“ সে দিন আমি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় উত্তরদিকে মুখ করে চেয়ারে বসেছিলাম । হঠাৎ তাকিয়ে দেখলাম উত্তরের আকাশ চিরে দুই ভাগ হয়ে গেল। সে ফাক দিয়ে বেরিয়ে এল আগুন। সারা উত্তর দিকের আকাশের পুরোটা জুড়ে আগুন আর আগুন। তা থেকে আসছিল প্রচন্ড তাপ। মনে হল আমার গায়ের শার্টে আগুন লেগে গেছে। খুলে ফেলতে চাইলাম শার্ট। এ সময় এল প্রচন্ড শব্দ। ছিটকে পড়লাম চেয়ার থেকে কয়েক মিটার দূরে। গরম বাতাসের হলকা ঘিরে ধরল এলাকাকে। কেপে উঠল মাটি। কিছুক্ষন জ্ঞানহীন পড়ে রইলাম মাটির উপরে , মনে হচ্ছিল ছিটকে আসা পাথরের চাই মুহুর্তে এসে পিষে দেবে আমাকে। কিছুক্ষন পর আবিস্কার করলাম বেচে আছি, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষেত খামারের ফসল,এলাকার অনেক বাড়ীঘরদোরের চুর্নবিচুর্ন কাচের জানালা, ছাদ ইত্যাদি”
“ তখন আমি আর আমার ভাই চেকরান নদী তীরে আমাদের কুঁড়েঘরে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ দুজনেরই একি সাথে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে আমাদের ঘুম থেকে তুলে দিল। বাহিরে তিক্ষ্ম শীষের মত শব্দ হচ্ছিল এবং প্রচণ্ড বাতাস সাথে পাখীদের চিৎকার ও উড়ে যাওয়ার শব্দ। আমরা কেউই ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ তীব্র তাপ অনুভব করি,মনে হচ্ছিল আগুনের মধ্যে পড়ে গেছি। বাহিরে গাছ উপড়ে পড়ার শব্দ হচ্ছিল। আমি আর চেকরান স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসলাম নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল, ভূমি কাঁপতে শুরু করলো। পাথরে পাথরে বাড়ি খাওয়ার শব্দ হচ্ছিল। প্রচণ্ড বাতাস আমাদের ঘর ফেলে দিল এবং আমরা বাঁশ এবং কাঠের মধ্যে আঁটকে গেলাম। দেখতে পেলাম গাছগুলো উপড়ে পড়ছিল আর তাদের শাখাপ্রশাখা আগুনে জ্বলছিল। তখনও আকাশ রৌদ্রজ্জ্বল এবং মেঘমুক্ত ছিল, সূর্যও দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে আরেকটি সূর্যের উদয় হল। তীব্র আলোর ঝলক দেখা গেল এবং এর সাথে প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল। সাথে সাথে বাতাসের বেগ বৃদ্ধি পেল অনেক গুন। বাতাস আমাদের দুজনকে উড়িয়ে নিয়ে ভূপাতিত গাছগুলোর উপর আছড়ে ফেলল। গাছগুলোর শীর্ষভাগ কর্তিত অবস্থায় ছিল যেন কেউ কেটে ফেলেছে গাছগুলোর মাথা। চেরকানের চিৎকার শুনে আমি ওর আঙুল দিয়ে নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে আরও একটি আলোর ঝলক। আবার প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত এবং বাতাস। তবে এটি পূর্বের চেয়ে কম শক্তির ছিল।আমি মনে করতে পারি জ্ঞান হারানোর পূর্বে আরেকটি বজ্রপাতের শব্দ শুনেছিলাম, তবে তা সাধারণ বজ্রপাতের মতোই ছিল। “
উপরের ঘটনার বর্ণনা পড়ে কি মনে হচ্ছে? কোন সাইন্স ফিকসান গল্প বা হলিউড এ তৈরি কোন সাইন্স ফিকসান মুভির প্লট? Deep Impact বা Armageddon মুভির মত কোন মুভির অংশ বিশেষের বর্ণনা? না, তা নয়। এটি পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া একটি বিস্ফোরণের বিস্ফোরনস্থলের আশেপাশের এলাকার ২ জন অধিবাসীর বর্ণনা। প্রথমটি বিস্ফোরণস্থলের ৪০ মাইল দক্ষিনে সেমেনভ ( S. Semenov) নামক লোকের এবং ২য় টি Shanyagir উপজাতির চুচান এবং তার ভাই চেরকান এর চাক্ষুষ ঘটনার বর্ণনা। বিস্ফোরণটি ঘটেছিল ১৯০৮ সালের ৩০ জুন সকাল ৭:১৭ মিনিটে( গ্রিনিচ সময় ০:১৭) রাশিয়ার সাইবেরিয়ার বৈকাল হ্রদের উত্তর-পশ্চিমের দুর্গম পার্বত্য এলাকা টাঙ্গুস্কা নদীর কাছে । রাশিয়ার সাইবেরিয়ার এ এলাকায় জনবসতি নেই বললেই চলে।