পৃথিবীর সব পথের শেষে নক্ষত্রের ঐ নিরালোকে তাকিয়ে তিমিরবিলাশী নৈঃশব্দ্যেকে পেয়েছিলাম । সেই তামসী নৈঃশব্দ্যের মাঝে কি শুধুই শুন্যতার বসবাস? সেই শুন্যতা যা রয়েছে সব সৃষ্টির মুলে ও বহিঃপ্রকাশে । যেভাবে বিন্দু থেকে জন্ম হয়েছে রেখার । পরিধীরেখা যেভাবে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে তৃতীয় মাত্রায় পরিনত হয়েছে গোলকে । সেই গোলকই হয়তো মানুষের দৃশ্য, শ্রব্য, স্পর্শ কিংবা আস্বাদ চেতনার বোধ পেরিয়ে পরিনত হয়েছে অযাচিত কোন এক আদলে । এভাবেই কোন এক কল্পনার রঙে এবং রুপান্তরে পৃথিবীতে এই গল্পের মুল চরিত্র ‘কনিকা’র আবির্ভাব ।
নিজেকে নিজের অন্তরালে খুঁজার এক সচেষ্ট প্রয়াসে কনিকা নিজের মাঝে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে খুঁজে পেয়েছিল । তারা দুজনে এমন যেন একে অন্যের প্রতিবিম্বের সামনে নিজের প্রতিরুপ । কনিকার কোন বয়োবন্ধনী ছিল না । ছিল না কোন বস্তুগত বা দেহজ প্রবৃদ্ধি । তবে সময়ের অস্তিত্ব বিষয়ক একটা সমক্য ধারনা তার ছিল । প্রয়াত ও আগতের কালীক পার্থক্য বোঝার মত প্রভেদবোধও তার ছিল । কিছু সময় গত হলে এক প্রকার বিচ্ছিন্নতা বোধে সে আক্রান্ত হয় । বিছিন্নতা বোধ থেকে আসে নিঃসঙ্গতা । পৃথিবীতে তার নিজের অবস্থান ও নিজশ্ব নিশ্চলতা থেকে এই বিচ্ছিন্নতা বোধের সৃষ্টি । কনিকা তখন গতিশীলতার প্রতি প্রণোদিত হয়ে অবস্থান পরিবর্তনে মনস্থির করলো ।
প্রথমে কিছুটা ধীরে সযতনে, এরপর কিছুটা বেগ বাড়িয়ে চলতে থাকে সরলপথে । তারপর আপ-ডাউন, টপ টু বটম -ক্রমেই সে ছন্দকাতর হয়ে পড়ে । পথ চলার এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্য দূরত্বের প্রতিটি অংশ কনিকার নিজশ্ব কোরিওগ্রাফ । প্রতিবারই একই পথে প্রবল উচ্ছাসের সাথে তার অবিশ্রান্ত পথ চলা । যেন নিপুন এক ব্যালেরিনা নির্ভুলভাবে দুই পায়ের শীর্ষে পৃথিবীকে ছুঁয়ে মনমুগ্ধকর নাচের ভঙ্গীমায় নেচে যাচ্ছে । হয়তো কনিকা তার ব্যক্তিগত পৃথিবীর এই নৃত্যনাট্যেমঞ্চে উদ্দেশ্যহীন ভাবে নেচে যাচ্ছে, অদ্ভুত রিদমিক কোন ওয়াল্টজ । সোল্লাসে চিতকার করে উঠলো কনিকা এই নৈঃশব্দ্যের পাঠশালায় –
‘দেখো, দেখো আমার চলছন্দ, আমার সঞ্চরনের গতিপথ’ ।
সুনশান নিরবতায় কনিকার উচ্চরব শুধুই প্রতিধ্বনিত হয় । কোন প্রত্যুত্তর নেই, নেই কোন প্রতিক্রিয়া । সে চারদিকে চেয়ে দেখে আবার চেঁচিয়ে বলে উঠে
‘আই ক্যান ডু বেটার দ্যান দিস, আই বেট আই ক্যান চেস পারফেকশন, আই ক্যান ক্যাচ এক্সিলেন্স’ ।
নিজের চিতকারের অপসৃয়মান প্রতিধ্বনির মাঝেই আরবার, বারবার সে প্রতিক্ষায় থেকে প্রত্যুত্তরের । বিড়বিড় করে বলে সে
‘কেউ কি আছে’ ।
একবার হঠাত সে সত্যি বিস্মিত হলো । অনেক অনেক আগের অতীতে প্রথম বার বর্তমানকে উপলব্ধির অনুভব যেন আবার ফিরে এল যখন সে সময়, গতি আর পৃথিবীর সাথে তার সম্পর্কের স্বরুপ উদঘাটন করেছে । তার দৃষ্টিপটে এক পলকা তিমিরের ঝলক দিয়ে যায় । অবিশ্বাসের আর সংশয় দোলাচালে কৌতুহলের কাছে ভীতিকে পরাজিত করে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায় চোখের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা অজানার খোঁজে । হঠাত সেই বহু আকাঙ্খিত একটা শব্দ, একটা খিলখিল হাসির আওয়াজ ভেষে আসে, অনুরণিত হয় । নিকষকালো অন্ধকারের ভিতরে ডুবে থাকা আবছায়া একটা অবয়ব, এক বিন্দু তিমিরের আরক্তিম অস্তিত্ব পরিস্ফুট হয়, চঞ্চল রোমশ উচ্ছ্বাসে । এক বিন্দু তিমিরের ঝিলিক, ধোঁয়াসা, ইরিবাসের মত মেঘান্ধকার -বিজয়দীপ্ত কণিকার খুব কাছেই এতদিনের পলাতকা রহস্য ।
‘তুমিই তাহলে সেই, অবশেষে তুমি সত্যি আজ আমার পাশে’
‘এখানে কোথায়’
‘যেখানে আমারা ঠিক এই মুহুর্তে দাড়িয়ে আছি, সেখানে’
‘আচ্ছা’...‘তুমি কে’
‘আমি আমিই, আর তুমিই তুমি, এছাড়া আমরা কি অন্য কিছু হতে পারি’......
