somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃক্ষের মানুষ হতে চাওয়া

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বন্ধুবান্ধব সহকর্মী মোটামুটি সবাই জানে
দাঁড়াতেই বেশি পছন্দ আমার।
চেয়ার ছেড়ে কখন যে দাঁড়িয়ে যাই
নিজেই টের পাই না!
আমাকে ঘন ঘন দাঁড়াতে দেখে
এক-আধজন আড় চোখে তাকায় বটে,
তবে অতোটা আমলে নেয় না।
হয়তো ভাবে আমি একটু অধৈর্য প্রকৃতির
কিম্বা আমার মধ্যে কোনো অস্থিরতা কাজ করছে।
স্থান-কাল বিস্মৃত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া
লোকের চোখে বেখাপ্পা ঠেকতে পারে-
একথাটি মনেই রাখতে পারি না।
স্মৃতিতিশক্তি যে নেহাত দুর্বল তাও কিন্তু নয়।
আমলে ব্যাপার হলো কি--
দাঁড়ানোটা মোটেই সংবরণ করতে পারি না আমি;
এটি আমার জিনোমেই সেঁটে দেয়া!
তাই
ত্রিভঙ্গ হয়ে চেয়ারে, সোফায় বা বেঞ্চিতে বসে
কখনোই স্বস্তি পাই না। কেমন উসখুস লাগে।
হাঁটু মুড়ে বা আসন-পীড়ি হয়ে বসতে গেলে তো
পড়েই যাই চিৎপাত হয়ে! পপাত ধরনীতল!
শুলে কেবলই মনে হয়,
আমার সুর্যমুখী শিরদাঁড়ার কশেরুকাগুলো
নিঃশব্দ বিদ্রোহে উচাটন করে।

আসলে আমি ছিলাম শালবন বৌদ্ধবিহারের
পাশে একটা দীর্ঘকায় শালগাছ,
ঋজু, সটান! বেশ বয়েস হয়ে গিয়েছিলো।
দীর্ঘদিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে
খিল ধরে গিয়েছিলো পায়ে।
বাতাসের কার্বন শুষে নিতে নিতে
পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিল হরিৎ ফুসফুস।
তা, একদিন ভাবলাম আর কতো এভাবে
দাঁড়িয়ে থাকবো?
একটু এদিক-সেদিক ঘুরে আসলেই তো পারি।
কি যেনো বলে হাওয়া-বদল? দরকার আছে না?
বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখতে কি যে ভালো লাগে!
গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সব বাচ্চার
মানুষের বাচ্চা হলে তো কথাই নেই!
নিজের জন্ম-ভাগ্যের ওপর বিরক্ত হলাম
মনে মনে একচোট গালও দিয়ে নিলাম।
নাহ্, আমাকে হাঁটতে হবে, ছুটতে হবে
ঘুরে বেড়াতে হবে চরাচরে
বিপুলা ধরনীর বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধের
অমোঘ হাতছানি আমাকে উদগ্রীব করে তুললো
মনে সংকল্প দানা বাঁধলো--
ভাবলাম মানুষের বাচ্চা হলে বেশ হবে
শুধু এক পায়ের জায়গায় দু’পা
উড়তে বা সাঁতার কাটতে তো পারবো না
চারপেয়ে পশু হতে গেলেও বিপদ,
আমার আবার ঝুঁকে পড়ার অভ্যেস নেই।

একদিন বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ঠিক ঠিক
চুপিসারে আমার গাছশরীর থেকে বেরিয়ে
সন্তর্পণে ঢুকে পড়লাম
বিহারে বেড়াতে আসা এক দর্শনার্থীর জঠরে।
বলতে কি
মেয়েটাকে আমার খুব মনে ধরেছিলো-
শ্যামলা। কিন্তু স্নিগ্ধ ও মায়াবী চেহারা।
একহারা গড়ন। শালগাছের সাথে বেশ মিল।
এক যুবক আড়ালে শালপ্রাংশু বলে
মন্তব্যও করেছিলো মনে হয়, হবেও বা।
সেই বৃক্ষ-জন্মের স্মৃতি তো
ঠিক মনে করতে পারছি না।
সময়ের ধুলো জমে ঝাপসা, আবছা হয়ে গেছে।


