(ছবির সুত্র : The Daily Star )
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই আড়ালে অথবা প্রকাশ্যে পতিতাবৃত্তি চলে আসছে। এদেশে পতিতাবৃত্তিকে অনুমোদনের জন্যে তেমন আইন না থাকলেও ১৮ বছরের উপরের যুবতীদের এফিডেভিটের মাধ্যমে পতিতাবৃত্তি গ্রহনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। সংবিধানে পতিতাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হলেও এই পেশাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত এই পেশাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশে । এদের কোন ভোটাধিকার নেই (এদের পেশাকে জাতীয় পরিচয় পত্রে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি )।
সাম্প্রতিক সময়ে, মাদারীপুর সদরের পুরানবাজারের একটি যৌনপল্লিতে ইছলাহে কওমি পরিষদ নামের একটি সংগঠনের সদস্যরা হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এ সময় পুরো যৌনপল্লি লন্ডভন্ড করে দেয় হামলাকারীরা। যৌনপল্লির ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীরা জানান, হামলার সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে থাকলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। হামলার পর পুলিশের উপস্থিতিতেই সমাবেশ করে যৌনপল্লিতে আবার হামলার হুমকি দিয়েছে ইছলাহে কওমি পরিষদ।
যৌন পল্লী অথবা যৌনকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা এদেশে নতুন নয়, ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠি থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী এবং পেশার মানুষরা এর আগেও বহুবার এদের ওপর হামলা হয়েছে, বহুবার এদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছে।
সংবিধানে পতিতাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ না করা হলেও এবং কোন আইনে পতিতাদের পুর্ণবাসন ছাড়া জোর করে উচ্ছেদ করার আদেশ না থাকলেও, খোদ রাষ্ট্রের অধিনস্থ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির সদস্যরাও তাদেরকে উচ্ছেদ করার মতো বহু ঘটনা ঘটিয়েছে। এরকম একটি ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালের ২৩ জুলাই মধ্যরাতে , সেদিন ৩৫০ জন পুলিশের একটি গ্রুপ টানবাজার পতিতাপল্লীতে বর্বরভাবে হামলা চালিয়ে অমানবিকভাবে তাদেরকে উচ্ছেদ করেছিল। সেসময় সেখানকার প্রায় পাঁচ হাজার পতিতার নেতৃত্ব দিচ্ছিল সাথী নামক একজন পতিতা। দুদিন অনাহারী অবস্থায় সাথী তার কোলের শিশুকে দেখিয়ে বলেছিল ওকে যারা জন্ম দিয়েছে সেই লোকেরাই তাদের উচ্ছেদ করছে।
কোন মেয়েই বড় হয়ে যৌনকর্মীতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখে না, কোন মেয়েই নিজ ইচ্ছা থেকে যৌনকর্মীতে পরিণত হয়না। স্বল্প বেতনে চাকুরি করা কোন এক মেয়ে মৃতপ্রায় মাকে চিকিৎসা করানোর টাকা যোগাড় করতে এই পেশায় জড়িত হতে বাধ্য হয়। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করাতে, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে এবং পরিবারের সদস্যদের আহার যোগাড় করে তাদের নিয়ে সচ্চল ভাবে জীবন যাপন করতে, পরিবারের একমাত্র উপার্যনক্ষম মেয়েটি পতিতা হতে বাধ্য হয়। স্বামী যখন একাধিক বাচ্চা রেখে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে, তার সংসারের ভরণপোষন করেনা, তখন কোন এক গৃহবধু সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিতে পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়।
