somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার প্রথম ভারত সফর। পর্ব-১

১১ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেক দিনের শখ, ভারত ভ্রমণে যাব। গত বছরের শীতে পরিবার সহ ঘুরে এলাম দিল্লী, আগ্রা, আজমীর, জয়পুর, কলকাতা। তারই
ধারবাহিক বর্ণনার আজ প্রথম পর্ব। চেষ্টা করেছি ভ্রমণের খুটি নাটি সব বিষয়গুলো তুলে ধরতে। যার কারণে লেখাটি একটু কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে। দর্শনীয় স্থান গুলোর বর্ণনা খুব ভালো ভাবে দিতে পারিনি। আশা করি পাঠক সমাজ বিষয়টিকে সুদৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি পরিচিত ট্রাভেল এজেন্সির কাছে কাগজ পত্র জমা দিয়ে ই-টোকেনের জন্য ১০-১৫ দিন ধরে অপেক্ষা করে আছি। কোন খবর নাই। পরে অন্য একটি মাধ্যমে প্রতি পাসপোর্টের জন্য খরচাদি বাড়িয়ে দিয়ে ই-টোকেন পেলাম। এখন নাকি সিজেন চলছে। বেশী টাকা দিয়ে সব আর্জেন্ট বেসিসে ই-টোকেন সংগ্রহ করছে, তাই নরমাল রেটের বেল নাই। তারপরেও বিপত্তি হলো। আামার বউ আর বাচ্চার পড়লো ৯ই ডিসেম্বর আর আমার পড়লো ১০ই ডিসেম্বর সকাল বেলা। অভিজ্ঞজনেরা বল্লেন যেহেতু আপনারা একই পরিবারের লোক, সুতরাং যেকোন এক তারিখে সবাই মিলে লাইনে দাড়াবেন। কাজ হয়ে যাবে। সেই মোতাবেক ৯ ডিসেম্বর সকাল ৭.১৫ মিনিটে বাসা থেকে বের হলাম ফুল ফ্যামিলি। মটরসাইকেলে করে ভু ভু করতে করতে ৮.৩০টা নাগাদ পৌছালাম গুলশান শুটিং ক্লাবের পশে অবস্থিত ইউসিবি ব্যাঙ্কের লাইনে। ব্যাংকের বাইরে এই সকালে এই রকম লাইন দেখেই বুঝলাম, মনে হয় আমাকেও এখানে দাড়াতে হবে! সাইকেলটা সাইড করে জিজ্ঞাসা করলাম এটা কিসের লাইন? জানালাম এটাই ভিসা ফি বাবদ ৬০০ টাকা জমা দেয়ার লাইন। এখানে পাসপোর্ট প্রতি ৬০০ টাকা জমা দিয়ে তার পরে সেই ব্যাংকের রশিদ সহ এম্বেসিতে লাইন দিতে হবে। সাথে পাসপোর্টের এককপি ফটোকপি এবং এক কপি ছবি লাগবে। অবশ্যই ই-টোকেনে যে ছবি আছে সেই ছবি হতে হবে। ওগুলো সাথেই ছিলো। তাই মেয়ে আর বউকে সাইকেলের কাছে দাড় করিয়ে রেখে আমি লাইনে দাড়ালাম। এক মহিলা এসে ওফার করলো টাকা কি লাইন ছাড়া দিতে চান? লাইনে দাড়ানো লাগবে না .... ! আমি তেমন পাত্তা দিলাম না। লাইনে দাড়িয়েই ভিতরে ঢুকলাম। প্রথম ডেস্কে যিনি বসে আছেন উনি শুধু পাসপোর্টের ফটোকপি, প্রদত্ত ছবি আর টাকা জমা দেয়ার লম্বা রশিদ রেডি করে দিচ্ছে। আমার গুলোও ওনার হাতে দিলাম। উনি বাচ্চার পাসপোর্ট দেখে বল্লো বাচ্চাদের টাকা রশিদের মাধ্যমে নেয়া হয় না। পাশের কাউন্টারে গিয়ে মুখে বলবেন তাহলেই হবে। নির্দেশ অনুযায়ী আমি পাশের লাইনে দাড়ালাম টাকা জমা দেয়ার জন্য। দেখি যিনি টাকা জমা নিচ্ছেন তিনি সব কাগজ পাতি চেক করে তার পর টাকা নিচ্ছে। সুতরাং ব্যাগ †থকে ই-টোকেন ফরম, মূল পাসপোর্ট সহ সবই †বর করে দাড়ালাম। উনি আমার বউএবং বাচ্চার পাসপোর্ট ও ফরম নিয়ে †চক করে আমারটা †ফরত দিয়ে বল্লেন এটা হবে না। আমি বল্লাম †কন? উনি বল্লেন †দখেন না আপনার ইটোকেনের তারিখ কত? আমি বল্লাম হ্যা জানি , ১০ তারিখ, কিন্তু আমরা †তা একই পরিবারের? উনি বল্লেন হবে না। আজ এই নিয়ম চলবে না। আপনাকে আগামী কালকেই আসতে হবে। আমি আবার অনুরোধ করলাম। উনি কিছুতেই শুনলেন না। আরো বল্লেন ই টোকেনের প্রিন্ট আউট কপিতে আঠা দিয়ে লাগানো ছবিটি আপলোড কৃত ছবিই হতে হবে। ছবি চেঞ্জ করে এম্বেসীতে দাড়াতে বল্লেন। উল্লেখ্য যে, আমরা আগের তোলা ছবি ই-টোকেন করার সময় আপলোড করেছিলাম, আর পেষ্টিং করেছিলাম সদ্যতোলা ছবি। কি আর করা ! আমার বাচ্চা আর বউয়ের ১২০০ টাকা জমা দিয়ে বের হয়ে আসলাম। বউকে বল্লাম এই এই ব্যপার, চলো এম্বেসীর সামনে যাই। তোমাকে সব বুঝিয়ে দিই। বুড়িকে নিয়ে তোমাকে একাই আজ দাড়াতে হবে। উল্লেখ্য ট্যুরিষ্ট ভিসার জন্য লাইনে দাড়িয়ে এম্বেসিতে ঢুকতে হয় না, এমনিই ঢোকা যায়। তবে মেডিকেলের ভিসার জন্য লাইন থাকে। ওকে সব বুঝিয়ে দিলাম। ও বল্লো ছবির ব্যপারে কি করবা? আমি বল্লাম ধ্যুর! একই রকমই তো দেখায়, তাছাড়া ফিজিক্যালীও তো ওরা তোমাদেরকে দেখবে। ঝামেলা হবে না বোধ হয়।

