প্লে-১
মেয়েদের স্কুলে পরলেও প্রাইভেটের কারনে ছেলেদের সাথে ভালই মেশা হতো।আমি প্রেম-বিরোধী হলেও আমার হাসিখুশি মনোভাব,সহজে আপন করে নেয়ার মানসিকতা ছেলেদের কাছে টানত।ছেলেদের সাথে মিশতে কোনকালেই আমার আপত্তি ছিল না।আমাদের পাশের গলির অর্ণব আমার সাথেই প্রাইভেটে যেতো।আমার সাথে কথা বলতে কেমন যেন লজ্জা পেত,চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতো না।এমন সব কাজ করত যা ছিল রীতিমতো হাস্যকর।আমি অবশ্য সবই বুঝতাম।একদিন দেখি আমার ব্যাগে একটা লেখাভর্তি প্যাড...প্রেমের বানীতে ভর্তি।কার কাজ বুঝতে বাকি রইল না।অর্ণবকে অনেক বুঝালাম।তারপরও ও আমাকে রিক্সা করে ঘুরাতো...রহস্যপত্রিকা কিনে দিতো।ওর প্রতি সমবেদনা জানানো ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার।
প্লে-২
এইচএসসি লাইফেও আমার আয়রন-লেডি মানসিকতার জন্য কেউ আমাকে ও পথে ডাকেনি।এরপর ঢাকার একটি স্বনামধন্য মেডিক্যালে ভর্তি হলাম।আমার তরল মানসিকতার জন্য সবার মন জয় করে নিতে বেশি সময় লাগেনি।এরমধ্যে রুশো নামের ধনীর দুলালের মনটা বোধ হয় একটু বেশিই জয় করেছিলাম। সারাটা দিন আমার পিছে পিছে লেগে থাকতো।আমি চাইতাম ওর ভেতর থেকে বন্ধুত্বটা বের করে আনি।কিন্তু ও যেটা করতো সেটা বন্ধুত্বের পর্যায়ে ফেলা যায় না।আমি অন্য বন্ধুদের সাথে কথা বললে মুখ কাল করে বসে থাকতো।একবার ৩দিন জ্বরের জন্য কলেজে না যাওয়ায় ভোর বেলায় আমার বাসায় হাজির হল।বাসায় সবার সামনে এমন সব কথা বলা শুরু করল যে আমি বিব্রতকর অবস্থায় পরে গেলাম।সেদিন ওকে ডেকে ঠাণ্ডামাথায় সব বুঝিয়ে বললাম।
প্লে-৩
থার্ডইয়ারে উঠতেই আরেকপাগলের পাল্লায় পরলাম।ছেলেটা অবশ্য চুপচাপ,আমায় তেমন বিরক্ত করতো না।তবে আমার নোট জোগাড় করে দেয়া,উইকেন্ডে নিজের গাড়িতে বাসায় পৌঁছে দেয়া,কিংবা যে কোন বিপদে ওকেই পাওয়া যেত।ক্লাসের সবাই ভাবতো রনি আমায় পছন্দ করে। রনিও সবার কাছে বলতো যে আমরা ভাল বন্ধু।আমিও ওকে পড়াশুনায় অনেক হেল্প করতাম।একটা সময় ও আমার উপর পুরো নির্ভরশীল হয়ে পরলো।ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারেও আমাকে ডিসিশন দিতে হতো।ও কি রঙের শার্ট কিনবে সেটাও আমাকে ঠিক করে দিতে হবে।তাতেও সমস্যা ছিল না...সমস্যা একটাই,সে আমি ছাড়া কারো সাথে মিশত না।আমি বকা দিলে সারাদিন মুখটা হাঁড়ি বানিয়ে রাখতো।ওর ব্যাপারটা আমি বুঝতাম।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু না বলায় আমিও কিছু বলিনি।এভাবেই চলে যাচ্ছিল।
প্লে-৪
ফোরথ ইয়ারে আমাদের রেসিডেন্সিয়াল ট্রেনিং এর সময় রাফি নামে আরেকজনের আবির্ভাব হল।আমার সাথে মিষ্টি হেসে কথা বলতো কিন্তু আমার সাথে অন্য কেউ কথা বললেই তার যেন মাথায় আগুন ধরে যেত।আমার সামনে কিছুই করতো না।কিন্তু বন্ধুদের সাথে খুব খারাপ ব্যাবহার করতো।
অতঃপর প্রেম