দারিদ্রের তাড়না, ক্ষুধার জ্বালা অথবা প্রয়োজনের তাগিদে নারীরা যখন পতিতা নামক ভয়াবহ এই পেশার দিকে পা বাড়ায় তখন রাষ্ট্র অথবা সমাজের মানুষরা তাদের প্রয়োজন পুরন করে এই পেশা থেকে ফেরত যেতে সহায়তা করে না, বরং যৌন চাহিদা পুরণের জন্য এই সমাজের শত শত পুরুষ তাদের ওপর হায়েনার মত ঝাপিয়ে পড়ে। সমাজের প্রত্যেক শ্রেণির পুরুষরা খদ্দেরে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে তাদের এই পেশায় থাকতে উৎসাহিত করে। এভাবে কিছুদিন চলার পর একসময় মেয়েটি সমাজের কাছে বেশ্যা, মাগী নামে পরিচিত হয়, যারা এতদিন তার সাথে সহবাস করেছে, তার কাছে এসে যৌন চাহিদা পুরন করেছে, তারাই তাকে ঘৃণা করা শুরু করে, বিভিন্ন ভাবে লাঞ্চিত করে।
তারপর শুরু হয় হয়রানী, যে সমাজের মানুষরা তাদের পতিতা হতে উৎসাহিত এবং বাধ্য করেছে, সে সমাজের কিছু মানুষ আবার তাদেরকে পতিতা বৃত্তি ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়, তাদের ওপর নির্যাতন করে অথবা যৌনপল্লি লন্ডভন্ড করে দিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করে, তখন সেই মেয়েগুলা মানুষদের ঘৃনা সত্ত্বেও এক প্রকার বাধ্য হয়ে পরিবার পরিজন তথা সমাজের সাথে বসবাস করার চেষ্টা করে।
কিন্তু তখন তাদের আরও বেশি ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, কারন তারা এখন ঘৃণিত থেকে দুষিততে পরিণত হয়েছে, যে সমাজের মানুষরা এতদিন তাদের সাথে সহবাস করেছে সে সমাজের মানুষরাই দুষন থেকে বাঁচতে তাদের স্পর্শ করে না, তাদেরকে সমাজের সাথে মিশতে দেয় না, পদে পদে অপমান অপদস্থ করে , একঘরে করে রাখে। আর যে সমাজের মানুষরা তাদেরকে যৌনপল্লি থেকে ঘরে আসতে বাধ্য করেছিলো, সেই সমাজের মানুষরাই আবার তাদের গ্রহণ করেনা, মূল স্রোতে ফিরে আসতে সহায্য - সহযোগীতা করাতো দুরের কথা তাদেরকে পদে পদে লাঞ্চিত করে, হয়রানি করে। প্রতিটি স্তরে এবং প্রতি মূহুর্তে ঘৃণা, অবজ্ঞা এবং বিদ্রূপের শিকারে পরিণত করার মাধ্যমে তাদের জীবনকে আরও বেশি দুর্বিষহ এবং ভয়ংকর করে তুলে।
আর এই দুর্বিষহ জীবন থেকে বাঁচার জন্য, তারা আবারও বাধ্য হয়ে যৌনপল্লীর উদ্দেশ্যে গমন করে, কোন এক যৌনপল্লীতে গিয়ে বসবাস করা শুরু করে, নিজের এবং পরিবারের আহার যোগাড় করার জন্য আবারও দেহ বিক্রি করা শুরু করে। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষরা তাদের কাছে এসে যৌন চাহিদা পুরন করা শুরু করে, এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আবারও এই পেশা ছাড়ার নির্দেশ আসে, একমাত্র আশ্রয়স্থলকে লন্ডভন্ড করে দেয়া হয়, যে আয়ের মাধ্যমে তারা তাদের মৃতপ্রায় মায়ের চিকিৎসা করাচ্ছিলো, ছোট ভাই অথবা সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছিলো, নিজের এবং পরিবারের আহার জোগাড় করছিলো সেই আয়ের রাস্থা বন্ধ করে তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
কিন্তু তাদের ওপর বার বার হামলা করা মোটা বুদ্ধির এসব বিবেকহীন মানুষরা পতিতালয় ত্যাগ করে পতিতারা কোথায় যাবে তা বলে দেননা, তাদের পুর্ণবাসনের ব্যাবস্থা করেন না, তাদের মায়ের চিকিৎসা এবং পরিবারের আহার, অথবা ভাইয়ের পড়াশোনা চালানোর মতো টাকা পাওয়ার ব্যাবস্থা করে দেন না। কোন ঠিকানায় গেলে কেউ তাকে একঘরে করে রাখবে না, কেউ তার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাবে না, পদে পদে লাঞ্চিত অথবা হয়রানি করবে না। ঘৃণা, অবজ্ঞা এবং বিদ্রূপের শিকারে পরিণত করে তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে না, কোথায় গেলে তাকে আবারও পতিতাবৃত্তি নামক ভয়াবহ জীবনে ফিরে আসতে হবেনা। সেই ঠিকানা কেউ নিশ্চিত করেন না।
