পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরের নাম 'এভারেস্ট', নেপালিরা বলে 'সাগরমাতা' আর তিব্বতীরা বলে 'চুমলাংমা'। ১৮৫২ সালের জরিপে পিক-১৫ নামে পরিচিত এই শিখরটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত-শৃঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। জরিপটি শুরু করেছিলেন ভারত উপমহাদেশের তখনকার সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার জর্জ এভারেস্ট। তাই অবসরপ্রাপ্ত স্যার জর্জ এভারেস্টের নামেই ১৮৬৫ সালে শিখরটির নামকরণ করা হয়। নেপাল-তিব্বত সীমান্তে 'খুম্বু' হিমালয় অঞ্চলের 'মহালনগর' রেঞ্জে গিয়ে এখন আমরা এই শিখরের নাগাল পাই। এর ২০ বছর পর আলপাইন ক্লাবের সভাপতি ক্লিটন টমাস ডেন্ট 'এবাভ দ্য স্নো লাইন' শিরোনামে একটি বই লেখেন। তিনিই প্রথম লেখেন এভারেস্ট শিখর জয়ের সম্ভাবনার কথা। তারপর ব্রিটিশ পর্বতারোহীরা এভারেস্টে বেশ কয়েকটি অভিযান চালায়। তবে ১৯২১ সালের ব্রিটিশ অভিযানের কথাই সাধারণ মানুষ বেশি জানে। প্রথম দিকের সব অভিযানই হয়েছিল তিব্বত দিয়ে। সব অভিযানই ব্যর্থ হয়েছিল। এভারেস্টের তিব্বত দিকটাকে বলে নর্থ-ফেইস। আর নেপাল দিককে বলে সাউথ-ফেইস। প্রথম এভারেস্ট জয় করা সম্ভব হয়েছিল এই সাউথ-ফেইস দিয়েই। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে নেপাল সময় বেলা ১১টায় এডমন্ড হিলারি ও শেরপা তেনজিং নোরগে শিখর জয় করেন। সেই থেকে এই পথটি 'ব্রিটিশ রুট' হিসেবে পরিচিত। নর্থ-ফেইস দিয়ে প্রথম এভারেস্ট জয় করা হয় তার সাত বছর পর।
বর্তমানে পর্বতারোহীদের এভারেস্ট জয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ একটি সার্টিফিকেট বা সনদ দেওয়া হয়। গত কয়েক বছর ধরে এ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আগে এ রকম কোনো সার্টিফিকেট দেওয়া হতো না। তাই হিলারি ও তেনজিং এভারেস্ট জয়ের কোনো সার্টিফিকেট পাননি। এখন হিমালয় পর্বতমালার এভারেস্ট বা অন্য কোনো উঁচু শিখরে আরোহণ করতে গেলে নেপাল, চীন, পাকিস্তান অথবা ভারত সরকারকে বেশ বড় অংকের অর্থ দিতে হয়। এর নাম 'পিক রয়্যালিটি' বা 'পিক পারমিশন ফি'। এই অর্থের বিনিময়ে পর্বতে আরোহণের অনুমতি মেলে। পর্বতের উচ্চতা ভেদে এই অর্থের তারতম্য হয়। ছয় হাজার মিটার পর্বতের জন্য যে অর্থ দিতে হয়, সাত হাজার মিটার পর্বতের জন্য তার চেয়ে বেশি। আট হাজার মিটার পর্বতের জন্য আরও বেশি। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখর বলে এভারেস্টের ফি সবচেয়ে বেশি।
এভারেস্টে নেপালের দিক দিয়ে অভিযান করলে নেপাল সরকারকে এবং তিব্বত দিয়ে অভিযান করলে চীন সরকারকে ফি দিতে হয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে নেপাল বা চীন সরকার অনুমতি ছাড়া আর কিছুই দেয় না। সেই গ্লানি থেকেই সম্ভবত নেপাল বা চীন সরকার সম্প্রতি এভারেস্ট বিজয়ীদের সার্টিফিকেট দেওয়ার রীতি চালু করেছে। তবে এই সার্টিফিকেট দেওয়াটা এক রকম ছেলেখেলার মতো। কে বিজয়ী তা দেখার জন্য এভারেস্ট শীর্ষে কেউ চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে থাকে না। শিখর থেকে বহু দূরে বেস ক্যাম্পে বসে একজন লোক দায়সারার মতো ১০ টাকা দামের একটি কাগজ দেন।