মেডিক্যালে ফোরথ ইয়ার আর ফাইনাল ইয়ার একসাথে ক্লাস করতে হয়।ফাইনাল ইয়ারের ভাইয়ারা খুব এরগেন্ট টাইপের ছিলেন।এর মধ্যে একটা ভাইয়া খুব চুপচাপ টাইপের ছিলেন।দেখেই মনে হয় মানুষটা কিছুটা রিজার্ভ আর বোকা টাইপের।আমাদের ব্যাচের অনেকেই ভাইয়ার সাথে মজা করতো।ভাইয়াদের ফাইনাল প্রফের আগে আমার বাবা স্ট্রোক করে আমাদের হাসপাতালেই ভর্তি হল।ওই ওয়ার্ডে ভাইয়ার ব্লক পোস্টিং ছিল।ভাইয়া বাবার অনেক খোঁজখবর নিতো।ভাইয়া জানতো না যে উনি আমার বাবা।আমার আব্বা-আম্মা দুইজনেই ভাইয়াকে অনেক পছন্দ করতো।হসপিটাল ছাড়ার দুদিন আগে ভাইয়া জানতে পারল আমার বাবা উনি।এরপর আরও ৩-৪ মাস পার হয়ে গেল।
ভাইয়াকে আমি মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে পারলাম না।এই আমি আয়রনলেডি হয়েও নিজের কাছে হার মানতে বাধ্য হলাম।এক ক্লাসমেটের মাধ্যমে ভাইয়াকে প্রপোজ করলাম।ভাইয়া যে মুখের উপর না করে দিবেন তা স্বপ্নেও ভাবিনি।বান্ধবীরা বলল লেগে থাক।ভাইয়া যতদিন কলেজে ছিলেন ততদিন ভাইয়ার পিছু ছাড়িনি।ভাইয়া আমাকে ফিরিয়ে দেবার কিছুদিন পর ফোন নম্বর জোগাড় করে মেসেজ দিতাম।প্রথম দিকে উনি আমার সাথে মিশতেই চাইতেন না।একসময় ফোনে কথা শুরু হল,ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট হতো।কিছুদিন পর একসাথে ঘুরতেও গেলাম।ভেবেছিলাম বরফ বুঝি গলতে শুরু করেছে।কিন্তু এতো ঘনিষ্ঠতার পরও উনি ওনার অবস্থান থেকে একবিন্দু সরে আসেননি।ওনার যদি অন্য কারো সাথে রিলেশন থাকতো তাহলেও নিজেকে শান্তনা দিতাম।আশ্চর্য রকমের নিষ্ঠুর মানুষটাকে কেনো যে ভালবাসতে গেলাম।সবসময় ভাবতাম কারো সাথে প্রেমে জড়াবো না।তাই বলে প্রেমের প্রতি বিন্দুমাত্র কম শ্রদ্ধা ছিল না।প্রেমকে স্বর্গীয়ই ভাবতাম।
কম্বাইন্ড প্লে
ভাইয়ার মনোভাব বুঝতে পেরে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।এতদিন প্রেমের প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা ছিল তা হারিয়ে ফেললাম।এতো ভালোমানুষ থেকে কি হবে।মানুষটাকে ঘৃণা করা শুরু করলাম।সবসময় বুকের মধ্যে চেপে থাকা কান্নাটা দূর করতে সব ছেলের সাথে এমন ভাব করলাম তাদের আমি অনেক ফিল করি।মানুষের ভিড়ে নিজেকে মগ্ন রেখে ওই মায়াবিহীন নিষ্ঠুর মানুষটাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করলাম।আমার সারাটা দিন কেটে যেতো রুশো,রাফি আর রনির সাথেই।মাঝে মাঝে এমন হতো সকালে নাস্তা হতো রনির সাথে,দুপুরে লাঞ্চ রাফির সাথে আর সন্ধার নাস্তা রুশোর সাথে।প্রচণ্ড হতাশায় নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম।সবাই আমাকে খুশি রাখতে চাইতো কিন্তু রাফিটা ছিল বড্ড ছেলেমানুষ।আমাকে সবসময়ই একা পেতে চাইতো।একবার আমি মামার বাসায় বেড়াতে গেলাম।পরের দিন বিকালেই দেখি রাফি হাজির।আধা ঘণ্টা পর রুশো আসাতে রাফি এমন সিন ক্রিয়েট করলো তা আমি কল্পনাও করিনি।আমার জন্য তিনজনের মধ্যেই সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হল।বাধ্য হয়েই নিজেকে সরিয়ে নিলাম।
