সম্প্রতি ডিওএইচএস বারিধারার একটি ডাস্টবিনের কাছ থেকে অর্ধমৃত অবস্থায় আদুরি (১১) নামের এক গৃহকর্মীকে উদ্ধার করে পুলিশ। কঙ্কালসার মেয়েটার সারা শরীরে ছিলো দগ দগে ঘা আর ক্ষতের চিহ্ন, অপুষ্টি আর ক্ষুদার কারনে মেয়েটা ঠিক মত কথাও বলতে পারছিলো না। নদী নামক এক গৃহকর্তী আদুরিকে এমন নির্মম নির্যাতন করেছিল বলে জানা গেছে।
আদুরি উদ্ধার হওয়ার কয়েকদিন পর পরিচিত এক ভদ্রমহিলার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল, আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বললেন “শুধু গৃহকর্তীদের দোষ দেবেন না। আদুরিদের দোষ আছে বলেই গৃহকর্তীরা নির্যাতন করে।” ভদ্রমহিলার কথা শুনে, অনেকটা রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “দোষ আছে মানলাম তাই বলে এভাবে নির্যাতন করবেন ? আদুরি যদি আপনার মেয়ে হত তাহলে কি করতেন ?” ভেবেছিলাম আমার এই প্রশ্নে ভদ্রমহিলা থেমে যাবেন, কিন্তু দুংখজনক হলেও তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন “কোথায় একজন গৃহকমী আর কোথায় আমার সন্তান ”।
গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়, ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বাসাতেই গৃহকর্মীদের কমবেশ নির্যাতন করা হয়, প্রায়ই গৃহকর্মীকে নির্মম নির্যাতনের সংবাদ দেশজুড়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলে। বহুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, আমাদের সমাজে যেসব গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগ ঘটনাতেই নির্যাতনকারী হিসেবে কোন এক মহিলার নাম উঠে আসে ।
গত কয়েকদিন আগে আদুরির মায়ের একটা ছবি দেখেছি, আদুরির মাকে তার ক্ষত-বিক্ষত মেয়ের পাশে আহাজারি করতে দেখেছি। আদুরির মা তার আদুরিকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারন করেছেন, নাড়ি ছেড়া ধনকে পৃথিবীর মুখ দেখানোর জন্য কত অসহ্য যন্ত্রনাই না তিনি সহ্য করেছেন। আজ মানুষ নামের কলংকদের কারনে ক্ষত - বিক্ষত হয়ে যাওয়া মেয়েকে দেখে তার কতটুকু কষ্ট লাগছে, তা নিশ্চই তিনি ছাড়া আর কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়।
আদুরিকে যে মানুষ (!) নির্যাতন করেছে তারও ফুটৃফুটে এক শিশু সন্তান রয়েছে। উপরোক্ত ভদ্রমহিলারও একাধিক সন্তান রয়েছে। আদুরির মা আদুরিকে যেভাবে দশ মাস দশদিন গর্ভে ধারন করেছেন, প্রসবের অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করেছেন ঠিক তেমনি তারাও তাদের সন্তানের জন্য একি কাজ করেছেন। কিন্তু দুংখজনক হলেও তারা মা হয়ে আরেক মায়ের সন্তানদের আঘাত করেন, অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে সন্তানের বয়সী আদুরিদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন।
পৃথিবীতে বহু প্রজাতির জীব আছে, তার মধ্যে মানুষ একটি। মানুষের সাথে অন্য সকল জীবদের বিশেষ কিছু অঙ্গ - পতঙ্গ এবং বৈশিষ্টের মিল থাকার পরও, কিছু অনন্য গুনাবলির কারনে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। যেসব গুনাবলীর কারনে মানুষ শ্রেষ্টর কাতারে অবতীর্ণ হয়েছে তার মধ্যে বিবেক এবং মানবতাবোধ অন্যতম।
পশুদের বিবেক নেই, এক পশু আরেক পশুর বাচ্চাকে হত্যা অথবা নির্মম নির্যাতন করতেই পারে । কিন্তু শ্রেষ্টত্বের দাবীদার মানুষ যখন অন্য এক মানব সন্তানকে নির্মম নির্যাতন করে তখন অবাক হতে হয়, আমরা কি ধীরে ধীরে পশুর চেয়েও অধমে পরিণত হচ্ছি, এমন প্রশ্ন বারবার মানের মধ্যে ঘুরপাক খায়।
প্রবাদ আছে, “দুনিয়ার ধার দুনিয়াতেই শোধ হয়”, মানে আপনার কৃতকর্মের ফল পৃথিবীতে থাকা অবস্থায়ই পেয়ে যাবেন। আপনি মা হয়ে যদি আরেক মায়ের সন্তানকে নির্যাতন করতে পারেন, তাহলে আরেক মা আপনার সন্তানকে ঠিক একি ভাবে নির্যাতন করবে না, তার নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারবেন ?
মানলাম আপনার মেয়েকে কোন দিনও গৃহকর্মীর কাজ করতে হবে না, কিন্তু তাকে তো একদিন অন্য এক মহিলার ছেলের বউ হতে হবে , আপনি যদি অন্যের সন্তানকে বর্বরভাবে নির্যাতন করতে পারেন, সেই মহিলা কেন আপনার মেয়েকে বর্বর ভাবে নির্যাতন করবে না ?
নরীরা মায়ের জাতি, প্রত্যেক নারীর শত শত পরিচয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি একজন মা। সন্তানের হাসিমুখ দেখার জন্য মায়েরা সবকিছু করতে পারেন, সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, সন্তানের জন্য নীজের জীবন বাজি রেখেছেন এরকম অসংখ্য মমতাময়ী মা এই পৃথীবিতে রয়েছেন, এইত গত কয়েকদিন আগে সন্তান হারানোর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পাঁচ তলা ঝাপ দিয়ে নিজের সন্তানের কাছে চলে যেতে চেয়েছিলেন এক মা ।
একজন নারীকে নির্যাতন কারী বর্বর গৃহকর্তীর চেয়ে মমতাময়ী মায়ের রুপে বেশি মানায়। আমার মা আমাকে স্নেহ - ভালবাসার চাদরে জড়িয়ে রাখবেন আর অন্যদিকে এক গৃহকর্মীকে বর্বর ভাবে নির্যাতন করবেন তা আমি কখনই চাইনা। আমি চাই আমার মা আমাকে যেভাবে আদর করেন, ঠিক সেভাবে গৃহকর্মীকেও আদর করবেন।
আমরা আমাদের মা কে বর্বর গৃহকর্তী নয়, মমতাময়ী মায়ের রুপে দেখতে চাই।
উৎসর্গ : প্রিয় স্বপ্নবাজ অভি ভাই।