ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ- কথাটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । এখনো আমাদের দেশে লাখ লাখ মানুষ আছেন, যারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন শুধু দু'বেলা খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য । তাদের সন্তানদের কাছে ঈদের আলাদা কোন মাহাত্ম নেই, নেই খুশির জোয়ার । অথচ জানেন কি, আমাদের সামান্য একটু সহায়তায় আমরা হাসি ফুটাতে পারি হতদরিদ্র এই শিশুদের মুখে । উপরের ছবিতে দেখুন নতুন জামা পেয়ে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দে ভেসে যাচ্ছে অনাথ শিশুগুলো । ছবিটি নেয়া হয়েছে ব্লগার 'নির্লিপ্ত স্বপ্নবাজ' এর ফেবু ইভেন্ট থেকে ।
ঈদের হাসি-কান্নার এক জোড়া গল্প..
************************************
গল্পঃ ঈভ টিজার
-- ধুস্ শালা!
প্রচন্ড বিরক্ত জিসান তার বেন্ড করা লম্বা চুলের ভিতর থেকে সান-গ্লাসটা খুলে টি-শার্টের কোনা দিয়ে মুছতে থাকে । টি-শার্ট কিঞ্চিত উপরে উঠায় তার সদ্য গজানো ভূড়িটা থলথল করে দুলছে । আর পেছনে জিন্সের প্যান্ট কোমড় ছাড়িয়ে আরো ইঞ্চি ছয়েক নেমে গুহ্যদ্বারের মুখে আটকে আছে । ভাগ্যিস আন্ডারওয়্যার প্যান্ট কে অনুসরণ করেনি, কোমড়ের সাথে লেপ্টে থেকে গুহ্যদ্বারের আব্রু রক্ষা করে চলেছে ।
সান-গ্লাস পরিষ্কার করে জিসান মাথায় বেন্ড করা চুলের ভিতর আবার গুজে দেয় । ভরদুপুরে অস্থির পায়চারি করতে করতে রাস্তার দিকে ইতিউতি তাকায় । ঠাসা ডাসা মালের খোঁজে এদিকে আসার পর তার স্টাইলিস্ট পালসার বাইকের পেছনের চাকা হঠাৎ পাংচার হয়েছে । সাগরেদ জইস্যা সাথেই ছিল, সে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভারী বাইকটাকে নিয়ে গেছে পাংচার সাড়িয়ে আনার জন্য । প্রায় ঘন্টা খানেক হয়ে গেল, তার ফেরার কোন নাম-গন্ধ নেই ।
অস্থিরতার আরও একটা কারণ আছে । আজ চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ । ঈদের আগের দিন রাস্তাঘাটে খাসা ডাসা সব মাল বেরুবার কথা । অথচ ঘন্টাখানেক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও তেমন কোন মালের দেখা মিলল না । রাস্তায় পড়ে থাকা আধলা ইটের উপর আক্রোশ মেটানো কিক দিয়ে সে চলল পাশের টং দোকানের দিকে । দোকানের সামনের দিকটা কালো পর্দায় মোড়ানো । রোজার মাসে পর্দার ভিতরে বসে খাওয়া-দাওয়া করার নিয়ম । চায়ের অর্ডার দিয়ে জিসান একটা বেঞ্চু ধরালো । ছোট জায়গায় অনেক মানুষের এক সাথে ধুমপান, নিকোটিনের তীব্র ধোঁয়ায় চোখটা খুব জ্বলছে ।
দ্রুত চা-সিগ্রেট খেয়ে টং থেকে বের হবার পর দুপুরের তীব্র সূর্যালোকে জিসানের চোখ ঝলসে উঠে । কিন্তু অত্যুজ্জ্বল এই সূর্যকিরণ জহুরীর চোখে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । চোখের সামনে হাত দিয়ে রোদ ঢেকে জিসান সূর্যালোকের চেয়েও উজ্জ্বল কিছু দেখতে পায় । জিসান চোখ বড় বড় করে বিস্ফোরিত নয়নে দেখতে থাকে তার থেকে সামান্য দূরে রাস্তায় একটা খাসা মাল ! এই মাত্র মালডা রিক্সায় উঠলো । উজ্জ্বল হলুদ রঙের পায়ের পাতা দুটো রিক্সার পাটাতনে ছন্দ তুলে ভিত্তি খোঁজছে । রিক্সাওয়ালা রিক্সার হুড টেনে দেয় । হুডের এক পাশ কোমল করে ধরে আছে সুন্দর নিটোল হাতের আঙুলগুলো । আর হুডের ফাঁক দিয়ে জিসান দেখতে পায় বাতাসে দোল খাওয়া ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা উড়ন্ত চুল ।
জিসান দ্রুত হেটে রিক্সার কাছে পৌছুতে চেষ্টা করে । কিন্তু ততক্ষনে রিক্সা চলতে শুরু করে বেশ সামনে চলে যায় । রিক্সার পেছনের পর্দা সড়ে গিয়ে কেবল উড়তে থাকে এলোমেলো বন্য কেশরাজি । নিজের উপর আক্রোশে এক হাত দিয়ে ঘুষি চালায় আরেক হাতের তালুতে । দিনের সেরা জিনিসটা একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তীব্র আক্ষেপ- শীট...
