আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম লিভারপুল বন্দর থেকে। মধ্যরাতে জাহাজে উঠতে হয়েছিল বলে বন্দরের চেহারাটা ঠিকমতো দেখার অবকাশ ছিল না। আমরা ছিলাম ১২টি দেশের শিক্ষার্থী। সাথে ছিলেন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষক ও তাদের একজনের স্ত্রী। ভদ্রমহিলার স্বামী ছিলেন ধার্মিক ক্রিশ্চিয়ান। তিনি এর আগে একটি চার্চের মিনিস্টার ছিলেন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই ছিলেন বেশ অমায়িক ও বিনয়ী। তাদের কাছেই জানলাম জাহাজে আইরিশ সাগর পাড়ি দিতে হবে। চওড়া প্রায় ২০০ কিলোমিটার। জাহাজে সমুদ্রভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার এটাই প্রথম। তাই বেশ ঔৎসুক্য অনুভব করছিলাম।
ব্রিটিশ কারিগরি সহযোগিতা কর্মসূচির আওতায় ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পলিসি ম্যানেজমেন্টে (আইডিপিএম) অধ্যয়নকালে শিক্ষাসফরের অংশ হিসেবে আইরিশ রিপাবলিক সফরের এ সুযোগ। এর আগের বছরে যাওয়া হয়েছিল বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসে।
শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আফসোস করছিল কেন আমাদেরও ওই দুটো দেশ সফরে নেয়া হলো না। তাদের মতে, আইরিশ রিপাবলিক বা আয়ারল্যান্ড হচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে গরিব দেশ; সেটাকে আবার দেখার কী আছে? আমার মধ্যে অবশ্য বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। কারণ যেকোনো একটি নতুন দেশ দেখার আনন্দই আলাদা।
রাত ১২টার দিকে জাহাজ যাত্রা করল। বিশালকায় জাহাজ। আছে নানারকম সুযোগ-সুবিধা। সিনেমা হল রয়েছে ছয়টি। আছে সুইমিংপুল, বার, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। কেবিনে ঘুমাতে চেষ্টা করছিলাম; কিন্তু বিশাল ঢেউ যখন বিশাল জাহাজকে আন্দোলিত করছিল, তখন শঙ্কা ও শিহরণ উভয়ই আমাকে নির্ঘুম করে দেয়। জ্যোৎস্না রাত ছিল। ফলে সাগরের পর্বতসম ঢেউগুলো দেখতে পেরেছিলাম পরিষ্কারভাবে। আমি নিজে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দা বলে সাগর দেখেছি কত! তবে এভাবে বড় জাহাজের যাত্রী হয়ে ঢেউয়ের পর ঢেউ পেরিয়ে অচেনা দেশে পাড়ি জমানোর মজাই ছিল আলাদা। জাহাজের গন্তব্য ছিল আইরিশ রিপাবলিকের রাজধানী ডাবলিন। আমরা পৌঁছে গেলাম সূর্যোদয়ের আগে।
আয়ারল্যান্ড এক মজার দেশ। এ দেশের লোক সারা বছরে একনাগাড়ে সাত দিন সূর্য দেখার সুযোগ পায় না। তার ওপর ছিল শীতকাল। কবে তারা সূর্যালোক দেখেছে মনে নেই। আমরা ডাবলিনে অবতরণ করতেই ঝলমলে সূর্যের আলো, একেবারে পরিচ্ছন্ন সকাল। স্বাগতিক আইরিশরা বলল, তোমরা সৌভাগ্যবান সূর্যের আলো সাথে নিয়ে এখানে এসেছো। সত্যিই সৌভাগ্য আমরা দুই সপ্তাহ সে দেশে অবস্থানকালে এক সপ্তাহই ঝলমলে রোদে কাটিয়েছি। এরপর অবশ্য প্রচণ্ড শীতের যে তাণ্ডব দেখেছি সেটি পরে বলব।
ডাবলিন নগরী বেশ ছিমছাম, বিশেষ কোনো জৌলুশ নেই। রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড়ও তেমন নেই। লন্ডনকে যেমন ব্যস্ত নগরী মনে হয়, ডাবলিন সে তুলনায় একেবারে শান্ত-সৌম্য। নগরীর ভবনগুলোতে ঐতিহ্যের ছাপ থাকলেও আধুনিকতার বাহারি নেই। আকাশচুম্বী ভবনও বেশি নেই।
আমাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানকার কাফেটেরিয়ায় প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা ছিল। প্রথমেই এক নতুন অভিজ্ঞতা। বহুবিধ খাবারের আইটেম। তবে তার ৯০ শতাংশই আলুর তৈরি। আলু আইরিশদের প্রধান খাদ্য। কত শত প্রকারের খাবার যে আলু দিয়ে তৈরি হয় তার সীমা নেই। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না কোনটা রেখে কোনটা নেবো। ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের জন্য একটি লেকচার সেশনের আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখতে তেমন আহামরি কিছু নয়; তবে বেশ পরিচ্ছন্ন ও সুবিন্যস্ত। ডাবলিনে সে দিন ছিল আইরিশদের কোনো এক জাতীয় অনুষ্ঠান। দেখলাম রাজপথে বেরিয়েছে সুদৃশ্য শোভাযাত্রা। অগ্রভাগে বাদক দল ও নৃত্যশিল্পীরা। সুর ও নৃত্যের মূর্ছনায় সৃষ্টি হয়েছিল এক অভাবনীয় আমেজ ও আবহের। আমরা চোখ ভরে উপভোগ করলাম। আইরিশরা যে সাংস্কৃতিক দিক থেকে বেশ অগ্রসর তা এ অনুষ্ঠান থেকেই বোঝা গেল।