হ্যাঁ, যা বলছিলাম, মেয়েটার সাথে শুধু
চারটা ছোট-বড় মেয়ে-সন্তান দেখে
আমার বুঝতে বাকি রইলো না-
তার কোনো ছেলে-পুলে নেই।
তাই পুত্র-সন্তান কামনায় বুঝিবা
কোনো মানস নিয়ে বিহারে এসেছিলো।
কে জানে!
ইশ্, মেয়ে মেয়ে করছি কেনো?
ও তো আমার মা। হ্যাঁ, মা-ই তো!
আমি প্রথমে নিষিক্ত পরাগ-রেণু হয়ে
ব্যাঙাচির মতো সাঁতরে তার গর্ভাশয়ে পৌঁছলাম।
এরপর ভ্রূণাঙ্কুর হয়ে লেপ্টে থাকলাম
গর্ভকোষের দয়ার্দ্র দেয়ালে।
পরে গোলাপ-কলির সুকুমার সুষমায়
মানব-প্রসূন হয়ে বেড়ে ওঠার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা।
কষ্ট তো একটু লেগেইছিলো--
বদ্ধ কুঠুরীতে দশমাস দশদিন
সারাক্ষণ গুঁটিসুঁটি মেরে থাকা কুণ্ডলী পাকিয়ে!
আর জন্মদরোজা ভেদ করে উদ্ভিন্ন হওয়ার
অধীর অপেক্ষা...
হাত-পা নিশপিশ করতো;
অত্তোটুকুন জায়গায়
কতো আর হা-পা ছোঁড়া যায়?
এক সময় আমের আঁটি ফেটে
অঙ্কুর ফোটার মতো যথারীতি ভূমিষ্ঠ হলাম
মায়ের পায়ের জবা-কুসুম চুম্বন করে।
মায়ের সে কি কষ্ট!
এদিকে অপেক্ষার পালা শেষ বলে
আমার আনন্দ ছিলো সীমাহীন,
কিন্তু মায়ের প্রসব যন্ত্রণা, কৈছালি দেখে
মাটিতে পড়ে আনন্দ-উল্লাস ভুলে
চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলাম।
কিন্তু সন্তানের মুখ দেখে তার সমস্ত কষ্ট
মুহূর্তেই উবে গেলো!
বিশেষ করে পুত্র-সন্তান পেয়ে নিমিষেই
মা হয়ে গেলেন উষ্ণ জলের প্রফুল্ল ফোয়ারা।

বাবা থাকতেন শহরে- বেশ দূরের পথ।
তার কাছে খবর পৌঁছলো লোক মারফত।
খুশিতে ডগমগ আর হন্তদন্ত হয়ে
তিনি উড়ে এলেন,
পাড়া-পড়কিদের ভিড় তো আছেই!
চারদিকে মিষ্টি উড়তে লাগলো
বাহারি বেলুনের মতো
শত্র“-মিত্র কেউই বাদ পড়লো না।
পুত্র-সন্তানের জন্যে মানুষের এতো আকুতি
এতো আনন্দ আমার কাছে
একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হলো।
হয়তো আমি গাছ বলে;
গাছের রাজ্যে আবার মেয়েদেরই কদর কিনা!
ফলবতী আর পুষ্পিতা তো হয় মেয়ে গাছেরাই।

হ্যাঁ, বলেছি না?
আমি চার চারটি বোন পেয়েছি?
একটা ভাই পেয়ে ওরাও মহাখুশি!
আনন্দে লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করলো ওরা
পাখির মতো কিচির-মিচির, ঠোকরা-ঠুকরি
এলোমেলো ডানা ঝাপটানি, হুড়োহুড়ি;
মায়ের কোল থেকে ছোঁ মেরে লুফে নিতে
টানাটানি শুরু করে দিতো
কার আগে কে নেবে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি।