ওকে ব্যাংক ষ্টেটমেন্ট সহ সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে আমি বাইরে দাড়িয়ে আছি। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমার বউ মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। দূর থেকেই ওর হাতে সবুজ পাসপোর্ট দেখতে পেলাম। তার মানে পাসপোর্ট এখনো জমা হয় নাই, কিছু একটা ঘাপলা হয়েছে। বউ আমার কাছে এসেই বল্লো পুরানো পাসপোর্ট কই? আমি বল্লাম আমার ব্যাগে। বউ বল্লো দাওনি কেন? গেট পাশ নিয়ে এর জন্য আবার আসতে হলো? গেট পাশের জন্যই দাড়িয়ে আছি আধা ঘন্টা ......! আমি বল্লাম ভাবছিলাম ওরা দেখতে চাইবে না .... এই নাও .... বলে ব্যাগ থেকে ওর পুরানো পাসপোর্টটা বের করে দিলাম। বুড়ি অর্থাৎ আমার মেয়ে আর ভেতরে যেতে রাজী না। সে নাকি ওর মাকে বলেছে আমাদের আর বিদেশ যাওয়ার দরকার নাই ....... বাইরে বাপি আছে, বাপির কাছেই যাই। সকালে দেমন কিছুই খায়নি সে। বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। পুরানো পাসপোর্ট সহ ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ভেতরে পাঠালাম। কিছুক্ষণ পরে ও আবার আমাকে ফোন করে বল্লো ছবির জন্য সমস্যা করছে। এখানকার এক লোক ১২.৩০টার সময় ভারতীয় হাইকমিশনে যাবে, সে যদি এই ছবির ব্যপারে অনুমতি পায়, তবে এই ছবি এলাউ করা হবে, নচেৎ নয়। আমি বল্লাম তাইলে এক কাজ করো, গেট পাশ নিয়ে তুমি আবার বাইরে আসো, ঐ পুরানো ছবি আমার অফিসের ল্যাপটপে আছে। আমি অফিস থেকে পেন ড্রাইভে করে ঐ ছবি দোকান থেকে প্রিন্ট করিয়ে নতুন করে আঠা মেরে দিচ্ছি, ওদেরকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলে বের হয়ে আস। বেশ কিছু সময় পর দেখি ও বুড়িকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

তারপর ওদেরকে নিয়ে চলে এলাম কাওরান বাজার। হাতির ঝিলে সেদিন প্রচুর জ্যাম ছিলো।দ্রুত ওদেরকে কাওরান বাজারের 7 coockers এ নাস্তা করতে বসিয়ে আমি দৌড়ে গেলাম অফিসে। সেখান থেকে পেন ড্রাইভে করে ছবি গুলো নিয়ে গেলাম ছবি প্রিন্ট করাতে। ছবি প্রিন্ট করাতে করাতে ওদেরও নাস্তা হয়ে গেলো। মনে একটা শান্তি পেলাম এই ভেবে যে, যাক! আমার মা টা তো আর না খেয়ে নেই! পাসপোর্ট জমা নিক আর না নিক ........। আবারো দ্রুত সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম এম্বেসীতে। তখন বাজে পৌনে দুইটা। ওদেরকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছু সময় পর দেখি হাসি মুখে আমার পরিবার এম্বেসী থেকে বেরিয়ে এলো। ষ্টিকারে দেখলাম আগামী ১৫ই ডিসেম্বর ভিসা দেয়ার তারিখ। ওদেরকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। ফেরার পথে আরো এক কপি ব্যাংক ষ্টেটমেন্ট নিয়ে নিলাম। কারণ আমার ব্যাংক ষ্টেটমেন্ট ও বিদ্যূৎ বিলের অরিজিনাল কপি ওরা আজ রেখে দিয়েছে। আগামী কাল আবার আমার এক কপি লাগবে।

পরদিন সকাল বেলা আমি বেরিয়ে গেলাম। গুলশানের ইউসিবির টাকা জমা দেয়ার লাইন দেখি বেশ লম্বা। তখনও টাকা নেয়া শুরু হয়নি। সাইকেলটা এক পাশে রেখে লাইনে দাড়ালাম। এক খালা এসে অফার করলো খরচ পাতি দিলে আগে ঢুকে কাজ সারার ব্যবস্থা করে দিবে। ভদ্র ভাবে এড়িয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি আমাদের পরে এসে লোকজন পাশের গেটটা দিয়ে ভিতরে ঢুকে কাজ সেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। গেটে দাড়িয়ে থাকা প্রাইভেট সিকিউরিটিকে লাগালাম ধমক। ধমকে বেশ কাজ হলো। ও আমাদেরকে ঢুকার ব্যবস্থা করে দিলো। ৬০০ টাকা জমা দিয়ে চলে এলাম সোজা এম্বেসীতে। সাইকেলটা লক করে ঢুকে পড়লাম। এম্বেসির নিচ তালায় চেক করে দোতলায় পাঠিয়ে দিলো টোকেন দিয়ে। । আমার টোকেন নাম্বার ছিলো ২৬। ডাক পড়লো যথা সময়ে। সব কিছু দেখে ষ্টিকার ধরিয়ে দিলো ১৭ই ডিসেম্বর এর। অফিসে এলাম। এখনো অনেক কাজ বাকি। ডলার এন্ডোর্স, ক্রেডিট কার্ড এন্ডোর্স, এয়ার টিকেট, বাসের টিকেট, ট্রেনের টিকেট, টুকটাক কেনাকাটা ....... সব মিলিয়ে গুবলেট পাকানোর মতো অবস্থা।