আয়ারল্যান্ড একটি ছোট্ট দেশ আয়তন মাত্র ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। চার পাশে পানি উথাল-পাথাল করে। রয়েছে অসংখ্য পাহড়-পর্বত, বেশ কয়েকটি নদী এবং অনেক হ্রদ। দক্ষিণে ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর; আড়াই হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করলেই আমেরিকা। এর মাঝে আর কোনো দেশ নেই। পূর্বে আইরিশ সাগর। উত্তরে উত্তর সাগর। দ্বীপটির এক-ষষ্ঠাংশ ব্রিটেনের অধীনে। এ অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড নামে পরিচিত। আয়ারল্যান্ড আমাদের মতোই ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল দীর্ঘদিন। মাত্র ১৯২১ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর এটি আইরিশ রিপাবলিক নামে পরিচিতি লাভ করে।
এদের রয়েছে নানা দুঃখের করুণ ইতিহাস। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নির্যাতনে এরা বারবার পর্যুদস্ত হয়েছে। আয়ারল্যান্ডের মাটি চাষবাসের জন্য খুব একটা উপযোগী নয়। পাথর আর কঙ্কর মিশ্রিত থাকায় ফসল ফলানো কঠিন। তবে কিছু এলাকায় আলুর চাষ হয়। ব্রিটিশ অধিকৃত উত্তর আয়ারল্যান্ড অপেক্ষাকৃত উর্বর এবং এখানে আলুসহ নানা ধরনের ফসল ফলে। এ জন্যই এ এলাকার প্রতি ব্রিটিশদের বরাবর আকর্ষণ ছিল। ১৮৪০-এর দশকে আয়ারল্যান্ডে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। কয়েক বছর আলু ও অন্যান্য উৎপাদন মারাত্মক মার খায়। এক ধরনের রোগে আলু পচে যায়। খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এতে প্রায় ১০ লাখ লোক মারা যায়। এ সময়ে উত্তর আয়ারল্যান্ডে খাবার থাকলেও ব্রিটিশরা তাদের তা দেয়নি। অসংখ্য আইরিশ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়। ভাগ্যান্বেষণে নৌকায় করে আমেরিকায় যাওয়ার পথে কয়েক লাখ লোক মারা যায়। যারা জীবন নিয়ে সে সময়ে আমেরিকায় পৌঁছতে পেরেছিল, তারা সেখানে বসতি গড়ে। প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের পিতৃপুরুষ এভাবেই আমেরিকায় পৌঁছেছিল।
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও রয়েছে পার্থক্য। আইরিশরা প্রধানত ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ান। এরা খুবই ভদ্র, নম্র ও অতিথিপরায়ণ। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্যাথলিক ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। ধর্মীয় কারণে এখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নিষিদ্ধ। এখানে প্রকাশ্যে বৈধভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিক্রি হয় না। আইরিশরা পরিবারকে প্রাধান্য দেয়। প্রতিটি পরিবারে শিশুদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এমনকি এরা হোটেল-রেস্তোরাঁয় পরিবারের শিশুদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে। ব্রিটিশদের মধ্যে এটা দেখা যায় না। ব্রিটিশদের পরিবারে শিশুসংখ্যা যেমন কম, তেমনি ওরা শিশুদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় বা কোনো পার্টিতে তেমন একটা যায় না। ব্রিটিশদের প্রতি আইরিশদের একটা ক্ষোভ ও ঘৃণা আছে। সম্ভবত এর পেছনে ঐতিহাসিক কারণই দায়ী।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকাকালে আইরিশদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তা তারা আজো ভুলতে পারেনি।