ধারণা করা হয় যে ঐ স্থানের সমুদ্র সমতল থেকে ৫-১০ কিমি উপরে বায়ুমণ্ডলে মহাশূন্য থেকে আগত কোন বৃহৎ উল্কা বা ধূমকেতুর সাথে বায়ুর সংঘর্ষের ফলেই এই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি কারনে বা কিভাবে এই প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা আজও রহস্যে ঘেরা। এটি এখন পর্যন্ত ভূপৃষ্ঠে বা ভূপৃষ্ঠের উপরস্থিত বায়ুমণ্ডলে ঘটা সবচেয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণ। যদিও এই বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল বায়ুমণ্ডলে ছিল কিন্তু ভূপৃষ্ঠে এর প্রভাব কম ছিলনা। এই বিস্ফোরনের শক্তি ছিল হিরোশিমার পারমানবিক বোমার চেয়ে ১০০০ গুন বেশী শক্তি শালী। এ বিস্ফোরন ঐ স্থানের আশেপাশের ২১৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে আনুমানিক ৮ কোটি গাছকে মাটির সাথে শুইয়ে দিয়েছিল। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট শক ওয়েভের প্রভাবে রিখটার স্কেলে ৫.০ মাত্রার ভূকম্পন হয়েছিল যা একটি শহর ধবংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এই ঘটনার পর অনেক বিজ্ঞানী এবং গবেষক এর কারন খুজে বের করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আর এই ঘটনাটি আজও এক রহস্যাবৃত ঘটনা হিসেবে রয়ে গেছে যার নাম দেয়া হয়েছে টাঙ্গুস্কা বিস্ফোরণ বা Tunguska Event।
ঐ স্থানের আশেপাশের অধিবাসীদের ভাষ্য অনুযায়ী প্রথমে তারা আকাশে একটি সূর্যের মত উজ্জ্বল নীলাভ আলোর রেখা ছুটে যেতে দেখে । এর ১০ মিনিট পর ঐ স্থানটিতে উজ্জ্বল আলোক শিখা দেখতে পায় এবং এর সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। শব্দের তীব্রতা (শক ওয়েভ) এতই ছিল যে তা ঐ স্থান থেকে ৩০০ কিমি দূরের মানুষকেও শক ওয়েভের ধাক্কায় ফেলে দিয়েছিল। বাড়ি ঘরের সব জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছিল। প্রচন্ড শব্দে চিরতরে শ্রবনশক্তি হারিয়েছিল পশু চারনকারীরা। ঘটনাস্থল থেকে ৪০০ মাইল দূরে কানস্ক( Kansk) শহরে চলন্ত ট্রেন কেপে উঠে থেমে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল গোটা ট্রেনটাই ছিটকে পড়বে রেললাইন থেকে। সীট থেকে আছড়ে পড়েছিল যাত্রীরা। বিস্ফোরনে পুড়ে যাওয়ার পর কয়েকদিন ধরে ঐ স্থানে কালো ছাইয়ের বৃস্টি হয়েছিল। ১০,০০০ কিলোমিটার দূরে লন্ডনে বায়ুমন্ডলের চাপের তারতম্য ধরা পড়েছিল । ঐ ঘটনার পরের কয়েকদিন এশিয়া এবং ইউরোপের রাতের আকাশ অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল ছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসের এত বড় একটি ঘটনা অনেকটাই উপেক্ষিত ছিল এতদিন। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদির ভিড়ে টাঙ্গুস্কা ঘটনাটি চাপা পড়েছিল। ১৯২১ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ মিউজিয়ামের উল্কা সংগ্রহের প্রধান কিউরেটর ভ্লাদিমির কুলিকের নেতৃত্বে প্রথম বৈজ্ঞানিক অভিযান হল টাঙ্গুস্কায়। সাইবেরিয়ার চরম বৈরী আবহাওয়ায় তার দল সেবার ঘটনাস্থল কেন্দ্রে পৌছাতে পারে নি।.১৯২৭ সালে দ্বিতীয়বার অভিযানে এলেন কুলিক। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে কুলিক দেখলেন মাইলের পর মাইল জুড়ে ধ্বংশযজ্ঞ। দৈত্যাকৃতি প্রজাপতির আকারের ৮০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ধ্বংশপ্রাপ্ত বনজঙ্গল। আশ্চর্যের বিষয় হল উল্কাপিন্ডের আঘাতে সৃস্ট কোন গর্ত খুজে পেলেন না কুলিক। কেন্দ্র স্থল থেকে উল্টো দিকে উপড়ে পড়েছে পুড়ে যাওয়া গাছপালা। কিন্তু কেন্দ্রে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে ডালপালাহীন বাকল ছিলে নেওয়া গাছগুলো। হিরোশিমার পারমানবিক বিস্ফোরনের পর একই ধরনের ডালপালা খসে পড়া, বাকল ছিলে যাওয়া লক্ষ করেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৩৮ সালে বিমান থেকে এ এলাকার জরীপ করা হয়। এরপর আরো তিনবার এ এলাকায় অভিযান চালান কুলিক। কিন্তু বিস্ফোরনের আঘাতের চিহ্নস্বরুপ কোন গর্ত খুজে পাওয়া যায় নি। ১০ থেকে ৩০ মিটার মাপের বিভিন্ন আকৃতির গর্ত পান কুলিক কিন্তু সে গুলো আঘাতের ফলে সৃস্ট নয়।