১৫ ডিসেম্বর মেসেজ আসলো পাসপোর্ট সংগ্রহ করার বউ আর মেয়ের। দুপুরে গেলাম পান্থপথ। সোহাগ, শ্যামলী আর গ্রীন লাইনের কাউন্টারে। কলকাতা গামী বাসের সময়সূচী জানার জন্য। দেখে শুনে ২৩ তারিখের রাত ১১.৪৫ এ সোহাগ পরিবহনের এসি গাড়িতে দুটো টিকেট বুকিং দিলাম । তারা আবার আল্টিমেটাম দিলো ১৭ তারিখে বেলা ১১টার মধ্যে টিকেট না কিনলে বুকিং ক্যনসেল করে দিবে। অনুরোধ করলাম ১৭ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত বুকিং ধরে রাখতে। কারণ আমার ভিসা পেতে পেতে বিকাল তো হবেই। বুঝিয়ে বলার পর তারা ১৮ তারিখ সকাল পর্যন্ত বুকিং বজায়ে রাখতে রাজী হলো। বিকালে গেলাম গুলশানে মেয়ের আর বউয়ের পাসপোর্ট কালেকশন করতে। ৫টা নাগাদ হাতে পেলাম। ভিসা হয়ে গেছে। পাসপোর্ট গুলো বগলদাবা করে বাসায় আসলাম। আগামী কাল ১৬ তারিখ। যাব জামালপুর বেড়াতে। ফিরবো ১৯ তারিখ। ১৭ তারিখে আমার পাসপোর্ট দেয়ার তারিখ। ভিসা হয়ে গেলে অনেক কিছুই করতে হবে। ভাগ্নে নাবিলকে সব বুঝিয়ে দিলাম। কিভাবে আমার পাসপোর্ট তুলতে হবে, ভিসা যদি পাই তবে বাসের টিকেট কেটে ফেলতে হবে। নাবিল ঠিক মতোই কাজ দুটো সেরে রেখেছিলো।

১৯ তারিখে জামালপুর থেকে ফিরে কলকাতায় আমার পরিচিত রিমার সাথে যোগাযোগ করলাম। সে তখনো দিল্লী থেকে কলকাতা ফেরার জন্য ট্রেনের টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তবে কলকাতা থেকে দিল্লী যাওয়ার প্লেনের টিকেট সে বুকিং দিয়ে রেখেছে। এয়ার ইন্ডিগোতো ২৪ তরিখ বিকাল ১৭.৫০ মিনিটে। টিকেটের বেশ ক্রাইসিস। আবার ১ তারিখে যে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসবো সেই ফ্লাইটের টিকিটও তখন কাটা হয়নি। ২০ তারিখ মতিঝিল স্বপন ভায়ের অফিসে গেলাম। দিল্লী থেকে কলকাতা আসতে জেট এয়ারে আর কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসতে এয়ার ইন্ডিয়ার টিকেট কনফার্ম করে ফেল্লাম। ডলার এবং এমেক্স ক্রেডিট কার্ড এন্ডোর্স করিয়ে নিলাম। ক্রেডিট কার্ড এর দেনা পাওনা সেটেল করে সেটাকে বাইরে ব্যবহার উপযোগী করলাম যেহেতু কার্ডটি ডুয়েল কারেন্সি সুবিধা সম্পন্ন। টুকটাক কেনা কাটা পর্ব আমার গীন্নি সেরে নিয়েছিলো। পরে আমাকেও তার সাথে যোগ দিতে হলো। অনলাইনে বুকিং ডট কমের মাধ্যমে সব জায়গার অর্থাৎ দিল্লী, আগ্রা, আজমীর, জয়পুর, কোলকাতার হোটেলে বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। প্রতিদিনই বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় বসতাম ল্যাপটপ নিয়ে এই কাজে। কোথায় স্বস্তায় ভালো হোটলে পাওয়া যায়, কি কি ঘুরে ফিরে দেখা যায় অনলাইনে সেগুলো খুজে বেড়াতাম। এই সব তাল সামলাতে সামলাতে ২৩ তারিখ এসে গেলো।


২৩ তারিখ, ২০১৫, রাত ১১টা নাগাদ সবাই চলে আসলাম কল্যাণপুর সোহাগের কাউন্টারে। ১২.১৫র দিকে আমাদের গাড়ি আসলো। আমরা লাগেজ তুলে দিয়ে যার যার আসন গ্রহণ করলাম। আমাদের তিন জনের জন্য সিট দুইটা একটু আটো সাটো মনে হলো। অন্যান্য সময় এমন লাগে না। কিন্তু আজকে লাগছে। কি আর করা ... একটা সিট কম মানে ১৩০০ টাকা কম! না হয় একটু চাপাচাপি হলোই। কখনো ঘুমিয়ে পড়েছি ... মাঝে মাঝে টের পেয়েছি। গাড়ি চলছে বেশ দ্রুত। ফেরি ঘাটে বেশী দেরী হলো না। যদিও কোয়শার কারণে প্রায় প্রতি রাতেই ফেরি চলাচল বিঘ্নিত হবার খবর পাচ্ছিলাম। ভোর নাগাদ যশোর পর্যন্ত পৌছে গেলাম। কিছু সময় যাত্রা বিরতি দিয়ে আবারো চলা শুরু করলো। যশোর বেনাপোল বর্ডারে এসে যখন পৌছালাম তখন ৬টা কি সোয়া ৬টা বাজে। সবাইকে সোহাগের কাউন্টারে চলে যেতে বল্লো লাগেজ ছাড়াই। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। সম্পূর্ণ নতুন জায়গা। এর আগে কখনোই এখানে আসা পড়েনি। আধো আধো কুয়াশার মাঝে এমন রোমাঞ্চকর পরিবেশ .... ভাবতেই মনের মাঝে পূলক অনুভব করলাম। সেই সাথে ব্যাতি ব্যস্ততাও ঘিরে ধরলো। দ্রুত মেয়েকে কোলে নিয়ে সোহাগের কাউন্টারের দিকে এগোলাম। অনেকেই সেখানে পৌছে গেছে। ওরা আমাদের পাসপোর্ট চাইলো, বহির্গমন ফরম পূরণ করে দিলো। তিন জনের জন্য ১৮০০ টাকা চাইলো ভ্রমণ কর বাবদ। এই বারই পড়লাম নতুন সমস্যায়। কারণ আমার একদমই মনে ছিলো না যে এখানে এতোগুলো বাংলা টাকা লাগবে। তাছাড়া শুনে এসেছি বাংলা টাকা থাকলে তা বর্ডারে রেখে দেয়, সাথে থাকলেই লস!! কিন্তু এখানকার লোকেরা বল্লো একেক জন ৩০,০০০ বাংলা টাকা অনায়াসেই নিয়ে ওপাড়ে যেতে পারে। এখন আমার কাছে আছে সব ডলার। কুড়িয়ে কাড়ায়ে সর্ব সাকুল্যে ৫০০-৭০০ টাকা হলো। কিন্তু তা দিয়ে তো আর কাজ চলবে না। অগত্য কি আর করা। ডলার ভাঙিয়ে টাকা করলাম। সেই টাকা দিয়ে ভ্রমণ কর দিলাম। ভাবলাম বাকি টাকাটা আবার ডলার করে নিই। যদি টাকা রেখেই দেয় তো কম লস হোক। কিন্তু তখন ওখানে মাত্র বিশ ডলারের বেশী কোথাও পেলাম না।

