ছোটবেলায় আমি স্কুল পালাতাম না। কিন্তু বড় হয়ে আমি ভীষণ স্কুলপালানো ছাত্র হয়ে উঠেছিলাম। বলা যায়, স্কুল পালানো আমার বাতিক হয়ে গেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিওলজির ছাত্র আছিলাম। অবশ্যই অমনোযোগী ছাত্র। পাশ করার পর অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল সব পড়া ভুলে গেছি। মাস্টার্সে মূর্তিতত্ত্ব বা আইকোনোগ্রাফি নিয়ে গবেষণা করেছি। কিন্তু এখন যদি কেউ কোনো মূর্তি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন এটা বোধিসত্ব না মঞ্জুশ্রী, তবে আমি বলতে পারবো না। স্কুল পালানো আর পড়া ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারটা এতদূর পর্যন্ত এসে ঠেকেছে যে, জাদুঘর থেকে দিনদুপুরে এতগুলো মূর্তি নিয়ে গেল, আমি বেদনার্ত হলাম, অথচ কিছু মুখে এলো না আমার। একদিন গিয়ে প্রতিবাদ করলাম না। কোথাও কিছু লিখলাম না। অদ্ভূত!
আর্কিওলজি ও হিস্টরির একজন ছাত্র হিসাবে আমার পাঠ হলো : জাতি হিসাবে প্রিম্যাচিউর অবস্থায় একটি জনগোষ্ঠীর জন্য ইতিহাস দরকার পড়ে না। ইতিহাসের সঙ্গে জাতি, জাতীয়তাবোধ ও জাতগর্বের বিষয়গুলোর সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ট। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ইতিহাস বিষয়টা কেমন এইটা নিয়া আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আমাদের ইতিহাসে আছে একটি সমৃদ্ধ বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতার অস্তিত্ব, এই ধারণা বাংলাদেশের মানুষের কী কাজে লাগে? আজ থেকে দুই হাজার বছর পূর্বেও আমাদের স্পষ্ট ইতিহাস আছে এই তথ্যই বা আমাদের কী কাজে লাগে?
আশপাশের মানুষের যে ইতিহাস বোধ তা থেকে আমার অনুমান এই যে, আমাদের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষেরই ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। অথবা কিছু ধারণা থাকলেও তার বিশাল অংশ ভুলে ভরা। ফলে হিস্ট্রি এখানে বড় জোর ম্যাস হিস্টিরিয়া পর্যন্ত তৈরি করতে পারে। আমাদের ভুল ইতিহাস বোধ দিয়ে আমরা বর্তমানের ভুল বোঝাকে ব্যাখ্যা করতে চাই। ব্যাখ্যা করে ইতিহাসের উপযোগটা নিশ্চিত করতে চাই।
আমাদের জাতীয় জাদুঘরে বোধিসত্ব মূর্তি থাকলে কী হয় আর না থাকলেই বা কী হয়? একজন পর্যটক এইটা দেখতে আসবেন, টিকেট কেটে দেখে বলবেন বাপ রে, এরা আগে কত সভ্য আছিল, এইটাই কি শুধু আমরা চাই? একটা মূর্তি স্রেফ সোনার কোটিং করা বলেই মূল্যবান? আমরা কেন এই মূর্তিকে মূল্যবান বলি আর কেনই বা সেটা রক্ষা করার চেষ্টা করি? আমি যদি ওই মূর্তির ইতিহাসের মধ্যে, আমাদের জনগোষ্ঠীর ক্রমিক বিবর্তনের মধ্যে মূর্তিটিকে দেখতে না পাই তাহলে ওইটা আমার ইতিহাসের মধ্যে থাকলো কি ফ্রান্সে চলে গেল সেটার গুরুত্ব কোথায়?
ফলে, কথা হলো আমরা কি মূর্তিটার জন্যই মূর্তিটাকে রক্ষা করবো নাকি আমাদের ইতিহাসের জন্য সেটা করবো সেই বিচারটা হওয়া দরকার। কেন মূর্তিটা আমার দেশে থাকা দরকার? ব্রিটিশ আমলে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ থেকে ব্রিটিশরা তো অসংখ্য মূর্তি নিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ মিউজিয়াম ভরিয়েছে। সেগুলো নিয়ে কি আমরা কোনো দাবি করেছি আজ পর্যন্ত? না আমরা কোনো দাবি করিনি। বলিনি আমাদের দেশ থেকে গবেষণার নামে তোমরা যা নিয়ে গেছ সেটা স্রেফ ডাকাতি। আমরা তখন বুঝিনি, এখন বুঝতে পারছি, তোমরা আমাদের মাল ফেরত দাও। বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত মূর্তি পাচার হচ্ছে ভারতে। কিছু ধরা পড়ছে, কিছু পড়ছে না। আমরা কি আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে বোঝাতে পেরেছি যে, তেল চাল আর মূর্তি এক জিনিশ নয়? এই জাতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন মহাপরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা অতীতে বহু মূর্তি পাচার ও চুরির সঙ্গে জড়িত। তারা শাস্তি পাননি। তাদের চুরি করা মাল ফেরতও আসেনি। কিন্তু সে বিষয়ে আমরা কত কম কথা বলি, তাই না? ওইসব লোককে আবারও দেশের সম্পদ দেখার জন্য নিয়োগ দেই। ফ্রান্সে মূর্তি নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে সবাই কথা বলছেন তার কারণ কি শুধু এই যে, কিছু সচেতন ব্যক্তি এ নিয়ে মামলা করেছেন, কিছু মানুষ প্রতিবাদ করেছেন আর সরকার ডাকাতের সাগরেদের মতো সম্পদগুলো দিনের আলোয় ডাকাতের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছে? কিন্তু সত্য হলো, অন্তত এইক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো চুরির চেয়ে ঘোরালো উপায় বেছে নেয়া হয়েছে। এটাকে হয় ডাকাতি বলতে হবে নয়তো অন্য কিছু।
আমাদের প্রত্নসম্পদগুলো রক্ষার জন্য আমরা এমন সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছি, যারা রাতের আঁধারেই কাজ করতে পছন্দ করে। কোনো নথি না রেখে রাতের বেলা জাতীয় জাদুঘর থেকে মালসামান সরালে কেউ দেখতো না। দায়ী ব্যক্তিদের টিকিও কেউ ছুঁতে পারতো না। আমি শুধু বিস্মিত এইটা ভেবে যে, বিষয়টা জনসমক্ষে এলো কেমনে? চিরাচরিত উপায়ে চোররা গোপনে কাজটা সেরে ফেললো না কেন?
