাকে তুলে দিল পাক আর্মির হেফাজতে।
পিরোজপুর সামরিক ক্যাম্প। দ্রৌপদীর মতো ভাগীরথীর বস্ত্রহরণ করলো পাক আর্মি স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায়, পিরোজপুর শহরের জনবহুল চৌমাথায়, হাটবারে। দু গাছি দড়ি দু পায়ে বেঁধে জ্যান্ত ভাগীরথীকে জান্তব জিপের পেছনে জুতে দেয়া হলো। যে ভাগীরথী নিজ গ্রামের বাইরে কখনোই তেমনভাবে শহর দেখেনি, সে পিরোজপুর শহরের প্রতিটি ধূলিকণা নিজের অঙ্গে মাখলো জিপের পেছনে বাঁধা অবস্থায়। শেষ হয় না মহোৎসব! এরপরও প্রাণ থাকে। নতুন পরিকল্পনাদু পা দুটি জিপের সাথে, জিপ দুটো চলে যায় বিপরীত দিকে। নদীর নামে যে নারীর নাম সে হয়ে যায় ভাগের মানুষ, তার দ্বিখণ্ডিত দেহের সৎকারও হয় না। কুকুর-বিড়াল আর ধুলো সাক্ষী থাকে এই সাহসী জননীর বীর-গাথার।
(মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ৯ম খণ্ড, পৃ:৪২৪)
ঘটমান বর্তমানকাল
ভূপাল কুলসুমকে পুরো ঘটনা বলে দম নেয়।
‘আয়াত আলী সেই লোক যে আমার মাকে ধরিয়ে দিয়েছে। এরপরও তুমি আমার কাছে আর কী শুনতে চাও কুলসুম?’
কুলসুম কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে রাতের আঁধারে পিতার অপকর্ম ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে থাকে। অন্ধকারটা আরও গাঢ় লাগে কুলসুমের কাছে, যখন সে পথিমধ্যে আয়াত আলীর খাস চামচা বিহারী মুনিমকে দেখতে পায়। ওর মন কু গেয়ে ওঠে, এই লোক বাবাকে না বলে থাকবেই না। ‘যা হয় হোক’ ভাব করে কুলসুম পথটুকু পার হয়ে যায়।
ভূপাল নিজের মনেই তার অস্বস্তি পুষে রাখে। ওর কেন যেন বারবার মনে হতে থাকে কুলসুম কাজটা ভালো করেনি, ভূপালের বাড়িতে কুলসুমের আসা একদম উচিত হয়নি।
এই অংশটা ঘটমান বর্তমান অথবা পুরাঘটিত বর্তমান যে কোনো ভাবে বর্ণিত হতে পারে
জুম্মাবারে এমনিতেই লোক বেশি হয়। যে সারা সপ্তাহে পশ্চিম দিকে আছাড় পর্যন্ত খায় না সেও টুপিটা, পাঞ্জাবিটা বের করে মসজিদের দিকে হাঁটা দেয়। ভূপালদের গ্রামের মসজিদের সামনেটা জুম্মা শেষে লোকে লোকারণ্য। বিচার হবে। আয়াত আলী মেম্বারের ছোট মেয়ে কুলসুমকে এক মালুর ব্যাটা নষ্ট করেছে। আয়াত আলী জমায়েতের মাঝখানে বসা। সে অঝোর ধারায় কাঁদছে।
‘আমার ফুলের মতো মেয়েটারে এই লোক কিনা করছে! ও হো হো’...আয়াত আলীর বিলাপ বাড়তে থাকে। ‘মেয়ে আমার এমনই নিষ্পাপ যে লজ্জা থেকে বাঁচতে, নিজের স্যারকে বাঁচাতে আজকে সকালে বিষ খেয়েছে। আপনারা সবাই আমার মেয়েটার হায়াতের জন্যে দোয়া করেন। ওরে সদর হাসপাতালে ভর্তি করছি।’
সবাই আয়াত আলীর সাথে কুলসুমের জন্য মোনাজাত ধরে।
মুনিম রাজসাক্ষী ভূপালের অপকর্মের। সে কান্না-ক্ষোভ ইত্যাদি মিশিয়ে বয়ান করে কিভাবে ছেঁড়া কাপড়ে কুলসুমকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যেতে দেখেছে।
সালিশে সাব্যস্ত হয় ভূপালকে ন্যাংটা করে হুন্ডার পেছনে বসিয়ে সারা গ্রাম ঘোরানো হবে। ঘোরনা শেষে তাকে অবশ্যই মুসলমানি করানো হবে। পরে থানায় তার নামে ধর্ষণের মামলা করে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে।
ভূপালকে শক্ত করে ধরে আয়াত আলীর বড় ছেলে। ছোট ছেলে অত্যন্ত যতেœর সাথে ভূপালকে বস্ত্রের অহেতুক কারাগার থেকে মুক্ত করে।
‘দেখো মিয়ারা, এই মুসলমানি ছাড়া দামড়ারে ভালো কইরা দেখো।’
শব্দ কটা কেমন যেন দূরাগত লঞ্চের ভোঁ-এর মতো লাগে ভূপালের কাছে। ভূপালের সামনে সব মিথ্যে হয়ে যায়, সে নিরাবরণ এক নারীকে নিজের মাঝে অনুভব করে। কান্না পায় না। চোখের সামনে ভাসে কুলসুমের চিরকুট‘যে বাপ নিজের মেয়ের নামে মিথ্যা কুৎসা রটাতে পিছপা হয় না আপন স্বার্থ রক্ষায়, সে আপনার প্রতি না জানি কতোটা ভয়ংকর হবে! স্যার, আপনি আজই পালান, আমাকে ক্ষমা করবেন পারলে।’
হোন্ডা স্টার্ট নেয়। ভূপালের মুঠোতে মাটি। ও অপেক্ষা করে ভাগীরথী নাম্নী এক নারীর সঙ্গী হবার জন্য। মা-ছেলে দুজনেই উলঙ্গএটা ভেবে ভূপালের কেমন যেন একটু লাগেও। হোন্ডার গতি বাড়তে থাকে, ভূপাল নিজে খণ্ডিত হয়ে এদেশের মানুষকে একত্রিত করে স্বাধীনতা এনেছিল যে নারী, তার নামে একবার জয়ধ্বনি দিয়ে আমি আবার আসবো ভেবে নিজেকে সঁপে দেয় ন-অনুভবের কোলে। ততোক্ষণে সদর হাসপাতালে কান্নার রোল উঠেছে, মাগরিব-সন্ধ্যা আহ্নিকের প্রান্ত ছুঁয়ে।