কিন্তু মা আমাকে কিছুতেই
কোল-ছাড়া করতে চাইতেন না
চোখের আড়াল তো না-ই!
ওদের নাছোড় আবদারে হার মেনে
কারো সাথে কোল-বদল করলেও
শঙ্কিত হয়ে থাকতেন--
অ্যাই সেজো! ব্যাথা পাবে! পড়ে যাবে দেখিস!
মেজো খেয়াল রাখবি কিন্তু!
উৎকণ্ঠা আর ওদের সাবধান করতে করতে
মায়ের গলার পানি শুকিয়ে যেতো,
শেষে নিজের বুকে-কোলে ফেরত পেলে
তবেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন।
চুমোয় চুমোয় ভিজিয়ে তুলতেন
আমার তুলতুলে মুখের ভূগোল।
আর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিতেন সযত্নে।
তার কোমল হাতের পেলব পরশ
আমার বেশ লাগতো
মানবজনম সার্থক ভাবতাম।
হলে কি হবে? মা যেভাবে নাক ঘঁষে ঘঁষে
আমার সারা গায়ের গন্ধ শুঁকতেন,
ভয়ের অক্টোপাস মনটা খামচে ধরতো,
পাছে কোন সময় না জানি আবার
তার নাকে ভুস করে গেছো গন্ধ ডুকে পড়ে!

আর একটা কথা।
বলতে তো ভুলেই গিয়েছিলাম।
গরুবাছুরদের মায়ের পুরুষ্টু ওলান থেকে
আয়েশ করে দুধ খেতে দেখে
আমারও ভারি লোভ হতো।
মনে মনে কতোবার বাছুর হতে চেয়েছি!
মানব-শিশু দুধ খায় কিনা
আমার তখনো জানা ছিলো না।
পরে মানুষ-জন্মের পর যখন আমি
ওঁয়া ওঁয়া ওঙ্কারে তারস্বরে কাঁদতে শুরু করি,
আমাকে সস্নেহে কোলে নিয়ে
মা তার ডান স্তনের খয়েরি বোঁটাটি
আলতো করে আমার মুখে পুরে দিলেন।
আমি অভূতপূর্ব আস্বাদনের আনন্দে
বিস্মিত ও শিহরিত হলাম।
মাতৃস্তন এতো কোমল আর উষ্ণ! দুধও!
অপূর্ব!
ওটাকে তো শালদুধ বলে, তাই না?
ডক শালগাছের কথা মনে পড়ছে?
আমিও বেশ মজাই পেয়েছিলাম।
গাছেদের তো আবার দুধ খাওয়ার
ব্যাপার-স্যাপার নেই। সেকারণেও।
পরে জেনেছি
শালদুধ পুষ্টিতে ভরপুর স্তন্যামৃত।
আমি, কি বলবো?
পুরোটাই খেয়েছিলাম।
মা কৃত্রিম বিস্ময়ের ছলে বললেন, ওমা!
এ যে দেখি রাক্ষুসে হবে মা!
সাথে সাথে আমার নানী মুখে তর্জনী চেপে
বললেন, ছি! হতচ্ছাড়ি!
ডক যা-তা বকছিস?
এমন অলক্ষুনে কথা মুখে আনে কেউ?
তুই না মা?
মা লজ্জায় চুপ হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে
আমাকে আদর করতে লাগলেন।
আমার খুব হাসি পেয়েছিল
কিন্তু, আমি তো তখনো হাসতেই শিখিনি!
শিখলে নিশ্চয়ই ফিক করে হেসে ফেলতাম।
তো, আমাকে দুধ ছাড়াতে মাকে
যার-পর-নেই বেগ পেতে হয়েছিলো।
পুরো সাড়ে তিন বছরই খেয়েছি।
আমার জিহ্বায় মায়ের দুধের সেই নোনা স্বাদ
লেগে আছে এখনো।
মাংসল গন্ধটাও।
নেশা লেগে গিয়েছিলো
সময়-অসময় নেই যখন খুশি
মায়ের ওম-ভরা বুকে মুখ গুঁজে চুক চুক করে
আশ মিটিয়ে খেতাম।
মা মাঝে মাঝে বেশ বিরক্ত হতেন
কখনো বিব্রতও।
না পারতে মৃদু বকুনি বা ধমক দিতেন
তবে তখনো তার গলায় মিশে থাকতো
প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের অসতর্ক আভাস,
ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসির ঝিলিক
তার কপট রাগের জারিজুরি ফাঁস করে দিত।

