somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবু বকরের মৃত্যুর স্ট্যাটিসটিকাল পোস্টমর্টেম

২৫ শে মার্চ, ২০১০ দুপুর ২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
আবু বকরের মৃত্যুর খবরটি আমি দেখি ব্লগে, রাতে খাবার পর ব্লগ খুলে প্রথম পাতার পোস্টগুলোর শিরোনাম দেখছিলাম, সেখানেই এক বা একাধিক পোস্ট ছিলো ঢাবি'র "মেধাবী" ছাত্রের মৃত্যুর খবর নিয়ে। নিজের ক্ষুদ্রতা স্বীকার করেই শিরোনাম দেখে কি মনে হলো সেটা বলি। "ছাত্রলীগের তান্ডব"ই যেহেতু কারণ, তাই ভিকটিমের নামের আগে ঐ শিরোনামগুলোতে যখন "মেধাবী" শব্দটির ব্যবহার দেখলাম, ভেবে ফেললাম যে ছাত্র নিহত হলেই তো "মেধাবী" হয়ে যায় এদেশে, এটাও নিশ্চয়ই তাই হবে। স্বভাবগত স্কেপটিসিজমের কারণেই কৌতুহল হলো, পোস্টের ভেতরে ঢুকে জানা গেলো ইসলামিক ইতিহাস বিভাগের প্রথম বিভাগ দ্বিতীয় বা তৃতীয় রেজাল্টের অধিকারী নিহত আবু বকর। বোঝা গেলো, নাহ, এই ভিকটিম "সত্যিকারের মেধাবী"। মনের পঙ্কিলতাকে আরেকটু স্বীকার করে নিই। প্রথম বিভাগ দ্বিতীয় বা তৃতীয় ছাত্র -- তথ্যটা মাথায় ঢোকার পর নিহত আবু বকরের জন্য বাড়তি কষ্ট অনুভব করলেও একই সাথে এটা মনে করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারিনি যে, 'এমন মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু তো একটা "রাজনৈতিক ইস্যু"তে পরিণত হবে!।'

ব্লগের সবকিছু পড়ে তখন কেন জানি মনে হলো, "আহারে, বাবা-মা কত আশা করে ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠায়!" তখনও জানা যায়নি আবুবকরের পিতা-মাতা হতদরিদ্র, তাও মাথায় ভেসে উঠলো সহজ-সরল এক গ্রাম্য মা-বাবার চেহারা, যারা খুব আশা করে ছেলেকে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছেন, দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত শিক্ষাঙ্গনে পাঠিয়েছেন। আমি জ্যোতিষী নই, তাও রাজনৈতিক ইস্যুর প্রভাবে মনের সংকীর্ণতা চাড়া দিলো, ভাবলাম, "এই ছেলে যদি মাঝে মাঝে পেপারে যে দেখি সেরকম হতদরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলে হয়, তাহলেতো বাড়তি সহানুভূতিতে ইস্যুটা আরো জোরেসোরে চাড়া দেবে!" কল্পনাও করিনি যে পরদিন সকালে আসলেই পত্রিকায় দেখতে পাবো যে আবু বকরের বাবা একজন হতদরিদ্র দিনমজুর! তখন অবশ্য আর মনের সংকীর্ণতাকে পাত্তা দেইনি, ভীষন কষ;ট লাগলো, মনে হলো, "আল্লাহ, এই দরিদ্র পরিবারটির বাবা-মা দু'জন হয়তো সারাজীবনের কষ্ট শেষে তোমার প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায় মগ্ন থেকে অপেক্ষা করছিলো অভাবের দিন শেষ হবে বলে। এদের সন্তানটিকেই তোমার বেছে নিতে হলো?"

ভাগ্য জিনিসটাকে ভীষন নিষ্ঠুর মনে হলো!

কিছুদিন পর আবারও পত্রিকার শিরোনাম হলো আবু বকর, মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে যখন মূলতঃ তার কথা কাছের লোকজন ছাড়া বাকী সবার ভুলে টুলে যাবার কথা তখনই। জানা গেলো, আবু বকর ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছে, সম্ভবতঃ বেঁচে থাকলে আর কিছুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সে নিয়োগ পেতো। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিলো, ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, আল্লাহর কিরকম লীলাখেলা।


২.

মানতে পারলাম না, বারবার মনে হলো এত কাকতালীয় কিভাবে হয় একটা ঘটনা?
একজন প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় ছাত্র কিভাবে মারা যায়? এদের তো সেভাবে "ক্যাডারগিরি"তে জড়িত থাকার কথা না!
তার ওপর, তাকেই কেনো হতে হবে একেবারে হতদরিদ্র দিনমজুরের মেধাবী ছেলে?
তারও ওপর, তাকেই কেনো সবাইকে কাঁদিয়ে মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ফলাফলে দ্বিতীয় থেকে প্রথম হতে হবে?

এতসব কাকতাল একসাথে এই আবু বকরের বেলায় এসে জড়ো হয়েছে কেন? এটা কি কোন অভিশাপ? এটা কি শেখ হাসিনার সরকারের উপর কোন অশুভ ইংগিত?

