দুবাই থেকে ঘণ্টা খানেক চলার পর অনেকটা ধু ধু মরুভূমি শুরু হল- মরুভূমির মধ্য দিয়ে সুন্দর প্রশস্ত রাস্তা। যতটুকু চোখ যায় শুধু ঢেউ ঢেউ সোনারাঙা বালুর পথ।দেখতে অনেকটা অসমতল উঁচু-নিচু পাহাড়ের মত। অনেক অংশ সমতল, অনেক অংশে বালির ঢিবি উঁচু-নিচু বালিয়াড়ি যেন বালির সাগর, বায়ুপ্রবাহে তাতে সৃষ্টি হয়েছে ঢেউয়ের পর ঢেউ। মাঝে মাঝে যেন কোন্ শিল্পীর হাতে আঁকা আল্পনা! বালুর সাগরে এমন ঢেউ, এমন সুন্দর আল্পনা কারো কল্পনায়ও আসতে পারে না! মাঝে মাঝে লম্বা রেখা চলে গেছে দূর দিগন্ত পর্যন্ত।
এটা ছিল আমাদের অফিসিয়াল ট্যুর। কলিগদের সাথে জিপে চেপে মরুর বুক চিরে ছুটে চলছি। মরুময় এলাকা জুড়ে পাহাড়ের মত উঁচু নিচু বালির স্তুপ। উঁচু থেকে নিচুতে আবার নিচের দিক থেকে উপরে দ্রুত বেগে ছুটতে থাকা আমাদের সামনের গাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে বালির সাথে যুদ্ধ যোঘণা করেছে। উচ্ছ্বাস আর আনন্দ মিশে যায় বাতাসে উড়ে বেড়ানো বালির সাথে। একবার উঁচুতে আবার নিচুতে এভাবেই চলতে থাকে অনেকক্ষণ। আমাদের কিছু গাড়ি বালিতে আটকে যাচ্ছে। ঢালু থেকে স্লিপ কেটে আমাদের জিপ নিচে নেমে পরছে , মনে হচ্ছে এই বুঝি উল্টে যাবে।আমরা ভয়ে আনন্দে গাড়িতে বসে চিৎকার চেচামিচি করছি।
মাঝে মাঝে আমরা যাত্রা বিরতি করছি ফটোশুট নেয়ার জন্য। চিকচিক করে লাল বালি। চারিদিকটাই ধু ধু প্রান্তর। মরুভূমি মানেই হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত গরম,তার উপর বালু ঝড় তো আছেই। যদিও আজকে অতটা বালু ঝড় নাই। প্রচণ্ড বাতাসে উষ্ণ বালু উড়ে এসে পড়ছে আমাদের গায়ে। অনেকেই এরাবিক ড্রেসে সেজে এসেছে।
আমাদের সবগুলো গাড়ি সন্ধার আগেই ক্যাম্পে পৌছাল। শুরু হলো উটের পিঠে চেপে ঘুরাঘুরি সেই সাথে সূর্যাস্ত দেখা। মরুসূর্য কিভাবে অস্ত যায় তা দেখার জন্যেই আমরা ভিড় জমিয়েছি বালিয়ারির উপরে,কেউবা উঠের পিঠে বসে অপেক্ষা করছে সূর্যাস্তের জন্য। সূর্যাস্তের সময় আকাশ যেন অদ্ভুত এক রুপ নেয় । মরুভুমিটি যেন ভয় মেশানো অদ্ভুদ এক সৌন্দর্যের প্রান্তর।একদিকে যেমন বালু ঝড়ের ভয় আছে তেমনি অন্যদিকে আছে সূর্যাস্তের রঙিন সৌন্দর্য।
রাতের আঁধারের মনোমুগ্ধতা আর রাতের নেশা ধরানো নাচ গানের উৎসব, সেই সাথে রাতের ডিনার।আমরা দল বেধে মঞ্চে নাচছি, খাচ্ছি, ঘুরছি। শুরু হল তানুরা ড্যান্স। ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে টানা ঘুরতে থাকে নৃত্যশিল্পী, তার সাথে করে বিভিন্ন রকম কসরত। পোশাক টা হয় খুবই রঙ-বেরঙের। এই নাচের সময় মঞ্চের লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়, অন্ধকারে পোশাকে থাকা লাইট নাচিয়ের ঘূর্ণনের সাথে সাথে চমৎকার আলোর নকশার জন্ম দেয় ।
মূল আকর্ষণ বেলি ড্যান্সের ঘোসনা আসতেই সবাই চিৎকার করে অভিবাদন জানালো। বেলি ড্যান্সে'র দৃষ্টিনন্দন নৃত্যশৈলী নিমেষেই হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ভীষণ দৃষ্টিনন্দন নৃত্যকৌশল, চোখ ফেরানো যায় না। আলো অন্ধকারে খোলা মরুভূমি জুড়ে কি অদ্ভুত এরাবিক সুরের ঝংকার হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। আবার পলকের মধ্যে রঙ্গীন আলো জ্বলে উঠতেই ষ্টেইজের মধ্যস্থলে এক সুন্দরী বিচিত্র ভঙ্গিতে নতজানু করে বসে আছে। গানের তালে তালে অপূর্ব ভঙ্গিমায় শরীরটাকে দুমড়ে মুছড়ে দু হাত দুদিকে প্রসারিত করে প্রজাপতির মত ছন্দে ছন্দে হিলে দুলে নাচতে লাগল।শরীরে যেন কোন হাড্ডি নাই । পাতার মত যেন দুলছে। শরীর যেন মেদহীন কাঁচা সোনার ভরন।
মরুভূমিতে আনন্দঘন সময় কাটিয়ে বেশ রাতে দুবাই ফেরার পথে যাত্রা শুরু করলাম। পেছনে ফেলে আসলাম অসংখ্য ভালোলাগার অম্লান স্মৃতি, যা কোনদিন ধূসর হবে না হৃদয়ের কোণে।
লাল বালি,বুড়া পাহাড় আর নীলাভ সমুদ্রের দেশ। (ছবি ব্লগ)