একথা সত্য ফ্রান্স একটা সন্দেহজনক দেশ। প্রত্ন ও শিল্পবস্তুতে চুরির ক্ষেত্রে তাদের জুড়ি নেই। তারা আমাদের সম্পদগুলো ফেরত নাও দিতে পারে। প্রতারণা করে আমাদের মাল মেরে দিয়ে নকল কিছু ফেরত পাঠাতে পারে। অনেক কিছু ভেঙে ফেলতে পারে। অথবা ফেরতের ধান্দা বাদ দিয়ে কর্তাদের দুচার পয়সা ধরিয়ে দিয়ে, ফ্রান্সে ঘুরিয়ে ঘারিয়ে স্রেফ বাড়ি যা বলতে পারে। অথবা, আমাদের প্রতিবাদ, কোর্টের আদেশ সব মিলিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক ফিরেও আসতে পারে। কিন্তু এসে কাদের হাতে পড়বে? ওই চোর, ডাকাতদের সহযোগীদের হাতেই তো। তারাই রক্ষণাবেক্ষণ করবে এই সম্পদ। এই অভিজ্ঞতা যদি কাজে লাগায় তারা তবে আর কোনোদিনই প্রকাশ্যে কিছু বিদেশে পাঠানোর রিস্ক তারা নেবে না। জাদুঘরের বাকী জিনিশগুলো এদের হাতে কি ঠিক থাকবে? এদের চুরিধারির কি কোনো বিচার হবে? জিনিশ চোরের সাগরেদদের কাছে থাকা আর চোরের বাড়িতে থাকার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু?
তার মানে এই নয় যে, জাদুঘরের সবাই চোর। আর এদের গণহারে বিদায় করে জাদুঘর রক্ষা করতে হবে। এইসব ক্ষেত্রে চোর থাকে মাথায়। বড় আমলা, মিনিস্টার, সচিব, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। যারা আমাদের জাতির মাথা হিসাবে পরিচিত। বুদ্ধিজীবী খ্যাতি নিয়ে বুদ্ধি দাবড়িয়ে বেড়ান, যারা এই পাচার ও অন্য পাচারগুলোর পক্ষে ওকালতি করেন, সেইসব নাম সামনে আসা জরুরি। দূতাবাসে দূতাবাসে যারা মদ খেয়ে বেড়ান, বহু দেশ সফর করে যারা চুল পাকিয়ে ফেলেন আর নিজেদের স্বার্থে যে কোনো চুরিচামারির পক্ষে ওকালতি করেন তাদের নামগুলো জানতে হবে। আর এইটুকুও মনে রাখতে হবে, আমাদের মূল্যবান সম্পদ যারা কোনো সেফটি নিশ্চিত না করে যেনতেনভাবে বিদেশে পাঠাতে পারে সেই কর্তৃপক্ষের হাতে জাতীয় ভাগ্যের ভবিষ্যত কী হতে পারে।
ফ্রান্সকে আমরা সন্দেহ করি। কিন্তু, এই দেশটিই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নস্থানে খনন ও গবেষণা পরিচালনা করছে ১৯৯৩ সাল থেকে। মহাস্থানগড় থেকে তারা কত প্রত্নসম্পদ ইতিমধ্যে সাবাড় করেছে তার হদিস আমাদের কাছে নেই। তাদের সঙ্গে কোন চুক্তির ফলে তারা নিশ্চিন্তে কোনো জবাবদিহিতা ছাড়া আমাদের প্রত্নস্থানে কাজ করছে তারও কোনো খোঁজ আমরা রাখি না। তাদের সঙ্গে চুক্তি কারা করেছে আর চুক্তিতে কী লেখা আছে তাও আমরা জানি না। সো, জানতে হবে। আর বুঝতে হবে। সমস্যার আগায় না গিয়ে গোড়া কাটতে হবে।
আর একটা কথা। আমাদের জাদুঘরগুলোতে প্রত্নবস্তুগুলো কত অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকে তা যদি কেউ দেখতেন তবে ফ্রান্সে যাওয়ার পক্ষে ছোটখাট মৌনমিছিল করার অপরাধে দুই বছরের জেল পেতেন। জাদুঘরগুলোতে না হয় গবেষণা না না হয় সংরক্ষণ। কেউ গবেষণা করতে চাইলে পর্যাপ্ত সহযোগিতাও আসে না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফরতর আর জাতীয় জাদুঘরে প্রত্নতত্ব জানা লোকেরই বিশেষ অভাব আছে। ফলে, মূর্তি ফিরলেও তা মূর্তিই থেকে যাবে। তাতে প্রাণের সঞ্চার হবে না। আর সে মূর্তি আমাদের ইতিহাসে কিংবা জাতীয় জীবনে কোনো প্রাণের সঞ্চার করতে পারবে না।