মুখে সন্দেহের রেখা ফুটি উঠে তিমিরের ঝিলিকের-‘আমি ঠিক জানি না, মনে হয় তুমিই সঠিক’
একটা অদ্ভুত আভা নিঃসরিত হয়, তিমিরের দিকে । তিমিরের চারদিকে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে বলে উঠে কনিকা-‘এটা ভুল নাকি সঠিক তা এখানে গুরুত্বপুর্ন নয়, ’ ।
‘তবে...’
‘ইটস অল অ্যাবাউট আস, এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কিছু কি আছে, আমরা এখানে চিরকাল থাকবো’
‘চিরকাল?......’
‘হুম...চিরকাল’
কনিকার কন্ঠস্বর অনুসরন করে তিমির, একটা ব্যবর্তন বলয়ে । দুজনের তাল, লয়, স্পন্দন ক্রমশ কাছাকাছি হয়ে আসে । শীতল কোমল তিমির ছন্দ-ভাঙা স্তব্ধতায় স্পর্শ ক'রে কনিকাকে । তিমিরের অনচ্ছতা থেকে হঠাতই একটা ছোট্ট ফোঁটা রাত্রিদেবী নক্সের মত অভিকর্ষমুখে ঝরে পড়ে । এরপর প্রথমে কিছুটা ধীরে সযতনে, এরপর কিছুটা বেগ বাড়িয়ে চলতে থাকে সরলপথে । তারপর আপ-ডাউন, টপ টু বটম -ক্রমেই সে ছন্দকাতর হয়ে পড়ে । কনিকার আর তিমিরের হাসির অনুরনন বারেবারে ফিরে আসে ।
‘তুমি এত ক্ষুদ্রাকায় কেন?’
আত্মতৃপ্তির হাসিতে কনিকার প্রত্তুতর ‘আমার এই ক্ষীনকায়তা প্রাতিভাসিক’
‘দেখাও আমাকে’
শামুকের মত সযত্ন সতর্কতায় তিমিরের থেকে কিছুটা পিছিয়ে আর গুটিয়ে এলো কনিকা । এরপর মনে পড়লো নিজেকে নিজের অন্তরালে খোঁজার প্রয়াসে কনিকা নিজের মাঝে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে খুঁজে পেয়েছিল । কনিকারা তখন সব এক হয়ে একটা যুগ্ন অবস্থানে এসে নিজের পরিমেয়তাকে বিলিন করে অপরিমেতার এক জ্যোতির্ময় কুজঝটিকাতে পরিনত হল । অনিশ্চয়তা আর অনির্দিষ্টতা থেকে সৃষ্টি হলো আলো । এতটাই বিভা ছড়িয়েছিল আলো যেন পৃথিবীর বুকে তার মহিমান্বিত পুনঃ আবির্ভাব হলো ।
তিমিরের কুয়াশার দর্শনানুভুতি পৃথিবীত প্রথমবারের মত জ্যোতির্ময় ঝিলিকের উপস্থিতি উপলব্ধি করলো । তিমিরের কুয়াশা প্রথমবারের মত অনুভব করলো এক আশ্চর্য সৌন্দর্য । অজশ্র ছোট্ট ফোঁটা অভিকর্ষমুখে ঝরে পড়ে । এরপর প্রত্যেকে কিছুটা ধীরে সযতনে, তারপর কিছুটা বেগ বাড়িয়ে চলতে থাকে সরলছন্দিতপথে । ছড়িয়ে যায় পৃথিবীর সর্বত্র । কনিকার আর তিমিরের হাসির অনুরনন বারেবারে ফিরে আসতে থাকে । অবাক বিস্ময়ের একটা শিহরন ছড়িয়ে আলো আর আঁধার মিলে সৃষ্টি হলো বোধ । সৃষ্টি হয় জীবনের নতুন হরাইজন । সময়ের সাথে সাথে প্রতিটি ফোঁটা থেকে আরেকটি তারকাখচিত আকাশে নতুন পৃথিবীর সৃষ্টির অপেক্ষা ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৩ সকাল ১১:৩২