তিব্বত দিকে 'চায়না-তিব্বত মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন' (সিটিএমএ) থেকে একজন লিয়াজোঁ অফিসার ছাপানো সার্টিফিকেট নিয়ে বেস ক্যাম্পে বসে থাকেন। সেই সার্টিফিকেটে পর্বতারোহীর নাম, দেশের নাম, তারিখ, সময় ইত্যাদি কয়েকটি স্থান ফাঁকা থাকে। পর্বতারোহীর সঙ্গে যে শেরপা গাইড থাকে তার কথার ওপর ভিত্তি করে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। শেরপা গাইড বেস ক্যাম্পে এসে লিয়াজোঁ অফিসারকে যখন বলে আমার ক্লায়েন্ট এভারেস্ট জয় করেছে, তখন লিয়াজোঁ অফিসার সার্টিফিকেটের শূন্যস্থানগুলো কলম দিয়ে পূরণ করে তা স্বাক্ষর করেন।
আমি ২০১১ সালের ২১ মে তিব্বত দিয়ে এভারেস্ট জয় করি। অবতরণের সময় আমাদের দলের শেরপা সরদার 'পেম্বা দর্জি শেরপা' দুপুর ১২টার মধ্যে বেস ক্যাম্পে পৌঁছে যান। শরীর দুর্বল ছিল বলে বেস ক্যাম্পে পৌঁছতে আমার বিকাল ৪টা বাজল। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে আমি অবাক। দেখলাম আমার সার্টিফিকেট তৈরি। পেম্বা দর্জি শেরপার কথা শুনেই লিয়াজোঁ অফিসার দুপুরেই সার্টিফিকেট তৈরি করে রেখেছেন। লিয়াজোঁ অফিসার আমাকে একবারও জিজ্ঞাসা করলেন না যে, আপনি চূড়ায় আর কাকে দেখেছেন বা পথটা কেমন ছিল একটু বলুন। এমনকি আমার ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলোও তিনি দেখতে চাইলেন না। শেরপার কথাই কি আরোহীর বিজয়ের সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট!
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিব্বত দিয়ে আমি পৃথিবীর ষষ্ঠ উচ্চতম পর্বত-শৃঙ্গ 'চো ইয়ো' জয় করি। সে বিজয়ের জন্য আমাকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। লিয়াজোঁ অফিসারের কাছে সার্টিফিকেট ছিল না বলে। তাই সার্টিফিকেট না নিয়েই সেবার দেশে চলে এসেছিলাম। তার পর ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে যখন আমি তিব্বত দিয়ে এভারেস্ট অভিযানে যাই, এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে তখন 'চো ইয়ো' অভিযানের লিয়াজোঁ অফিসারের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। শেরপা তাকে আমার 'চো ইয়ো' বিজয়ের কথা বললে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সার্টিফিকেট বের করে লিখতে শুরু করেন। কোনো রকম যাচাই না করে শুধু শেরপার মুখের কথায় তিনি এক বছর আগের এক বিজয়ের সার্টিফিকেট আমাকে দিয়ে দিলেন।