কোন দোকানেই ৫০ ডলার নাই। অগত্য ঐ ২০ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকলাম। যে দোকান থেকে টাকাকে ডলার করতে গিয়েছিলাম,সেই দোকানী বল্লো, যে পমিান বাংলা টাকা আপনার কাছে আছে বলছেন, তা আপনি নিশ্চিন্তে নিয়ে যান, যদি ধরে, আমার কাছে এসেন। নির্ভয়ে নিয়ে যান। তারপর বাসের কাউন্টার থেকে আমাদেরকে দল বেধে ইমিগ্রেশনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো। দোতলা বা তিন্ তলা একটি বড় চত্বর ওয়ালা বিল্ডিং। চত্বরে লোকে লোকারণ্য। ব্যাগ লাগেজে ভর্তি মাঠের একটি পাশ। বেশ কতগুলো লাইন। আমরা কোথায় দাড়াবো বা কি করবো, কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না, শুধু কাউন্টারের যে লোক আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে, তার পিছু ছাড়লাম না। চত্বরে ঢোকার পরেই এক ভদ্র লোক দেখি আমাদের পাসপোর্ট তিনটা হাতে নিয়ে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি সাড়া দিলাম। সে আমার কাছে এসে বল্লো এখানে তো অনেক ভীড় আর অনেক সময় লাগবে। আপনি চাইলে আপনার সব আনুষ্ঠানিকতা আমি সেরে দিচ্ছি অল্প সময়ের মধ্যে, আপনি শুধু একদম শেষের লাইনে গিয়ে দাড়াবেন।

আমি আপনার হাতে পাসপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে যাব। আমি বল্লাম কত লাগবে? সে বল্লো প্রতি পাসপোর্ট ১০০ টাকা। বাচ্চারটা ফ্রী। আমি রাজী হয়ে গেলাম। সে বিল্ডিং এর শেষে একটি লাইন দেখিয়ে বল্লো আপনারা ঐ লাইনে গিয়ে এগোতে থাকেন। দেখলাম ঐ লাইনটিই বর্ডার ক্রসিং এর দরজার দিকে পিল পিল করে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা লাইনে দাড়ালাম। লাইনে যেতে গিয়ে পথে দেখলাম আমাদের ব্যাগেজ সহ আরো অনেকের ব্যাগেজ এক জায়গায় জড়ো করে রাখা। দেখে স্বস্তি পেলাম। বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেলাম। পাসপোর্ট এর দেখা পাচ্ছি না এখনো। একটু দুশ্চিন্তা শুরু হলো। কিছু সময় পর ঐ লোক এসে বল্লো, বাচ্চার পাসপোর্ট ধরেন, আর আপনাদের পুরোনো পাসপোর্ট দুটো দেন। স্যার দেখতে চাচ্ছে, নইলে বেশী টাকা চাবে। আমি ব্যাগ হাতড়ে পেলাম না। আমি গিন্নীকে বল্লাম কোন ব্যাগে রাখছিলা ওই দুইটা? ও বল্লো তুমি দাড়াও আমি বের করে দিচ্ছি। ও ঠিকই কোন পকেট থেকে জানি বের করে দিলো।

ঐ লোক পাসপোর্ট দুটো নিয়ে সুপার ম্যানের মতো হাওয়া হয়ে গেলো। একটু বাদেই ফিরে এসে বল্লো যান চলে যান, আর কোন ঝামেলা নাই। আর আমার মোবাইল নাম্বারটা রেখে দিন। এরপরে যখনই আসবেন, ফোন দিয়েন, উপকার করবো। বলে ২০০ টাকা নিয়ে চলে গেলো। আমাদের লাগেজগুলো একজন কুলি টানছিলো আমাদের পাশাপাশি। ওরা প্রথম গেট পার করে দিলো। কিছু বকশিশ দিলাম। ঐ কুলিই একজন ভারতীয় কুলির কাছে আমাদের লাগেজগুলো হস্তান্তর করে দিয়ে বল্লো, স্যার ওর নাম্বার ৮১, ঐ পাড়ে বাসে ওঠা পর্যন্ত ঐ আপনার লাগেজ টেনে দেবে। ব আমরাও আগাই , ৮১ নম্বরও আগায়। ও একেবারে বর্ডারের ভারতীয় গেটের মাথায় গিয়ে বসে থাকলো। আমরা সাপের মতো পেচানো লাইন ধরে হাটতে হাটতে এগিয়ে গেলাম। দুটো লম্বা লম্বা বড় গেটের মাঝে আমাদের লাইন। ভাবতে কেমন যেনো লাগে, এভাবে দেশ ভাগ করা থাকে! একদিকে বাংলাদেশ, আমার মাতৃভুমি, আর অপর দিকে ভারত !