আমার বারবার মনে পড়ে যায়-
আমি তো আসলে শালগাছ। মানুষ নই।
মানুষের খোলের ভেতর ছাল-বাকলে মোড়ানো
কাষ্ঠল সত্তার অতৃপ্ত আত্মা!
কাউকে বলাও মুশকিল!
হায়! আমার মা যদি জেনে ফেলে?
আহারে বেচারি! আমাকে যা আদর করে না!
জানলে নির্ঘাত মূর্ছা যাবে।
ভাবতেই শিউরে উঠি।
এমন পুত্র-অন্তপ্রাণ মা দ্বিতীয়টি হয় না।
মায়ের মায়াজালে জড়িয়ে
বিস্মরণের সরোবরে কেটে গেলো আরো বছর দুয়েক...

আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো।
আমার দারুণ লাগলো--
ছেলে-মেয়েদের সুর করে নামতা পড়া
উচ্চস্বরে ধারাপাত, শতকিয়া পাঠের কসরত
চীৎকার, চেঁচামেচি, কিচির-মিচির
কল-কাকলি-মুখর এক প্রাণোচ্ছল পক্ষীশালা!--
একদিন দেখলাম পড়া না পারলে শিক্ষক
ছেলেমেয়েদের কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখেন;
দেখে অদ্ভুত লাগলো আমার,
আমারো ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার লোভ হলো
ওই যে! পুরানো অভ্যেস!
সুযোগে মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে।
বাড়ি ফিরে পেট ব্যথার নাম করে
পড়া না শিখেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন খুশিতে তিড়িং-বিড়িং নাচতে নাচতে
সাত-সকালেই ছুটে গেলাম স্কুলে।
কিন্তু, আমার উৎফুল্ল চেহারা দেখে
স্যার আর পড়াই জিজ্ঞেস করলেন না।
ধ্যাত্তেরি! ভাগ্যটাই মন্দ!
বের করলাম নতুন বুদ্ধি।
স্যার হাজিরা খাতা খুলে নাম ডাকলেন
সবাই দাঁড়িয়ে হাত তুলে ‘প্রেজেন্ট স্যার’ বলছে
আর আমি উদাসীন ভাব নিয়ে বসে থাকলাম
শুনেও না শোনার ভান করে।
আর যাই কোথায়?
আকবর মাস্টারের শ্যেন-দৃষ্টির রাডারে
ধরা পড়ে গেলাম।
মানে স্যার টোপ গিললেন
পা দিলেন আমার পাতা ফাঁদে!
কিন্তু এতই ঘটলো বিচ্ছিরি বিপত্তি।
আমাকে ডেকে নিয়ে টেবিলের ওপাশ থেকে
কান ধরে টান দিতেই
আমার পা মাটি থেকে আলগা হয়ে গেলো
পট পট করে ওঠল কানের গোড়া!
ভাগ্যিস পা! শিকড় হলে কানটাই ছিঁড়ে যেতো।
মনে হলে দক্ষিণের ডালটি মড়াৎ করে
ভেঙে পড়লো গোড়া থেকে।
ধারালো নখ বসে গেলো কানে।
লাল ক্ষীর, রক্ত!
আমার ছুটি...