অনেক আবোল তাবোল চিন্তা মাথায় আসতে লাগলো। আবু বকরের মৃত্যু নিয়ে স্ট্যাটিসটিকাল পোস্টমর্টেমের শুরুটাও ঠিক তখন থেকেই। (তেমন আহামরী কোন পোস্টমর্টেম না, সবাই হয়তো এমনিই টের পেয়ে গেছেন।)

পরিসংখ্যান নিয়ে খুব সহজমাত্রার একটা হিসেব করলাম। টপ লেভেলের মেধাবী ছাত্র, হতদরিদ্র বাবা-মা, মৃত্যুর পর আরো ভালো রেজাল্ট -- এই তিনটা কাকতালের সম্ভাবনা যাচাই করলাম (এটা একেবারেই নিজের মনগড়া কিছু সংখ্যা দিয়ে করা হিসেব, আসল হিসেব হয়তো এর চেয়ে অনেক আলাদা হবে)

ক. আবু বকরের মতো রেজাল্ট হবার সম্ভাবনা একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের কতটুকু? ধরি ৫% বা ২০ ভাগের এক ভাগ (১/২০)।

খ. এরকম একজন মেধাবী ছাত্রের একটি হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসার সম্ভাবনা কতটুকু? বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের অভিভাবকদেরকে তাঁদের আয়ের হিসেবে দশটি ক্যাটাগরীতে ভাগ করা যায় ধরলাম। তাহলে, এ সম্ভাবনা ১০% বা ১০ ভাগের এক ভাগ (১/১০)।

গ. সেকেন্ড থেকে শেষ পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার সম্ভাবনাকে ধরলাম ৫০% বা ২ ভাগের এক ভাগ (১/২)।

তাহলে উপরের (১/২০ * ১/১০ * ১/২) হিসেব করে পাই, নিহত একজন ছাত্রের আবু বকরের মতো এতো কাকতালসমৃদ্ধ হবার সম্ভাবনা ৪০০ ভাগের একভাগ।

এই পরিসংখ্যানের বক্তব্যটি খুব কঠোর! এর মানে হলো,
এ দেশে ৪০০ জন ছাত্র নিহত হলে এর মধ্যে ১ জন আবুবকর থাকা বিচিত্র না।

আবু বকরের মৃত্যুটা আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেলো যে আসলেই আমরা অনেক ছাত্রকে মরতে দিয়ে ফেলেছি, ছাত্ররাজনীতির নামে অসুস্থ একটা সিস্টেমকে নির্বিবাদে দাঁড়াতে দিয়ে। কারণ, হিসেবটা করার পরই মনে হলো, এ দেশে কি এখনও ৪০০ জন ছাত্র ছাত্ররাজনীতির বলি হয়নি? রগ কাটা, ড্যাগার বসিয়ে দেয়া, বোম ফাটানো, আগুন লাগানো, কাটা রাইফেল, চাইনীজ কুড়াল -- এসবের নানাবিধ ব্যবহারে কি এদেশে এখনও ৪০০ ছাত্র মরেনি? মরেছে আরো অনেক বেশী! আবু বকরের মৃত্যুর পরদিনই রাজশাহীতে মারা গেলো ফারুক, জামাত শিবিরের প্রত্যক্ষ আক্রমনে। তার দু'দিন পরে চট্টগ্রামে মারা গেলো আরেকজন, এর মধ্যে আরো হয়তো খুন হয়েছে। ইদানিং তো এসব খবরই পড়িনা, পালিয়ে বেড়াই!

মেনে নিতে হলো যে, আবু বকরের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিলো, আমরাই দায়ী, এই অবশ্যম্ভাব্যতা আমাদের তৈরী। ছাত্র রাজনীতির নামে অস্ত্রভিত্তিক পান্ডামী আর অসভ্যতামীই এ ধরনের মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। আজ হোক কাল হোক, আবু বকরের মতো এরকম হতদরিদ্র পরিবারের একজন মেধাবী ছাত্র নিহত হয়ে বাবা-মা, ভাইবোনকে সারা জীবনের জন্য আর খবর পড়া মানুষকে কিছু সময়ের জন্য কাঁদিয়ে যেতোই।

বোঝা গেলো, বিধাতার কাছে অভিযোগ করে, বা কাকতাল খুঁজে কোন লাভ নেই। আমরা নিজেরাই কাকতাল তৈরী করি!

শেষকথা:
মন্ত্রী-মিনিস্টার-এমপি টাইপের রাজারাজড়ারা আর তাঁহাদের ছেলেমেয়েরা হয়তো সাধারণ প্রজাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননা, বা ঐ এলাকা দিয়ে তেমন চলাফেরা করেননা; তাই হয়তো তেনাদের বেলায় সংখ্যাটা ১/৪০০ এর চেয়ে অনেক কম, ধরেন সেটা ১/৫০০০। তারপরও, তারা যেভাবে ছাত্রদের ব্যবহার করছেন এবং করেই যাবেন এমন ভাবই দেখিয়ে যাচ্ছেন, তাতে জানায়া রাখা প্রয়োজন যে সময় আসলে পরিসংখ্যান কিন্তু কাউকে ছাড়বেনা।
২৬টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরাধের সেকাল ও একাল

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

সেকাল
--------------------------------------------------------
স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা হেনরি বেভারিজ ছিলেন বৃটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য৷বেভারিজ ১৮৭০ সালের মার্চ হতে ১৮৭১ সালের মার্চ এবং ১৮৭১ সালের জুন থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×