ঠিক এই সময়ে পিঁপ পিঁপ বাজিয়ে একটা বাইক জিসানের গায়ের উপর উঠতে উঠতে শেষ মূহুর্তে ব্রেক কষে । হার্ড ব্রেকের শব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে জইস্যা কে দেখতে পেয়ে খিস্তি ঝাড়ে,
-বাইনচোত, এত দেরি করলি ক্যা ? বাইক লইয়া কৈ গেছিলি ?
জইস্যা বাইক থেকে নেমে মিনমিন করে বলে,
-দুইটা লিক খাটানোর পরেও চাক্কায় বাতাস থাকে না । পরে ম্যালা খুইজ্জা আরেকটা ছুপা লিক পাইছে । বিশ্বাস না হয় যিসু মাম্মা, মেকানিক্স রে জিগায়েন ।
-হইছে, এত্ত কথা শুনার টাইম নাই । খাসা মালডা বুঝি মিস হইয়া যায় ! এখন পিছে উঠ, আওগাইয়া দেখি পাই কি না !!
জিসান তখনই বাইক স্টার্ট দেয় । পালসার সিংহের মত গর্জন করতে করতে ছুটতে থাকে । কিছুদুর যাবার পর জিসান চিৎকার দিয়ে উঠে,
-অই জইস্যা, সামনের রিক্সায় মালডা বসা!
-যিসু মাম্মা, আমি আছি! নো টেনছন!!
জইস্যা হেড়ে গলায় গান ধরে, "তেড়ি মেরি মেরি তেড়ি প্রেম কাহানী হে মুশকিল.. "
জইস্যার কর্কশ গলার গানের সাথে বাইকের বিকট পিঁপ পিঁপ আওয়াজে সামনের রিক্সা বাঁয়ে সরতে থাকে । রিক্সার ডান পাশে চেপে এসে জিসান বলে, "হাই ডার্লিং, কুলফি খাবা!!" তার পর রিক্সাটাকে দ্রুত ওভারটেক করে । জইস্যা তখনো বাইকের পেছনে হাত-পা ছুড়ে গেয়ে যাচ্ছে, "তেড়ি মেরি মেরি তেড়ি প্রেম কাহানী.. "
আর কিছুক্ষন যাওয়ার পর একটা মোড়ের আগে বাইক থামায় জিসান । দুজনে সেই রিক্সার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে..
-মালডা কেমুন দেখলিরে জইস্যা ?
-যিসু মাম্মা, হেভ্ভী জিনিস !! মালের ঘাড়-গলার রঙ যেন দুধে আলতা । মাগার বুকের সাইজটা মাপতে পারলাম না মাম্মা ।
-চুপ কর বাইনচোত! উস্তাদের মাল লইয়া খারাপ কথা কবি না ।
-মাম্মা! খারাপ কথা কমু না!! কি কউ মাম্মা.. হাঃহাঃহাঃ
এবার দুজনেই ইঙ্গিতপূর্ণ হাসিতে ফেটে পড়ে । এই সময় রাস্তার উল্টো দিকে রিক্সাটা থামে । জিসান-জইস্যা দুজনে একে অপরকে চোখ টিপি দেয় । তার পর রাস্তা পার হয়ে রিক্সার দিকে এগুতে থাকে । রিক্সার যাত্রী সীটে বসেই ভাড়া মিটিয়ে দিতে থাকে । রিক্সার পাশে গিয়ে জইস্যার কাঁধে হাত রেখে জিসান সান-গ্লাস চোখ থেকে সরিয়ে কপালের উপর রাখে । তাদের কর্মকান্ড দেখে রিক্সাওয়ালা মুচকি হাসে । জিসান ভাব নিয়ে বলে,
-নাইম্যা আসেন ম্যাম, নাকি কোলে কইরা নামাইতে হইব !!