টলতে টলতে কোনো রকমে বাড়ি ফিরলাম।
মা-বোনেরা কেঁদে-কেটে পাড়া মাথায় তুললো
আশ-পাশের তো বটেই আন-পাড়া থেকেও
ছুটে এলেন শুভার্থী, সমব্যথীরা;
ঢুঁ মারতে এলো উৎসুক উটকো মানুষের দঙ্গল,
বাড়িটা ছোট-মোটো জংলায় রূপ নিলো--
মাস্টারের নিন্দে-মন্দে রেগে টং হলেন অনেকে।
কেউ কেউ আমার জখম হওয়া কানটি নেড়ে-চেড়ে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করলেন
ঘা-টা আছে কিনা দেখতে।
আমার কান ছিঁড়ে গেছে বলে গুজব ছড়ালো--
অনেক হাঙ্গামা-হুজ্জত
আর বিস্তর জল ঘোলা হলো...
কিন্তু পরদিন সবার মুখে ছাঁই দিয়ে
আমি ঠিকই স্কুলে হাজির!

সে বছর ছাত্র পেটানোর কারণে কোথায় জানি
বাপ-ভাই মিলে রাগ ঝাড়তে গিয়ে
একটা মাস্টারকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলো--
শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাকলেন
তিন মাস স্কুলে তালা...

লাগাতার বন্ধে বন-বাদাড়ে ঘুরলাম প্রচুর
কিন্তু, মনটা খারাপ হয়ে গেলো
বৃক্ষের ওপর মানুষের উদাসীন অবিচার দেখে।
চারদিকে নির্বিচার বৃক্ষ হত্যার মহোৎসব
আর সমানে সবুজ সংহার দেখে
নিদারুণ ব্যথিত হলাম।
জানি না আমার এ বৃক্ষকাতরতা কে-কিভাবে নেবে।
আমাকে কেউ আবার তথাগত ভেবে বসবে না তো?
হলফ করে বলছি, মাইরি!-
আমি স্রেফ শাল, শালভদ্র বা বোধিদ্রুম নই।
জন্ম জন্মান্তরে অযুত যোনিভ্রমণে
বোধিসত্ব লাভের ইচ্ছেয় আমি মানুষ হইনি,
তেমন ইচ্ছে আমার কখনোই জাগেনি।

রবি ঠাকুরের গল্পের বলাইয়ের কথা মনে পড়ছে--
আমার ভাবতে ইচ্ছে করে
আমি ও বলাই সহোদর একই বৃক্ষমাতার
বীজাণু থেকে অঙ্কুরিত হয়েছি।
আমার মাও অবশ্য খুব গাছ ভালোবাসতেন
গাছ পেটে ধরেছিলেন বলেই কিনা জানি না
তবে গাছের প্রতি ছিলো তার আন্তরিক মমতা;
জগদীশ বসু পড়েছিলেন কিনা জানি না,
তবে তিনি ঠিকই জানতেন,
গাছেরও প্রাণ আছে, ওরাও ঘুমায়।
রাতের বেলা গাছের কাছে বিনীত অনুমতি প্রার্থনা ছাড়া
একটি পাতাও ছিঁড়তে দিতেন না।