আজব !! আমরা ভারতীয় গেট পেরোলাম। পাসপোর্ট গুলো চেক হলো। গেট পার হয়ে একটি একতলা বিল্ডিংএর ভিতর ঢুকলাম। সেই ঘরে ঢুকতেই স্ক্যান মেশিন চোখে পড়লো। আমরা মেশিন পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম, আর আমাদের লাগেজ আমাদের পাশাপাশি কুলির হাত দিয়ে মেশিনের ভেতর দিয়ে চালান হয়ে গেলো। ঐ ঘর থেকে বের হতেই ফাকা একটা মাঠ। মাঠের বাঁ ধারে বিভিন্ন বাসের লোকজন টেবিল নিয়ে বসা। সোহাগ, সৌদিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি .... । তাদের কাছে এসে সবাই পাসপোর্ট এগিয়ে দিলো। ওরা একটি স্লিপে সব কিছু পূরণ করে সিগনেচার করিয়ে ফেরত দিচ্ছে। প্রথমে আমি বিষয়টা ধরতে পারিনি। আমার সামনে এক হিন্দু ভদ্রলোক তার বউ ছেলে পুলে নিয়ে দাড়িয়ে ছিলো। ঐ কাউন্টারের কাছে আসতেই সে তার বউ বাচ্চাদেরকে দূরে ডানে যে পাকা ঘরের একটি বিল্ডিং আছে, সেখানেও লাইন দিয়ে মানুষ দাড়িয়ে ছিলো, সেখানে গিয়ে লাইন দিতে বলে নিজে ঐ বাস কাউন্টারে সবার পাসপোর্ট নিয়ে দাড়ালো। ওনার দেখাদেখি আমিও আমার বউ আর মেয়েকে ওদের সাথে লাইন দিতে বলে আমি ওদের পাসপোর্ট নিয়ে দাড়ালাম কাউন্টারে। সোহাগ কাউন্টারের লোক আমার পাসপোর্ট দেখে তিনটি ফরম পূরণ করে ছেড়ে দিতেই দেখি ওরা সবাই লাইনের একদম শুরুতে দাড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি দ্রুত এসে ওদের পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে দিলাম। ওখানকার বিএসএফ সদস্যরা আবার ওগুলো দেখে দেখে সবাইকে আরেকটি ঘরে ঢুকালো। সেখানেও কয়েকটা লাইন।

একটি লাইন সিনিয়র সিটিজেন ও রোগীদের জন্য স্পেশাল। আমরা ওটা ছেড়ে পরের লাইনে দাড়ালাম। ওখানে আমাদের সবার পাসপোর্ট দেখলো, ছবি তুল্লো, সিল ছাপ্পড় মেরে দিয়ে দিলো। আমরা পাসপোর্ট নিয়ে ঐ ঘর থেকে বের হতেই বুঝলাম ইমিগ্রেশানের ঝামেলা শেষ! কেউ তো কত ডলার সাথে আছে, ইন্ডিয়ান রুপি আছে কিনা, বাংলা টাকা কত আছে, হ্যান্ড ব্যাগে কি আছে, কি নাই, শরীর তল্লাশী সহ কিছুই করলো না! আমি একটু অবাকই হলাম। তবে যে শুনেছি বেনাপোল বর্ডার খুব খারাপ! অনেক হ্যানস্থা করে ...... ব্লা ব্লা ব্লা ....... আমাদের শরীরে তো পালকেরও স্পর্শ লাগলো না .....বর্ডার পেরিয়ে চলে এসেছি ভারত ভুখন্ডে!! তাজ্জব তো!! ওই রুম থেকে বের হতেই আরেক জন এসে সোহাগের যাত্রী কিনা জিজ্ঞাসা করে আমাদের পাসপোর্ট নিলো। বল্লো কাউন্টারে যেতে হবে। ওখানেই ডলার ভাঙিয়ে রুপি করলাম, সাথে সাথে সার্টিফিকেটও নিয়ে নিলাম। যদিও তা কোন কাজে লাগেনি। সিম কেনা, নতুন করে বাসের টিকেট কাটা এবং লাগেজ বাসে উঠানো সব ওরাই করে দিলো। আমরা সোহাগের কাউন্টারে পৌছানোর পর আমাদের কুলি আমাকে বল্লো আপনি থেকে এখানকার কাজ সারুন, আর বিবি বাচ্চাদেরকে গাড়িতে পাঠিয়ে দিন। পরে পেছনে বসতে হবে। আমি বল্লাম তা হয় নাকি? আমাদের আসন তো ফিক্সডই আছে। আমরা তো সোহাগের যাত্রী। কুলি বল্লো আপনাদেরকে না বোঝাতে পারবো না, জানেন তো! যেটা বলছি সেটা করুন, নইলে কিন্তু পিছনে বসে যেতে হবে ...... তার কথা শুনে আমার যে প্রচন্ড হাসি পেলো! মনে হচ্ছিলো স্টার জলসার নায়ক নায়িকারা কথা বলছেন।


যাই হোক তার কথা মতো ওদেরকে গাড়িতে তুলে দিলাম। আমি সিম কিনে এক্টিভেট করে গাড়ির কাছে এসে দেখি দুটো সোহাগ পরিবহন দাড়িয়ে আছে। সামনেরটায় খোজ করে ওদেরকে পেলাম না। পিছনেরটায় খোজ করে পেলাম এবং ওটাতেই সব লাগেজ তুলে কুলি ৮১ কে বিদায় দিলাম। বাসে উঠে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেল্লাম। তাহলে ঠিক ঠাক মতোই ভারত বর্ষে পদার্পণ করলাম। তবে আমাদের আজকের জার্নি এখানেই শেষ নয়। আজ বিকালেই ১৭.৫০ এ ইন্ডিগো ধরে আমরা যাব দিল্লী। সুতরাং সহসা রিল্যাক্সড হওয়ার কোন কারণ নাই। বাস তখনো ছাড়ে নাই। একজন যাত্রী তার মেয়ের পাসপোর্ট চেক করতে গিয়ে দেখে ওটি তার মেয়ের পাসপোর্ট নয়। সোহাগের কাউন্টার থেকেই কারোর সাথে পাসপোর্ট অদল বদল হয়ে গেছে। সে তো চিল্লা পাল্লা শুরু করলো। সুপারভাইজারকে ডেকে কাউন্টারে গিয়ে লোক জন ডেকে খোজ খবর করে পাসপোর্ট খুজে বের করতে গিয়ে প্রায় ২০ মিনিট সময় গেলো। বেলা তখন ৯টা কি সাড়ে ৯টা নাগাদ হবে। বেশ গরম লাগছিলো। ঐ মহিলার চিল্লাচিল্লি দেখে আমিও আবার আমার তিনটা পাসপোর্ট চেক করে নিলাম। না! ঠিকই আছে। গাড়ি যশোর রোড ধরে বনগাঁ হয়ে চলতে লাগলো। এবার আমরা তিনজন একটু আরাম করে বসতে পারছি। এপারের সোহাগের গাড়িটাও আগেরটার চেয়ে ভালো মনে হলো।