রিক্সা যাত্রীর উজ্জ্বল হলুদ রঙের কোমল পা দুটোর সাথে সাথে নূরানী দেহ খানি সন্তর্পনে রিক্সা থেকে নামিয়ে এনে সালাম জানায়,
-আসসালামুয়ালাইকুম । জনাব, আপনাদের কী খেদমতে আসতে পারি ??
জিসান-জইস্যা পরষ্পরের মুখের দিকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকে । কিন্তু তাদের কারো মুখ থেকে কোন কথা বের হয় না । রিক্সাওয়ালা এবং যাত্রী দ্রুত স্থান ত্যাগ করে । এই অবস্থায় জইস্যা কথা বলে উঠে,
-যিসু মাম্মা, এইডা কি হইল মাম্মা!! এইডা তো জোব্বা পড়া হুজুর!!
জিসান ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় জইস্যার গালে,
-বাইনচোত! তোরে না ভাল কইরা খেয়াল করতে কইলাম!
-(চড় খেয়ে গাল ঘষতে ঘষতে) মাম্মা, তুমিই না কইলা মালডা খাসা!!
-হাত-পা-চুল আর গায়ের নরম চামড়া দেইখাতো মালই ভাবছিলাম!!
জিসান আবার জইস্যার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,
-তোর তো আবার পেট পাতলা স্বভাব । মহল্লার বেবাকরে তুই এই গল্প কইরা বেড়াইবি!
জইস্যা অপরাধীর মত চুপ করে থাকে । তারপর জিসানের দিকে মুখ তুলে বলে,
-মাম্মা, এই কাম আর না করলে হয় না । কোন দিন যে নিজের বইন-ভাগ্নিরেই ধইরা বসি..
কথাটা জিসানের বুকে ইলেকট্রিক শকের মত বিদ্ধ হয় । স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে সে জইস্যার দিকে । ছলছল করে উঠা চোখে একফোটা জল চিকচিক করে । মাথাটা নিচু করে হনহন করে হেটে বাইকের দিকে এগিয়ে যায় জিসান ।
অতঃপর জিসানের বাইক চিতার গতিতে নিজ মহল্লার দিকে ফিরে যেতে থাকে ।
***********************************
গল্পঃ স্কুলড্রেস
-মা, বাজান রে কইছ ? ঈদের তো আর মাত্র দুই দিন বাকি ।
-হ, কইছি বাপ! তোর বাজান কইছে ঈদের আগেই কিইন্যা আনব ।
মায়ের আশ্বাস পেয়ে খুশিতে ডগবগ করতে করতে খেলতে চলে যায় মিন্টু । মা করুণ দৃষ্টিতে তার এগার বছরের লক্ষী ছেলেটার আনন্দ দেখতে থাকে ।
মিন্টুর বাবা ইরফান শহরের পাইকারি বাজার কালীঘাটে মুঠেগিরি করে । শহরতলীতে বস্তির মত একটা ঘুপচি ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করে । দিন আনে দিন খায়, প্রতিদিনের আয় থেকে কষ্ট করে কিছু বাঁচিয়ে ঘর ভাড়ার টাকা দেয় । মিন্টুর মা ও পাশের এক বাড়িতে ঝি'য়ের কাজ করে । এত কষ্টের মাঝেও ইরফান ছেলেকে স্কুলে পড়াচ্ছে । মিন্টু স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে ।
চতুর্থ শ্রেনীতে উঠার পর মিন্টু কে নতুন স্কুলড্রেস কিনে দেয়া সম্ভব হয় নি মুঠে বাবা ইরফানের । পুরাতন স্কুল ড্রেস নিয়ে মিন্টুরও কোন আক্ষেপ নেই । সে তার বাবা-মা'র করুণ আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ন সজাগ । কিন্তু সেদিন শার্টের বগলের দিকে সেলাই ছুটে একটা ছিদ্র হয়েছিল । দুষ্ট ছেলের দল কলম দিয়ে খুঁচিয়ে সেটাকে বড় করে দিয়েছে । মিন্টুর মা সেটা আবার সেলাই করে দিয়েছেন । এখন মিন্টু স্কুলে গেলে সব সময় আতন্কে থাকে, তার ড্রেস কখন জানি ছিড়ে বা ফেটে যায় ।
এজন্যই মিন্টু তার বাবাকে আবদার করেছে,