মায়ের আদর, বোনদের সাথে সারাদিন
খিটিমিটি হাতাহাতি আমাকে
আবার গাছজীবনের কথা ভুলিয়ে রাখলো।
্রই মাঝে একদিন শুনি কি
গ্রামের বুড়ো বটগাছটি কারা যেনো কেটে ফেলেছে,
বারাউলিয়ার দরগার পাশের তেঁতুলগাছটি আর নেই
তুলাতুইল্লা মোরার বিশাল গর্জন গাছটি
বন বিভাগের লোকজনের সাথে
যোগসাজশ করেই...
আমার চোখে জল এসে যায়
কিন্তু, আমার বৃক্ষজন্মের কথা ফাঁস
হয়ে যাওয়ায় ভয়ে নিজের ভেতর সেঁধিয়ে যাই
প্রতিবাদের সাহস সঞ্চয় করতে পারি না।
মনের অলিন্দে জমে ওঠা বিক্ষুব্ধ মেঘেরা
চোখের চৌহদ্দি পেরিয়ে বুকের বারান্দায়
নেমে আসে সদলে।
আমি আবার গাছ হয়ে যেতে চাই
শালবনে ফেলে আসা আমার ছলম;
সেই শালগাছটার জন্য মনে বেদনা উথলে ওঠে।
কিন্তু, মায়ের অপত্য আদর-স্নেহ
আমাকে আবার সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।
আমি স্কুল পেরিয়ে কলেজ, ভার্সিটি...
মায়ের খুব অসুখ হলো: ঘুণপোকা
তার বাকলটা ছাড়া পুরোটাই খেয়ে ফেলেছিল।
আমি শহরে। ১৯ এপ্রিল ১৯৯১।
২৬ রমজান, অল-বিদা জুমা, শবে কদর।
খবর পেয়ে ছুটে পৌঁছার আগেই
রোজাদার মুসল্লি-মুরব্বিদের হাঁসফাঁস
মোল্লা-মৌলবী-মিয়াজীদের পীড়াপীড়িতে
দারোগা মসজিদের কবরস্থানে দাফন শেষ
নানা-নানীর কবরের পাশে।
শোকাহত সঙ্গীহারা বাবা গলিত পাথর।
কাঁদলাম জবাই করা পশুর মতো
গর গর আওয়াজ করে। নিষ্ফল।

কাঁদতে কাঁদতে কাহিল হয়ে
নেতিয়ে পড়লাম লাউয়ের ডগার মতো।
হঠাৎ দেখলাম মা তার কফিন থেকে বেরিয়ে
কবরের মাটি ফুঁড়ে বাঁশের পরুলের মতো
গজিয়ে উঠেছেন।
ভোঁ দৌড়ে মার কবরে পৌঁছলাম--
চারদিকে বাঁশের বেড়ার ঘেরা,
চার কোণে চারটে খেজুরের বাইল পাতা
মাঝখানে বুকের ওপর একটি
এরেণ্ডার ডাল পুঁতে দেয়া।
ঢুকরে কাঁদতে কাঁদতে
আমার মনের গভীরে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো
কফিনের মার্কিন থান
মাকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারবে না,
দু’দিন পর হোক
মা ঠিকই অঙ্কুরিত হয়ে উদগত হয়ে
কবরের কপাট ঠেলে বেরিয়ে আসবেন।
না, আমি কিছুতেই এখান থেকে যাবো না
আমি এখানেই অপেক্ষায় থাকবো অহোরাত্র।
আমাকে নিয়ে সবার আপদের অন্ত রইলো না...

ক’দিন পর এলো সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল।
লাখ লাখ মানুষের সাথে
অসংখ্য বৃক্ষের মৃত্যু আবার অনিবার্যভাবে
বৃক্ষ-জন্মের; জীবনের কথা মনে করিয়ে দিলো
কাউকে না জানিয়ে
একদিন চলে গেলাম লালমাই পাহাড়ে, শালবনে।
দেখি কি! আমার শরীর, সেই শাল--
যার মধ্য থেকে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম--
মর্মান্তিকভাবে শিকড়-বাকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়ে আছে।
আর করাত, কুঠার নিয়ে কিছু কসাই-জল্লাদ...
নাহ্, আর বলতে পারছি না।
হায়! শ্যামাঙ্গী জননী আমার!
আজ তুইও নেই আমারও আর
বৃক্ষ-জীবনে ফিরে যাবার উপায় রইল না...