গাড়ি চলছে ...... রাস্তা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের গ্রামে যাচ্ছি। সরু রাস্তা। রাস্তার আশে পাশে মোটা চিকন সব ধরণের গাছ পালা দিয়ে ভরা। কোথাও মাটির ঘর নিচু হয়ে দাড়িয়ে আছে, কোথাও ফাকা মাঠ শরিষা ফুলে ভরে আছে। আমাদের দেশের মতোই প্রাকৃতিক সেই দৃশ্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলছি কোলকাতার দিকে। এই বাসটি নিউমার্কেট পর্যন্ত যাবে। আমরা পথিমধ্যেই দমদম এ নামবো। এয়ারপোর্ট এ। একটি রেস্তোরাঁর সামনে এসে গাড়ি থামলো। আমরা যার যার জরুরত সারলাম। পেটে কিছু দেয়া দরকার। কি খাই? খাব না খাব না করেও রুটি আর সব্জীর অর্ডার দিলাম। ভেবেছিলাম খুব একটা রুচীকর হবে না। কিন্তু না!! অবাক হলাাম স্বাদে অপূর্ব। ভাঙা চোরা মতো একটি খাবারের দোকানে এমন খাবার পাব আশা করিনি। ২০ মিনিট পরে আবারো গাড়ি ছাড়লো। আমার পাশে বসা এক মহিলা আমাকে কিছু সময় পর পর খালি জিজ্ঞেস করে আর কত সময় লাগবে ওখানে পৌছাতে? আমি নিজেই তো কানা, ওনাকে পথ দেখাবো কি? তারপরেও মাঝে মাঝে মোবাইলে গুগল ম্যাপ দেখে দেখে ভবিষ্যৎবাণী করতে লাগলাম। বার দুয়েক ড্রাইভারকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে আমরা দমদমে নামবো।

২.৩০ নাগাদ দমদমে পৌছলাম। গাড়ি থেকে নেমে লাগেজ বক্স থেকে লাগেজ নামিয়ে রাস্তার একপাশে দাড়ালাম। দমদম তো নামলাম, এখন এয়ারপোর্ট কোন দিকে বা কিভাবে যাব? কিছু ট্যাক্সি দাড়িয়ে আছে। আবার কিছু মানুষ দেখলাম আমাদেরকে ঔৎসুক্য নয়নে জরিপ করছে। সবই একনজর দেখে নিলাম। এরই মধ্যে এক লাক এসে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবেন? আমি বল্লাম এয়ারপোর্ট। লোকটি ট্যাক্সি দেখিয়ে বল্লেন চলুন ! আমি বল্লাম কত? সে বল্লো ১০০ টাকা। আমি বল্লাম এখান থেকে এখানে ১০০ টাকা? সে বল্লো ঘুরে ঘুরে উপরে উঠতে হয় তো ..... ১০০ এর নিচে যাবে না । অগত্য নিয়ে নিলাম। লাগেজগুলো ট্যাক্সির পিছনে তুলে দিলাম। কলকাতার রাস্তা গুলো সব ওয়ান ওয়ে। এই কারণে বেশী ঘুরতে হয়। ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌছে গেলাম এয়ারপোর্ট। টাকা দিয়ে ট্যাক্সি বিদায় করে একটা ট্রলি নিয়ে এসে লাগেজ তুল্লাম। আমার কাছে ই টিকেট আছে, কিন্তু এখানে যে ট্রাভেল এজেন্সি আমার টিকেট কেটে দিয়েছে, তাকে আমি এখনো দাম পরিশোধ করিনি। দাম নেয়ার জন্য আমি কলকাতায় নেমেই রিমাকে ফোন করেছিলাম। সে বিমান বন্দরে লোক পাঠাবে, সেই লোক এসে আমার থেকে টাকা নেবে। তাই এয়ারপোর্টে পৌছেও ভিতরে ঢুকতে পারছি না। কারণ একবার ভিতরে ঢুকলে আর বের হতে পারব না। ওনার জন্য পাক্কা এক ঘন্টা আমাদেরকে বাইরে থাকতে হলো।

বাইরে অবশ্য আমাদের দেশের মতো এতো ভীড় বা কোলাহল নাই। তাছাড়া অনেক পরিচ্ছন্ন এবং বাইরেই এস এস ষ্টিলের বসার বেঞ্চ পাতা আছে। সেটাতেই বসে থাকলাম। ট্রলিতে চড়িয়ে মেয়েকে ঘুরালাম। সেও নিজে নিজে গাড়ি চালানোর মতো করে ট্রলি চালাতে চালাতে খলা করলো। ভারতীয় সময় সাড়ে তিনটার দিকে ঐ ভদ্রলোক আসলেন। ওনাকে পাওনা দেনা মিটিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম। ইন্ডিগো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত মেশিন দিয়ে লাগেজ স্ক্যান করিয়ে আগে ফ্রেশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। তারপর লাগেজ গুলো ইন্ডিগোর কাউন্টারে ঠেলে নিয়ে গেলাম। ওরা ছিল ছাপ্পড় যা মারার মেরে বোর্ডিং কার্ড, ব্যাগেজ স্টিকার সহ দিয়ে দিলো। ইমিগ্রেশন পার হলাম। হ্যান্ড লাগেজ, গায়ের জ্যাকিট সহ সব কিছু নিয়ে লাইনে দাড়াতে হলো বডি ও অন্যান্য জিনিষ পত্রের স্ক্যানের জন্য। সেটা পেরিয়ে চলে এলাম আরো একধাপ ভেতরে। গেট নাম্বার দেখে ঐ গেটের আশে পাশে আসন নিলাম। আমাদের নির্দিষ্ট গেটের আশে পাশে ভালো কোন খাবারের দোকান না পেয়ে আবার দূরে চলে এলাম। কি খাই ? কোনটা কেমন হবে তাও বুঝতে পারছি না। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে। চিকেন শর্মা আর জ্যুস নিয়ে নিলাম বাচ্চার জন্য। আমি তেমন কিছু খেলাম না, বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে খাওয়ালাম। তার পর ফিরে এলাম আমাদের গেটের কাছে।