মোটা বুদ্ধির এসব বিবেকহীন মানুষরা যখন অন্যায়ভাবে পতিতাদের ওপর হামলা করে , তাদের আশ্রয়স্থল ধ্বংস করে, জীবিকা উপার্জনের একমাত্র্র রাস্থা বন্ধ করে তাদের তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, তখন রাষ্ট্রযন্ত্র গা সারা ভুমিকা পালন করে, তাৎক্ষনিক ভাবে তাদেরকে হামলা থেকে রক্ষা করলেও, তাদের পুর্ণবাসন নিশ্চিত করে পতিতাবৃত্তি ত্যাগ করতে সহায়তা করেনা, যারা তাদের উপর অন্যায় ভাবে হামলা করেছে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করেনা, লন্ড ভন্ড হয়ে যাওয়া পতিতালয় ঠিক করে উপার্যনক্ষম পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়না, ভবিষ্যতে এসব বিবেকহীন জীবদের দ্বারা আক্রান্ত না হওয়ার নিশ্চয়তা দেয়না।
আর যারা নিজেদের মানবাধিকার কর্মী দাবী করেন, মানবাধিকার মানবাধিকার জপনার মাধ্যমে চোখের পানি আর নাকের পানি এক করেন, মনবাধিকার গেলো রবে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেন, তারাও পতিতাদের বেলায় নীরব ভুমিকা পালন করেন। অন্যায়ভাবে হামলা করে তাদের যখন উচ্ছেদ করা হয় তখন মানবাধিকার কর্মীরা প্রতিবাদ করেন না, হামলাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবী তুলেন না। একদিকে পতিতাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ না করা আবার অন্যদিকে পতিতাবৃত্তিকে স্বীকৃতি না দেয়ার মতো রাষ্ট্রযন্ত্রের দুমুখো আচরনের প্রতিবাদ করেন না। হয় পতিতাদের স্বীকৃতি দিন, আক্রান্ত না হওয়ার নিশ্চয়তা দিন নাহয় এদের পুর্ণবাসন করুন এমন যৌক্তিক দাবীতে একটি কথাও বলেন না।
বাংলাদেশে পতিতাদের মতো বহু নিগৃহিত, নির্যাতিত, মানবাধিকার বঞ্চিত জনগোষ্টি আছে। পতিতা ছাড়া অন্য সব জনগোষ্টির মানুষরা এক পক্ষের ধারা নির্যাতিত হলে অন্যরা এগিয়ে আসে। রাষ্ট্র, সমাজ অথবা মানবাধিকার এই তিন পক্ষের কেউ না কেউ তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়ায়, কিন্তু পতিতাদের বেলায় সবাই নির্বকার, এক পক্ষ নির্যাতন করে আর বাকিরা নিরব ভুমিকা পালন করে। কেউ তাদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসেনা, কেউ তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়ায় না। এখানে সবাই নির্যাতনকারী, সবাই দর্শক।
পতিতারা জানেনা তারা কোথায় যাবে, কে তাদের সহায়তা করবে ?
পুনশ্চ : পতিতাবৃত্তিকে নিষিদ্ধ না করা আবার পতিতাবৃত্তিকে স্বীকৃতি না দেয়ার মতো রাষ্ট্রযন্ত্রের দুমুখো আচরনের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। কোন প্রকার পুর্ণবাসনের ব্যাবস্থা না করেই পতিতাদের উচ্ছেদ করার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। পতিতাদের সাথে অমানবিক আচরনের পরও মানবাধীকার কর্মীদের নির্বিকার ভূমিকার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
টাকার বিনিময়ে শরীর দেওয়া মানেই দাসত্ব। যৌনদাসত্ব থেকে পতিতাদের মুক্ত করে আবারও সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে রাষ্ট্রযন্ত্র এগিয়ে আসবে, তাদেরকে আবারও মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে সমাজ এবং মানবাধিকার গুরুত্তপূর্ণ এবং দ্বায়ীত্বশীল ভুমিকা পালন করবে, এমন আশা রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৫৭