অগত্যা, ফিরে আসতে হয় লোকালয়ে।
অবশ্য, আমার এ বৃক্ষজীবনের কথা কেউ জানে না।
এমনকি আমার বাবা, বোনেরাও না।
আমার এ দোলাচল, অন্তর্দাহ একান্তই আমার
কাউকে এর শরিক করার সুযোগ নেই।

আচ্ছা, বাবা যদি জানেন?
তিনি মাঝে মধ্যে বেকায়দা রেগে গেলে
আমাকে গাছ-বাঁশের পয়দায়েস
বলে গাল-মন্দ করতেন।
তিনি কি হতবিহ্বল হয়ে পড়বেন
শেষমেশ তার বেফাঁস কথাটাই সত্য হলো বলে?
নাকি খোদার কাছে অনেক কান্নাকাটি
আর দরগায়-মসজিদে শিন্নি-মানতে
পাওয়া একমাত্র পুত্র-সন্তানটিও
হারালেন বলে তার মাথায় আকাশপাত হবে?
হায় আল্লাহ! বলে কপালে হাত দিয়ে
ধপ করে বসে পড়বেন দাওয়ায়?

আমরা বোনেরা?
ওরা যদি জানে
তাদের আদরের ছোট ভাইটি
আসলে একটি শালগাছ, তাহলে?
তারা কি আমাকে কেটে-চিরে
তক্তা বানাতে চাইবে?
নাকি ভাইয়ের অভাব মেটাতে
আমার শরীর থেকে কলম বানিয়ে
পুকুরের কিনারায় পুঁতে দিয়ে
পরীক্ষা করে দেখতে চাইবে
এরকম আরো গাছমানুষ জন্মানো যায় কিনা
উঠোনের ধারে কিম্বা বারান্দার টবে?

আমার ভাগ্নে-ভাগ্নিরা?
ওরা কি আমাকে আর মামা ডাকবে না?
ডাকলে কি নামে ডাকবে,
গাছমামা না শালমামা?
বৃক্ষ, বিটপী বা অটবিমামা ডাক শুনতে হবে?

আর আমার বন্ধুরা কি করবে?
এমন বিরল ঘটনায় খুশি হবে তারা?
নাকি কৌতুক বোধ করবে?
একটা চমৎকার ঠাট্টার বিষয় পাওয়া গেলো বলে
ইউরেকা! ইউরেকা! বলে
সোল্লাসে চীৎকার করে উঠবে সমস্বরে?
ওদের মজ্জায় মিশে যাওয়া নাগরিক সন্দেহের তীর
সাঁই করে ধেয়ে আসবে আমার দিকেও!
আরএনএ’র অস্তিত্ব প্রমাণে
আমার দেহের নমুনা নিয়ে
পাঠাতে চাইবে ভিনদেকি পরীক্ষাগারে?
নাকি কেউ বিজ্ঞানের বিস্ময় কেউবা অসম্ভব বলে
জড়িয়ে পড়বে তুমুল বিতর্কে?
বিভক্ত হয়ে পড়বে দু’শিবিরে?
নাকি একটি সচল বৃক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা
নিজেদের বৃক্ষপ্রেমের অকাট্য প্রমাণ হিসেবে
জাহির করতে চট জলদি খবরটা
ফলাও করে চারিদিকে চাউর করতে
ব্যস্ত হয়ে পড়বে?

আচ্ছা আমি এসব ছাঁইপাশ ভাবছি কেনো?
আমিতো গাছই। শালগাছ। ডক জানি!
এতোদিন মানুষের সাথে থাকতে থাকতে
সঙ্গদোষে হয়তো আমি মানুষই হয়ে গেছি!
গাছমানুষ বা মানুষগাছ কোনটা বলা যায়?
নাকি নরকল্পতরু? না তরুকল্পনর?
হয়তো বা দুটোই।
নাকি কোনোটাই না!?

মাঝে মাঝে ভাবি আগে আমার শরীরে
ছিলো ক্লোরোফিল,
সেটা এখন হিমোগ্লোবিন হয়ে গেছে।
তেমন তফাত কি?
আবার ভাবি
মিছেমিছি মানুষ হতে চেয়েছিলাম কেনো?
আমার বৃক্ষশরীরে তবে কি একটা মানুষ্যমন ছিলো?