কিছু সময় পর একজন মহিলা এসে বিমানের নাম্বার ধরে ঘোষণা করে গেলো অমুক নাম্বারের ফ্লাইটের যাত্রীরা গ্রাউন্ড ফ্লোরের এতো নম্বর গেটে গিয়ে লাইন দিন। আমরা আবার সদলবলে নিচে নেমে লাইনে দাড়ালাম। এবার আমরাই ফাষ্ট ....... বোর্ডিং পাস চেক করে বিল্ডিং থেকে রানওয়ে তে পা রাখতেই দেখি ইন্ডিগোর সুন্দর নীল রঙের চকচকে গাড়ি দাড়িয়ে আছে আমাদেরকে বিমান পর্যন্ত পৌছে দিতে। ওরা গাড়ির ভিতরেই ঘোষনা করলো যে সিট নম্বর এতো থেকে এতো বিমানের প্রথম গেট দিয়ে এবং এতো থেকে এতো পিছনের গেট দিয়ে প্রবেশ করবেন। সুতরাং সেই মোতাবেক আমাদের বরাতে পড়লো পেছনের গেট। বিমানে উঠে নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লাম। শুরু হলো আমার মেয়ের গল্প শোনার বাতিক। তাকে বাঘ ভাল্লুক শিয়াল ডাইনি বুড়ি ব্লা ব্লা ব্লা - র গল্প বলতে হবে। শুরু করলাম। এর মধ্যে বিমানও তার ডানা মেলে দিলো ঘন কালো রাতের আকাশে। উড়তে উড়তে একসময় মেঘের উপরে উঠে পড়লো। মনে হলো একটু কাপাকাপি করছে বেশী। কিছু সময় পরে অবশ্য স্থির ভাবেই উড়তে লাগলো। এয়ার হোস্টেসরা খাবার সার্ভ করছে। পছন্দ অনুযায়ী খাবার কিনে খেতে হবে। মেয়ের জন্য একটি কেকের প্যাকেট আর মেয়ের মায়ের জন্য মাসালা চা নিলাম। বেল্ট বাঁধার সংকেত অনেক আগেই নিভে গেছে। চলছে তো চলছে ..... দুই ঘন্ট তো ফুরাচ্ছেই না। ট্রেনে গেলে লাগতো দেড় দিন। সেখানে মাত্র দুই ঘন্টায় পাড়ি দিচ্ছি .... তাও কেমন অস্থির লাগে। বাতাসের চাপ একটু একটু করে বাড়তে লাগলো ...... বুঝলাম বিমানটি নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। এনাউন্স করলো আর ৩০ মিনিটের মধ্যেই দিল্লীর গান্ধি এয়ারপোর্টে বিমানটি অবতরণ করবে। চমৎকার ল্যান্ডিং ......কোন ঝাকিই লাগলো না .......।

বিমান থেকে বের হয়ে বেশ ঠান্ডা লাগলো। দ্রুত মেয়ে কে নিয়ে বিল্ডিং এর মধ্যে ঢুকলাম। নিচে নেমে লাগেজ কালেকশন করে ট্রলি নিয়ে এগোলাম। একজন সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম প্রিপেইড ট্যাক্সি কোন দিকে। সে দেখিয়ে দিলো। আমি টিকেট কাউন্টারে গিয়ে বল্লাম পাহাড়গঞ্জ যাব। সে ৩২০ রুপি নিয়ে একটি স্লিপ ধরিয়ে দিলো। ব্ল্যাক ট্যাক্সি। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে দেখি অনেকেই খপাখপ ট্যাক্সি ধরে রওনা হচ্ছে। আমিও অবতীর্ণ হলাম ট্যাক্সি ধরার কাজে। ধরেও ফেল্লাম একটা। সে লাগেজ পত্র সব তুলে এগিয়ে চল্লো। রাত তখন ৯টা। দিল্লীতে এর আগে কখনোই আসিনি। সুতরাং রাস্তাঘাট কিছুই চিনিনা। কোনদিক দিয়ে যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আল্লাহই জানে। মনে মনে ক্রাইম পেট্রোল আর সাবধান ইন্ডিয়ার বিভিন্ন এপিসোডের দূর্ঘটনার কথা স্মরণ হচ্ছে ! অনেক রাস্তাতেই লেখা অমুক মর্গ, তমুক মর্গ। প্রথমে ভাবলাম কিরে! এদের কি সারা দিল্লী জুড়েই মর্গ বা সমাধী বা শ্মশান ঘাট টাট নাকি। পরে জেনেছিলাম মর্গ মানে রাস্তা। ;)

