তাদের মধ্যে একজন আছেন যিনি দীর্ঘদিন ধরেই খুশিমনে এমন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন - আরজুপনি আপু , তাকেই আমি শ্রদ্ধাভরে পোস্টটা উৎসর্গ করলাম । আপু , আপনার ব্লগের প্রতি নিবেদিত মনোভাব
আমাকে মুগ্ধ করেছে ।)
যে কোন কিছুর সঠিক বিশ্লেষণ ও নির্ভুল অনুধাবনের রসায়ন রাস্তা টা আমরা এখনো ঠিক চিনে নিতে শিখিনি । শিখিনি বলেই উপরিতল দেখেই চটপট ফাইনাল রায় দেবার বহুলচর্চিত সুবিধাভোগী ব্যবসার ফাদ হতে বের হওয়ার মোক্ষম দাইয়াই নিয়ে আমাদের ভাবতে দেখা যায় না । ফলে অনেকের মত আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ও সে ফাদে ও ছাঁচে পড়ে ষোল আনা '' মানবতাবাদী '' হতে শুধু ''বিদ্রোহী '' কবি হয়ে যান ।
বাঁধাধরা সমাজের প্রচলিত ভণ্ডামি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই কি যে কেউ বিদ্রোহী অভিধায় ভূষিত হবেন ? সত্য ও সুন্দরের প্রতি থাকে যদি কারো শর্তহীন আনুগত্য তবে কি তার মস্তকে পরিয়ে দিতে হবে "'বিদ্রোহী'' তাজ ?নজরুল তবে কি ? তিনি কি বিদ্রোহী নন ? তিনি নিজেই ত নিজেকে '' মহাবিদ্রোহী বলে গেছেন !
তিনি বিদ্রোহী অবশ্যই , তিনি মহাবিদ্রোহের রণতুর্যবাদক । হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ন্যায্য ও পবিত্র ক্রোধের পিতৃপুরুষ তিনিই । নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর পুরোহিত হয়ে অবলীলায় তিনি মন্ত্রপাঠ করেন ,
যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস
যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ ।।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত ।।
তার এই বিদ্রোহের উৎসবৃক্ষ তার সাম্যবাদী - মানবতাবাদী মন । মানুষকে ভালবাসেন বলেই , মানুষকে ন্যায্য অধিকারে বিশ্বাস করেন বলেই কবিকে বলতে শোনা যায় -
যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই ,
করি সেথায় বিদ্রোহ
ধামাধরা ! জামাধরা
মরণ - ভীতু চুপ রহো ।
নজরুল ইসলাম হলেন মানবতাবাদী সূর্য । সাম্যবাদী নজরুল , প্রেমিক নজরুল , বিদ্রোহী নজরুল , দার্শনিক নজরুল , সংগ্রামী নজরুল হলেন নজরুল নামক মানবতাবাদী সূর্যের একেকটি উজ্জ্বল কিরণ ।
নজরুল পৃথিবীর সব মানুষের , নজরুল ইসলামের সবকিছুই মানুষের জন্য । নজরুল বলে গেছেন ,''স্রষ্টাকে আমি দেখিনি , কিন্তু মানুষকে দেখেছি । ধুলিমাখা পাপলিপ্ত , অসহায় দুখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত করবে , এই ধূলার নিচে স্বর্গ টেনে আনবে , এ আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি । ''
'
তাই ত কবির দেশ কল্পনায় ছিল শুধু মানুষ । বঙ্কিম যেখানে দুর্গারুপে দেশ কল্পনা করেছেন , মাতৃদেবী রুপে রবীন্দ্রনাথ দেশের কথা ভেবেছেন , সেখানে নজরুল দেশের কথা বলতে ভেবেছেন দেশের মানুষ ।
আবু জাফর শামসুদ্দিন এর ভাষায় , '' তার দেশের ধারনায় একটা ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার এক বিগ্রহ রুপের কল্পনা ছিল না । দেশ বলতে তিনি বিশেষভাবে দেশের মানুষই বুঝিয়েছেন । অবশ্য দেশের প্রকৃতি , দেশের নদী - নালা ,পাহার - পর্বত , আকাশ - মাটি - সাগর - অরণ্য তার সাহিত্যে অনেক স্থান জুড়ে রয়েছে বটে , কিন্তু সে প্রধানত দেশের মানুষের প্রয়োজনেই মাত্র স্থান লাভ করেছে । তার দেশপ্রেম দেশের একটা বিগ্রহ রুষ্ট বন্দনা গান নয় ।দেশের মানুষের সুখ - দুঃখ , আনন্দ - বেদনার রুপায়নেই তার দেশপ্রেম অভিব্যক্ত । '' ( নজরুল সাহিত্যে দেশপ্রেম , আবুল কালাম শামসুদ্দিন , দৃষ্টিকোণ , পৃষ্ঠা - ৮১ - ৮২ । )
অবশ্য নজরুলের কিছু - কবিতা গানে দেশকে মাতৃরুপে কল্পনার প্রকাশ ও আছে , তবে তা অতি সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ।
আমাদের অন্তর্নিহিত সুগভীর পাললিক সংস্কৃতির মাদকরসের সবটাই নজরুলে পরিস্ফুট । দেশের মানুষকে ভালবেসে নজরুল দেশপ্রেমী হয়ে বিশ্বপ্রেমী হয়েছেন , নিজের ভেতর অনুভব করেছেন সমগ্র মানবজাতির
আত্মমর্মকথা । মানবজাতির কল্যাণে কবি সবসময় হানাহানিমুক্ত সম্প্রীতিময় পৃথিবীর কামনা করেছেন , যেখানে থাকবেনা -
নাই - ক এখানে কালা - ধলার আলাদা গির্জা - ঘর
এই যে স্বর্গ , এই যে বেহেশত এখানে বিভেদ নাই
যত হাতাহাতি হাত রেখে মিলিয়াছে ভাই ভাই ।
আমাদের সংস্কৃতির বিভিন্নতা , বৈচিত্রতা ও আপাত বিভেদতার মাঝে মানবতাবাদের যে ধমনিপ্রবাহ বিদ্যমান কেবলমাত্র নজরুল ই তা পরিপূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন ।নজরুলের ব্যক্তিজীবন ও সে রক্তপ্রবাহের জারকরসে পরিপুষ্ট ।নজরুলকে তাই শুধু শিক্ষিত সমাজে আবদ্ধ থাকতে দেখা যায়নি । চটকলের বাঙালি কুলিদের আমন্ত্রণে নজরুলকে তাদের মাঝে কবিতা পড়তে দেখা যায় । নজরুল কে পাওয়া যায় কৃষকের মাঝে বক্তৃতা দিতে ।নজরুল ইসলাম তার সমগ্রতার কারণেই বাঙ্গালীর মহান
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক । শুধুমাত্র বিদ্রোহী শিরোপায় তাকে নামাঙ্কিত করা , পুরো বাঙালী জাতির গৌরবময় সাংস্কৃতিক সূর্যছবিকে আড়াল করার প্রচেষ্টার নামান্তর । আর তাতে ক্ষতি আমাদেরই ।
আমাদের আত্মপরিচয় সন্ধানে , আমদের সংস্কৃতির মূলমর্ম উদঘাটনে নজরুলের কাছে আমাদের ফিরতেই হবে ।
জয় হোক নজরুলের , জয় হোক বাঙ্গালীর ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০২