-বাবা, ঈদে আমাকে কিছু দেয়া লাগবে না । আমারে শুধু এক সেট নতুন স্কুলড্রেস কিইন্যা দিও ।
আর এই কথাটাই মিন্টু রোজ তার মা কে বলছে, যেন বাবাকে মনে করিয়ে দেয়া হয় ।
ঈদের চাঁদ দেখা গেছে । চাঁদ রাতে বাজারে সারা রাত ধরে কেনাবেচা হয় । মিন্টু জানে আজ তার বাবার ফিরতে দেরি হবে । তবু সে বাবার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করতে থাকে । মা তাকে তাড়া দেয়, 'ঘুমিয়ে পড় সোনা, সকালে দেখিস' । কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম আসে না । অবশেষে মধ্য রাতে ইরফান বাসায় ফিরে আসে হাতে একটা পোটলা নিয়ে । মিন্টুর মনে আনন্দের বান বয়ে যায়, তার বাবা তার জন্য নতুন স্কুলড্রেস কিনে এনেছে ।
রান্না ঘরে খেতে খেতে মিন্টুর বাবা তার মায়ের সাথে ফিসফিস করে কি যেন আলাপ করে । বাবার খাওয়া শেষ হবার পর মা মিন্টু কে রান্না ঘরে যেতে বলে । মিন্টু বুঝতে পারে তার বাবা এখন তাকে নতুন স্কুল ড্রেস পড়িয়ে দেখবে কেমন লাগে । খুশি মনে মিন্টু রান্না ঘরে যায় ।
-দরজা টা একটু চেপে দে বাপ ।
বাবার কথায় মিন্টু দরজাটা ভিড়িয়ে দেয় । দরজা ভেড়ানোর পর মিন্টু তার বাবা কে দেখে অবাক হয়ে যায় । প্রচন্ড রাগ-অভিমান নিয়ে তার বাবা একটা লাঠি হাতে বসে আছে । বাবার হাতে লাঠি কেন ? মিন্টু কি তবে নতুন স্কুলড্রেস চেয়ে বড় কোন অন্যায় করেছে ? আর তার অন্যায়ের শাস্তি হিসাবে বাবা তাকে লাঠিপিটা করবে ? মিন্টুও মনে মনে শক্ত হয়ে যায় । বাবা যতই পিটুক, সে একটি বারের জন্যেও কাঁদবে না ।
-মিন্টু বাপ শোন । তোর বাবা খুব গরীব । বাজারে মুঠেগিরি করে যা পায় তাতে খাবারই ঠিকমত জোগার হয় না । এইবার কাজ-কামও কম ছিল বাপ, রুজি-রোজগারও তেমন হয় নি । তাই তোর নতুন স্কুলড্রেস বাবা কিনতে পারিনি । আমি দোষ করেছি বাপ, এখন আমাকে এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তোর বাবাকে শাস্তি দে । নে বাপ লাঠি নে, শুরু কর..
ইরফান মিন্টুর হাতে লাঠি তুলে দেয় । লাঠি হাতে নিয়ে মিন্টু অবাক বিষ্ময়ে তার অসহায় বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে । পিতা-পুত্র এভাবে কিছুক্ষন একে অপরের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রয় । এমন সময় দরজা খুলে তার মা প্রবেশ করে । বাপ-ছেলে'র নির্বাক মুখ দেখে মিন্টুর মা আর সহ্য করতে পারে না । মিন্টু কে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরে । মিন্টু তখন তার মা কে জড়িয়ে ধরে বলে,
-মা, বাবা কে বল আমার নতুন স্কুলড্রেস লাগবে না । আমি আর কখনো স্কুলড্রেস চাইব না বাবা । আমার কিচ্ছু লাগবে না, কিচ্ছু না..
বাবাও তখন মিন্টু কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে । বাবা-মা -ছেলে'র এই মিলন কান্নায় সেদিন সৃষ্টিকর্তার আরশ কেঁপে উঠেছিল কি না তা আমাদের জানা নেই ।
**********************************
উৎসর্গঃ ব্লগার আমিনুর রহমান এবং ব্লগার কান্ডারী অথর্ব ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪৩