
বলা হয়ে থাকে জ্যাজ সংগীতই হলো বিশ্ব সংস্কৃতিতে আমেরিকার এক মাত্র স্বকীয় সংযোজন। এ পৃথিবীকে যৌনাচার, বোমাচার আর মিথ্যাচার ছাড়া আমেরিকা যদি ভালো কিছু দিয়ে থাকে তা হচ্ছে, "জ্যাজ সংগীত"। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে যদি কোন মরমী সৃষ্টি সুবিশাল এই প্রকৃতির লীলাভূমে হয়ে থাকে তা হচ্ছে, "জ্যাজ সংগীত"।
গৃহযুদ্ধের পর পর আমেরিকার চার মিলিয়ন কালো মানুষের মুক্তি এসে ছিল। এর অনেকেই তখন মনে রেখে ছিল আফ্রিকান সংগীত, তার তাল লয়। কাগজে কলমে মুক্তি পেলেও এরা তখনো ছিলেন এক প্রকার অস্পৃশ্য, অবাঞ্চিত, অসহায়, একা। যেন সাদা মানুষের ব্যাবহারের অযোগ্য। তেমনি উচ্ছিষ্ট এদের আনন্দ বেদনা-প্রার্থনা।

সাদা মানুষের অযোগ্য ফেলে দেয়া পিয়ানো বাঁজিয়ে কালো মানুষেরা দুঃখের যে সুর তুলে ছিল, তার নাম 'জ্যাজ'। ভাঙ্গা এবরো থেবরো ট্রাম্পেট আর ক্লারিনেটে যে দুঃখের সুর এক দিন বাঁজিয়ে ছিল, তার নাম 'জ্যাজ'। রং চটা মলিন সেক্সোফোনে যে করুন দুঃখ বেজেছে এক দিন, তাকেই আমরা 'জ্যাজ' বলে জানি। শোষকের আঙ্গিনায় পড়ে থাকা ভাঙ্গা বাদ্যযন্ত্রে নিজের কষ্টকে উচ্চারণ করে করে এক দিন সৃষ্টি হয়ে ছিল আধুনিক দুনিয়ায় আমেরিকান সংস্কৃতির এক অনন্য অবদান। জ্যাজ।
আফ্রিকান রিদমের সাথে ইউরোপিয় উচ্চাঙ্গ সংগীত কখন যে মিলে মিশে একাকার হয়, বুঝে ওঠার আগেই এক বিপুল ভালোলাগায় আক্রান্ত হয়ে যেতে হয়। আনন্দ প্রার্থনা আর বেদনার বিষয় গুলো মিলে মিশে অদ্ভূত মূর্ছনা যেনো এক। কখনো বলে পৃথিবীর কথা, জননীর কথা। কখনো ফুটে ওঠে প্রেম অথবা মৃত্যু। কখনো ক্ষোভ। এ সকল কিছুর সম্মিলিত নাম 'জ্যাজ'।

গত রোববার ৬ জুলাই রাতে কানাডার সাস্কৃতিক রাজধানী মন্ট্রিয়লে শেষ হলো বাৎসরিক আন্তর্যাতিক জ্যাজ উৎসবের ২৯ তম আসর। ৬দিনের ঝটিকা কর্ম সফর শেষে সোমবার বিকেলে এম ট্রাকে করে ফিরলাম প্রিয় শহর মন্ট্রিয়লে। বোনাভেঞ্চার ট্রেন ষ্টেশন থেকে ট্যাক্সি ছুটছিল ভয়েজার বাসটার্মিনালের উদ্দেশ্যে। মোট ১২ ঘন্টা ট্রেন জার্নি শেষে গন্তব্য কানাডা'র রাজধানী অটোয়ায় ফিরতে তখনো ঘন্টাদুয়ের পথ বাকী। পরিচিত নগরীতে তখন সোনালী রোদের উজ্জল অপূর্ব এক সন্ধ্যা। ট্যাক্সিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম কাল রাতেই শহরে জ্যাজ ফেষ্টের পর্দা পড়ে গেছে এ বছরের মতো। মনে হলো এমন রোদেলা বিকেলে কোথা হতে যেনো সেক্সোফোনের করুন এক সুর ভেসে এলো আমার জন্য! এমন বিকেলে প্রিয়তমা নগরীকে হৃদয় নিংড়ানো সম্ভাষন জানিয়ে বললাম, বঁজ্যু মরিয়াল।
জীবনে প্রথম সামনাসামনি জ্যাজ কনসার্ট দেখার ভাগ্য হয়ে ছিল ১৯৮২ সালে। শিল্পকলা একাডেমিতে আমেরিকান এক জ্যাজ দল পারফর্ম করে ছিল সেবার। বহু কষ্টে ইউসিস থেকে টিকেট জোগাড় করে আমেরিকান ব্যান্ডের কন্সার্ট দেখতে গিয়ে বলে ছিলাম এ কেমন ঝিমাইন্না গান! বলাই বাহুল্য সে সময় আমার মতো বালকের জ্যাজের মরমী পরিচয় বোঝারো কথা নয়।

এর সাত বছর পর মন্ট্রিয়লে এসে জ্যাজকে আবিষ্কার করি ভিন্ন এক জনপদে তার স্বমহিমায়। তখনো জ্যাজ আমার তেমন লাগতনা ঠিকই কিন্তু ডাউন টাওনের এক গ্রীক রেস্তোরায় কাজ করে বাড়ী ফেরার পথে প্রতিরাতের উৎসব শেষে পথে পড়ে থাকা বীয়ারের ক্যান পানির বোতল কাগজের ঠোঙ্গা পায়ে হটিয়ে হটিয়ে যখন এপার্টমেন্টে ফিররতাম তখন নিজেকে বড় বেশী কৃতদাস কৃতদাস মনে হতো। হয়তো সেই থেকে আস্তে আস্তে জ্যাজ নিজের অজান্তেই আমারো সংগীত হয়ে উঠছিল। এর ক'বছর পর সিনেমা আর টেলিভিশন পড়তে যেয়ে মিউজিকলজি কোর্সে পড়বার ভাগ্য হয় আমার জ্যাজের আদি ইতিহাস।
প্রতি বছর জুনের শেষ আর জুলাইয়ের শুরু মিলিয়ে টানা দু'সাপ্তাহ জুড়ে আন্তর্য্যাতিক জ্যাজ উৎসব নামে বিশাল এক গৃষ্ম গানের মেলা বসে মন্ট্রিয়লের ডাউন টাওনে। এটি বিশ্বের সবচে বৃহৎ জ্যাজ সংগীতের উৎসব হিসেবে পরিগনিত এখন। এ বছর ইনডোর আউটডোর মিলিয়ে মোট ৭২৫ টি শো হয়েছে সারা উৎসবে। এবছর দর্শনীর বিনিময়ে করা ইনডোর শো গুলিতে সব মিলিয়ে সর্বমোট টিকেট বিক্রি হয়েছে ৬ মিলিয়ন ডলারের এক লক্ষ আঠাশ হাজারটি। এ বছর জ্যাজ উপলক্ষ্যে সাধারন দর্শকরা ব্যায় করেছেন মোট দশ মিলিয়ন ডলার। এবছর এ উৎসবের মোট বাজেট ছিল ২৫ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশী।

বরাবরের মত এবারো জ্যাজ ভিন্ন একই উৎসবে বসেছিল বিশ্ব লোকজ সংগীতের আসর। (ভারতীয়রা আরবীরা বেশ ক'বছর ধরেই এ উৎসবে পার্ফম করে যাচ্ছে নিয়মিত। বাংলাদেশের কোন উৎসাহী নাগরিক শিল্পী ইচ্ছে করলে আমাদের নিজস্ব লোকজ সংস্কৃতি এ ধরনের একটি আন্তর্যাতিক মঞ্চে তুলে ধরার চেষ্টা করতে পারেন। আমাদের দেশীয় বাউল ফকিরদের উপস্থাপনা এমন একটি আন্তর্যাতিক মঞ্চের দর্শকদের অবিভূত করবেই, এতে ভিন্ন ভাবনার কোন অবকাশ নেই।) এ উৎসব সম্পর্কে যে কোন তথ্যের জন্য এই http://www.montrealjazzfest.com ওয়েব সাইটটি ঘুরে দেখতে পারেন।


শুভেচ্ছা সবাইকে। হ্যাপি ব্লগীং

ছবি সৌজন্য: লিংন্ক ১, লিংন্ক ২ ও লিংন্ক ৩

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৪ রাত ১২:৫৩