যাই হোক, আমি রাস্তার ডিরেকশন গুলো পড়ছিলাম। একসময় দেখি পাহাড়গঞ্জ লেখা ইন্ডিকেটর সাইনবোর্ড ...... মনে একটু সাহস এলো। যাক ড্রাইভার সাব ঠিক জায়গাতেই যাচ্ছে। জয়গাটা রেল ষ্টেশনের সাথে লাগোয়া। সে পাহাড়গঞ্জ এর একটি হোটেলের সামনে এসে গাড়ি দাড় করিয়ে দিলো। মেয়ের মা বল্লো এই হোটেল কেনো? আমাদের হোটেলের নাম তো এটা না। বুঝলাম কমিশন ব্যবসার পাঁঠা এখন আমরা। আমি সরাসরি ঐ হোটেলে ঢুকে হিন্দি ইংরেজী মিশিয়ে আমার বুকিং এর কাগজটা দেখিয়ে জানতে চাইলাম এই হোটেলটা কোথায়? রিসিপশনে দাড়ানো লোকটা একটু গড়িমসি করে বল্লো আপনি আমাদের হোটেলে থাকুন। আমাদের রুম দেখুন, এর ভাড়া আপনারটার তুলনায় অনেক কম। আমি বল্লাম ওরা আমার থেকে টাকা কেটে নেবে। সুতরাং ওখানেই থাকতে হবে। সে বল্লো ঐ হোটেল তো এখান থেকে ১০ কিঃমিঃ দূরে ....... ! একথা শুনে তো আমি বিস্মিত এবং অবাক হলাম। মেজাজও খারাপ হলো। বল্লাম ১০ কিমি হোক আর ২০ কিমি হোক আমি ঐ হোটেলেই উঠবো। তুমি চিন কিনা সেটা বলো। সে তখন মিউ মিউ করে ট্যাক্সির ড্রাইভারকে হোটেলর লোকেশনটা বলে দিলো। এরপর আমি বাইরে বের হয়ে আসলাম। লাগেজ তখনো ঐ ট্যাক্সিতে। এখন ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভার শুরু করলো আরেক খেলা। সে বলে তুমি আমাকে পাহাড়গঞ্জ আনতে বলেছ, এনেছি, এখন তোমার হোটেল আমি চিনি না, তুমি তোমার মতো করে খোজ করো। আমার †মজাজ তখনো গরম হয়ে আছে। আমি বল্লাম দাড়া তাই করবো। বলে বুকিং এর কাগজ থেকে আমার হোটেলের ফোন নাম্বারে ফোন করলাম। বল্লাম আমরা অমুক হোটেলের সামনে আছি, আপনাদের হোটেলটা কোথায়? তারা বল্লো ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ফোনটা দিন। আমি দিলাম। তাদের মধ্যে কতা বার্তা হলে সে কি কি শুনে ফোনটা রেখে দিয়ে বল্লো আবার ঘুরে উল্টো দিকে যেতে হবে। আমি বল্লাম চলো ...... ততক্ষনে কিছু লোকজনও জড়ো হয়ে গেছে। সে আবারো চলা শুরু করলো। কিছুই না, জাষ্ট কিছুদুর গিয়ে ইউ টার্ণ নিয়েই আমরা যে হোটেলের সামনে দাড়িয়ে ছিলাম, ঠিক তার বিপরীতেই, একটু এগিয়ে ....... !! আরে শালা ...... !!! এর জন্য এতো মামদোবাজি!! হোটেলের সামনে আসতেই গার্ড এগিয়ে এসে অভ্যার্থণা জানালো। আমি ট্যাক্সি বিদায় করলাম কিছু টিপস দিয়ে।

বুকিং আছে দেখে বিশেষ ঝামেলা হলো না রুম পেতে। তবে সমস্যা যেটা হলো, তাবৎ ভারত ভ্রমণের শেষ দিন অব্দি সেটা হলো এখানে এমেক্স কার্ডের ব্যবহার খুবই সিমিত। ভিসা বা মাষ্টার কার্ড ব্যপক প্রচলিত। সুতরাং আমাকে পরবর্তিতে এটিএম বুথ থেকে টাকা/রুপী তুলে খরচ করতে হয়েছে। দোকানে দোকানে কার্ড ব্যবহার করার সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি।


২২ তারিখ রাতে দেশের মাটিতে নিজের বিছানায় ছিলাম আর মাঝে ২৩ তারিখ কাটলো বাসে আর প্লেনে, ২৪ তারিখে রাত ১০টা নাগাদ হোটেলে বিছানার দেখা পেলাম। মেয়ে আমার ট্যাক্সিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। বিছানায় শুইয়ে দেয়ার পরেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। এতো রাতে আর কোথায় খেতে যাব! রুম সার্ভিসে ফোন করেই খাবার অর্ডার দিলাম। ভাত, রুটি, ডিম সব্জি। এর ফাকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আগামী কাল ঘোরাঘুরি করতে হবে। সুতরাং বেশী রাত জাগা যাবে না। যে ব্যক্তি খাবার নিয়ে এলো, সে বল্লো তার নাম মান্নান। বাংলায় কথা বলতে পারে, বাড়ি শিলিগুড়ি। ওকে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম ঘুরাঘুরির জন্য কিভাবে কি করা যায়। ও বল্লো হোটেলের রিসিপশনে কথা বল্লেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। নয়তো ও নিজেও ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। আমরা খেয়ে দেয়ে রুমে রাখা কফি বানালাম। সারাদিনের ধকল ক্লান্তি দূর করতে চা কফির বিকল্প নেই। খেয়ে শুয়ে পড়লাম। দিল্লী শহরের প্রথম রাত ঘুমিয়েই কাটালাম।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:২৯
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। স্বামীর কবরে শায়িত মতিয়া চৌধুরী, পেলেন না মুক্তিযোদ্ধার অন্তিম সম্মান

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০৪



আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে।

দুই দফা জানাজা শেষে মতিয়া চৌধুরীকে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর স্বামী বজলুর রহমানের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারের দোসরের স্বপ্ন ভাংগের বেদ্না.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০৬

ইতিহাস......

“জুলাই মাসের ১ তারিখ, ২০১৭' সকালবেলা আমার ব্যক্তিগত মোবাইলে একটা কল আসলো। নিজেকে তিনি প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি পরিচয় দিয়ে জানালেন, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেন?

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:১৭





"আমি মানসিক বিকারগস্ত লোক। সারাক্ষণ এনক্সাইটিতে বুক ধড়ফড় করে। মায়ের দেয়া কলে আমি খুবই ভয় পেয়ে যাই। বাবা কে আমার সহ্য হয়না। আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীনতার এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৮ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:২০

চাকুরির বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি....

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় সীমা ছেলেদের জন্য ৩৫ ও মেয়েদের জন্য ৩৭ করার সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ হতে চলছে। বিনয়ের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করে কয়েকটি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মতিয়া চৌধুরী lucky! শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, শেখ সেলিম, হাসানুল হক ইনু-রা ১০০ বছর বাঁচুক কামনা করি…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ১৮ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:১৪



১. মৃত্যু হলেই ইহজগতের সব কিছু শেষ হয়ে যায়। মৃত্যু পরবর্তী জগতে ঐ ব্যক্তির কী অবস্থা হয় তা আমরা জানি না। আবার ঐ ব্যক্তিও দুনিয়ার কিছু আর জানতে পারেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×