ভার্চুয়াল প্লে
ইন্টারনির সময়ও এতো ব্যস্ততার মাঝেও পাষাণটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারলাম না।যেই আমি সবাইকে মাতিয়ে রাখতাম সেই আমি নিজের মধ্যেই নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।কারো সঙ্গই ভাল লাগতো না।আস্তে আস্তে রাফি,রুশো রনিও একসময় নিজেকে সরিয়ে নিল।তখন নিজেকে ভার্চুয়াল জগতে নিয়ে গেলাম।ইয়াহু মেসেঞ্জার,ফেসবুক চ্যাটিং এ নতুন বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে লাগালাম।একজন প্লে-বয় যা করে আমি মেয়ে হয়ে তা করতে লাগলাম।প্লে-গার্ল বলতে কোন শব্দ অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে নেই।থাকলে বোধহয় আমাকে প্লে-গার্ল বলা যেতো।মাঝে মাঝে ভাবি...এই আমি এমনতো ছিলাম না।ওই নিষ্ঠুর মানুষটা আমাকে অবজ্ঞা করে এই হৃদয়টা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে।এই একটা মানুষের জন্যই কোন কাজে আগ্রহ পাই না।হতাশা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে।
সত্যিকার প্লে-গার্ল
২ বছর আগে এএমসি পরিক্ষা দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এসেছি।সারাদিন কাজের চাপে নিজেকেই সময় দিতে পারিনা।এখনো বিয়ে করিনি বলে আশেপাশে প্লে-বয়দের ঘুরাঘুরি লেগেই থাকে।আমিও ওদের সময় দেই।নিজেকে তখন যথার্থ প্লে-গার্ল মনে হয়।মাঝে মাঝে প্রবাসী মুরব্বীরা বিয়ে নিয়ে আসেন।আমি শুনে শুধু নীরব হাসি হেসে যাই।এইজীবনে একজনেরই শুধু অধিকার ছিল আমাকে স্পর্শ করার।এই আমাকে স্পর্শ করার অধিকার আমি আর কাউকেই দেব না।
ভাইয়া সাগর খুব ভালবাসে।হয়তো নিজের নাম সাগর বলেই।আমি যে ফ্ল্যাটটায় থাকি তার জানালা দিয়ে সাগর দেখা যায়।প্রতিটা রবিবারে নিজেকে সময় দেবার মত একটু সময় খুজে পাই।ওইদিন দখিনের জানালা খুলে চুল ছেড়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকি।সাগর দেখলেই মনটা আমার ভাল হয়ে যায়...আনমনে হেসে উঠি।যখন আমার চোখগুলো সাগরের নীলদিগন্তে হারিয়ে যায় তখন মনে হয় এই নীলদিগন্ত তো আমার একা দেখার কথা ছিল না...... কি দোষ ছিল আমার জানি না...তবুও মনে হয় মানুষটার কাছে ছুটে যাই।আমার স্মিত হাসিটা ডুকরে কান্নার সাথে মিশে যায়.... অবাধ্য চোখগুলো যে আমার কথা শুনে না...কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে যায়
সাগর এখন আমার কাছ থেকে হাজার মাইল দূরে।ও হয়তো জানেনা আমি কেমন আছি।কিন্তু তাকে আমি সেই প্রথম দিনের মতই ভালবাসি।আমার ভালবাসা নীরব থেকে গেলেও আমার দুঃখ নেই।সাগর তুমি অনেক ভাল থেকো...অনেক...অনেক... আমি যে তোমাকে ভালবাসতেই ভালবাসি...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:০১