যাক, সেসব কথা। বলছিলাম কি, শুলে বা বসলে
আমার ফেলে আসা শরীরটার কথা
মনে পড়ে যায়।
আচমকা ব্যথায় বুকটা চিনচিন করে ওঠে
আমি দাঁড়িয়ে যাই
সটান ঋজুতায় ফোটাতে চাই বৃক্ষজন্মের স্মৃতি।

অনুশোচনা হয় আমি একটা সপ্রাণ
জীবন ছেড়ে এসেছি বলে।
আমার ডাল-পালা, পত্র-পল্লব জুড়ে ছিলো
পাখ-পাখালির কলরব, কোলাহল
কতো ডকট-পতঙ্গ, পোকা-মাকড়
কাঠ বিড়ালীর চাঞ্চল্য
পাখির বাসা, ডিম, ছানা-পোনা
সাপের নিঃশব্দ চলা।
সব ছেড়ে শুধু চরাচরে চরে বেড়ানোর
লোভে মানুষ হয়ে চরৈবেতি বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম।
আবার ভাবি, মানুষের শরীরও তো
অসংখ্য জীবাণুর অভয়াশ্রম!
আসলে জীবন মানে তো বিচিত্র প্রাণের বর্ণিল উৎসব
প্রাণে প্রাণে বাঁধা অদৃশ্য সেতু--পারাপারের পার্বণ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রবীন্দ্রনাথের 'সমাপ্তি' গল্প নিয়ে কাটাছেঁড়া

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৩:২৯



রবীন্দ্রনাথের চমৎকার একটা গল্প আছে।
গল্পের নাম- সমাপ্তি। গল্পটা আমার অনেক পছন্দের। যদিও আজকের আধুনিক যুগের সাথে রবীন্দ্রনাথের গল্প গুলো প্রায় অচল। সে যাকগে, প্রায়ই আমি এই গল্পটি পড়ি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাহাঙ্গীর আলম এবারো রাগ করবেন।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৮ ই মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৪৪



আরেক নটী নুসরাত ফারিয়াকে বিমানবন্দর থেকে আটক করেছে কতৃপক্ষ। এবার জেলে যেতে হবে সংগে ডিম থেরাপীও চলবে। জাহাঙ্গীর আলম আমেরিকা বসে এসব পছন্দ করছেন না কারণ ফারিয়া যেভাবে তৈলমর্দন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়ার দিন~

লিখেছেন সামিয়া, ১৮ ই মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৬



ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় আগুন-রঙা রক্তিম লাল রঙে কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরে আছে গাছগুলো,
গ্রীষ্মের এই প্রচন্ড গরমে কৃষ্ণচূড়ার এই ফুলে ফুলে ছেয়ে যাওয়া রুপ দেখে মনে হয় আকাশের নিচে আগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

পর্দার শেখ হাসিনা তো গ্রেফতার হলো, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কি খবর ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই মে, ২০২৫ রাত ৯:৩৪


খুব এক্সসাইটিং ব্যাপার স্যাপার ঘটছে আজকাল ! ব্লগে যে চরিত্র নিয়ে লিখি উহাই গ্রেফতার হচ্ছে। গতকাল নায়িকা নুসরাত ফারিয়াকে নিয়ে লিখলাম। আজকে দেখি বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার মটর-সাইকেল ট্যুরের সময় ভূতুরে অভিজ্ঞতা

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:০১

আসলে জীবনে অল্প বিস্তর প্যারানরমাল ঘটনা আমার সাথে ঘটেছে। আজ সে সবের মধ্যে আজ শুধু বাইক রিলেটেড ব্যাপারগুলোই তুলে ধরব।



ঘটনা ১. শুরুতেই বলি, আমি একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×