সার্টিফিকেট দেওয়ার ক্ষেত্রে নেপাল সরকার তিব্বতের মতো অতটা ঢিলেঢালা নয়। নেপাল দিকে বেস ক্যাম্পে সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। কাঠমান্ডুতে ফিরে নির্দিষ্ট ফরমে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। বেশকিছু দুর্নীতি ধরা পড়ার পর এখন আবেদন ফরমের সঙ্গে সামিটের এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন ক্যাম্পের ছবি সংযুক্ত করতে হয়। ২০১২ সালের ১৯ মে দ্বিতীয়বারের মতো আমার এবং প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট বিজয়ের ভাগ্য হয়। সেবারও সার্টিফিকেট না নিয়েই আমাদের দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল। ভারতের পুনে শহরের একটি দলের একজন এভারেস্ট জয় করলেও দলের তিনজনের জন্য সার্টিফিকেটের আবেদন করেছিল। ভারতের অপর এক দল আরোহী এ কথা ফাঁস করে দেওয়ায় নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। দেশে ফেরার আগে সার্টিফিকেটের জন্য আমি পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু ভারতের পুনে দলের ওই কেলেঙ্কারির জন্য সার্টিফিকেট দিতে বেশি সময় লাগবে বলে তিনি আমাকে তার অপারগতার কথা জানান।
আমরা দেশে চলে আসার পর আমাদের শেরপা সার্টিফিকেট তুলে রাখেন। অক্টোবরে আরেকটা অভিযানে নেপালে গেলে আমি শেরপার কাছ থেকে এভারেস্ট জয়ের সেই দুটি সার্টিফিকেট নিয়ে আসি। এভারেস্ট জয়ের সার্টিফিকেট আমরা যতটা মূল্যবান মনে করি লিয়াজোঁ অফিসার কিংবা সচিব হয়তো তা মনে করেন না। তারা সম্ভবত এটাকে একটা টোকেন বলে মনে করেন, শিখর বিজয়ের অবিসংবাদিত দলিল বলে নয়।
এভাবে সার্টিফিকেট দেওয়ার ফলে অসৎ শেরপা ও পর্বতারোহীরা এর ফায়দা নিচ্ছে। সুযোগসন্ধানী শেরপা ও আরোহীদের সঙ্গে দুর্নীতিও এখন তড়তড় করে পর্বতে আরোহণ করছে। ড্রাগ, ম্যাচ-ফিঙ্ংি ও মিথ্যাচার বিশ্বের অনেক জনপ্রিয় খেলাধুলাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পর্বতারোহণও কি সে পথেই যাবে! অন্যান্য ক্রীড়ার মতো বিজয়ের সনদটিই কি পর্বতারোহণের একমাত্র অর্জন বলে গণ্য করা হবে!
আমি দেখেছি পশ্চিমা দেশের অনেক পর্বতারোহী সার্টিফিকেটের জন্য লিয়াজোঁ অফিসারের কাছে বা পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ধরনা দেন না। তারা সার্টিফিকেট না নিয়েই চলে যান। কারণ তারা যে পর্বত জয় করেছেন তার প্রমাণ তার তোলা ছবি ও বর্ণনা। আগে যখন সার্টিফিকেট দেওয়া হতো না তখন পর্বতারোহীরা ছবি ও বর্ণনার মাধ্যমেই অভিজ্ঞদের কাছে এভারেস্ট জয়ের প্রমাণ দিতেন। যিনি এভারেস্ট জয় করেন তাকেই প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি জয় করেছেন। আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় যে, সার্টিফিকেটটা খুব মূল্যবান। আমি যে শিক্ষা গ্রহণ করলাম তার চেয়েও সার্টিফিকেট গ্রহণ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা স্বভাবসুলভভাবে লিয়াজোঁ অফিসারের কাছে ধরনা দেই পর্বত জয়ের সার্টিফিকেটের জন্য। পর্বত জয় করি না করি, আমাদের সার্টিফিকেট জয় করা চাই।
এম এ মুহিত
দুইবার এভারেস্ট বিজয়ী বাংলাদেশি।
http://www.bd-pratidin.com/2013/11/14/26783