আয়ারল্যান্ড দেশ হিসেবে বেশ ছোট। মানচিত্রে দেখতে লম্বাটে। উত্তর-দক্ষিণের দৈর্ঘ্য মাত্র ৪৬৫ কিলোমিটার এবং পাশে মাত্র ২৮৫ কিলোমিটার, বলা যায় বাংলাদেশের অর্ধেক। বড় শহর বলতে ডাবলিন, যেখানে জনসংখ্যা মাত্র ছয় লাখের মতো। উল্লেখ করার মতো অন্যান্য শহর হলো : কর্ক, গলওয়ে, লিমেরিক ও ওয়াটারফোর্ড। আয়ারল্যান্ডের মোট জনসংখ্যা মাত্র ৪০ লাখের কাছাকাছি।
মজার ব্যাপার হলো একটা পর্যায়ে দেশটির জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছিল। ১৮৪১ সালে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮২ লাখ। দুর্ভিক্ষে মৃত্যু ও দেশান্তরের কারণে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত এ দেশের জনসংখ্যা কেবলই কমছিল। এ সময়ে জনসংখ্যা নেমে আসে ২৮ লাখে। এর পর থেকে আবার বাড়তে বাড়তে এখন ৪০ লাখে পৌঁছেছে। এদের রাষ্ট্রভাষা দুটো : ইংলিশ ও আইরিশ গ্যালিক। গ্যালিক তাদের নিজস্ব ভাষা; কিন্তু ব্রিটিশদের প্রভাবে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। আইরিশ সরকার গ্যালিককে বিশেষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও তাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আইরিশদের জাতীয় পতাকার তিনটি রঙ; এর মধ্যে দুটো রঙ দুটো ধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে। সবুজ রঙ রোমান ক্যাথলিক এবং কমলা রঙটি প্রোটেস্ট্যান্টদের। সাদা রঙটি ঐক্যের প্রতীক।
ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচি শেষ করে আমরা বাসে চেপে যাত্রা করলাম আটলান্টিকের পশ্চিম তীরের গ্যালওয়ে শহরের উদ্দেশে। আঁকাবাঁকা সড়ক পেরিয়ে বিকেলেই পৌঁছে গেলাম মহাসাগরের তীরে। আমরা যে ছোট্ট হোটেলে উঠলাম সেটি একেবারে সাগরের তীরে। হোটেলের ব্যালকনি থেকে দেখা যায় অদূরের জনবসতিবিহীন ছোট ছোট দ্বীপ। ওই সব দ্বীপের আড়ালে থাকায় আটলান্টিকের বড় বড় ঢেউ তীব্র বেগে তীরে আসতে পারে না। পরিষ্কার আকাশের পড়ন্ত বিকেলে মহাসাগরে সূর্যডুবির দৃশ্য যে কত সুন্দর হতে পারে তা না দেখলে বোঝানো যাবে না। এ অপরূপ দৃশ্য দেখে আমি যেন অজানার জগতে হারিয়ে যাই। সন্ধ্যার আগে সাগরতীরে কনকনে শীতের মধ্যেও নির্মল বায়ুর স্পর্শ নিতে আমরা ভুল করিনি। হোটেলে ফিরে লবিতে বসে শুরু হয় বন্ধুদের আড্ডা। নানা আলোচনায় অবশেষে চলে আসে ধর্মীয় বিষয়। নেপালের বন্ধু পুষ্পা সাখিয়া একনিষ্ঠ ধর্মাচারী বৌদ্ধ। গৌতম বুদ্ধের দর্শনকে পুরোপুরি অনুশীলন করেন; কিন্তু স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন না। নানা বিতর্ক শেষে সে আর পেরে উঠতে পারেনি। সে বিষয়ে আর বিস্তারিত যাচ্ছি না।
সন্ধ্যার পর সবাই মিলে বেরোলাম রেস্টুরেন্টের খোঁজে ডিনার করব বলে। পাকিস্তান ও নেপালের বন্ধুরা মিলে যে রেস্টুরেন্টে যা-ই দেখি, শুধুই আলুর খাবার। কয়েক দিন ধরে আলুর খাবার খেতে খেতে হাঁপিয়ে উঠলাম। মনে আছে দু’সপ্তাহ পরে উত্তর আয়ারল্যান্ডের লন্ডন ডেরি শহরে গিয়ে একবেলা ভাতের সন্ধান পেয়েছিলাম। সে দিন রাতের ডিনার সেরে আমরা কয়েকজন মিলে গিয়েছিলাম একটি ক্লাবে আইরিশ কালচার সম্পর্কে ধারণা নিতে। কিন্তু সে ক্লাবে বেশিক্ষণ টিকতে পারলাম না। অ্যালকোহল ও সিগারেটের গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তবে ওদের ফোক মিউজিক বেশ ভালো লাগছিল। মনে হলো, রাস্তাঘাটে সর্বত্র একটা প্রশান্ত পরিবেশ। প্রায় সব রেস্টুরেন্টেই দেখলাম আইরিশরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পারিবারিক পরিবেশে তাদের ডিনার সেরে নিচ্ছে। এ দৃশ্য সাধারণত ব্রিটেনে দেখা যায় না, যা আগেই বলেছিলাম।
আমরা গ্যালওয়েতে প্রায় এক সপ্তাহ ছিলাম। ইতোমধ্যে লিমেরিক ও শ্যানন নদীতীরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা ভিজিট করে নানাবিধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম। আইরিশরা জীবনের নানা দুর্যোগ পেরিয়ে এখন অনেকটাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রচুর শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। কাছেই শ্যানন বিমানবন্দর; এখান থেকেই বহু উড়োজাহাজ ডানা মেলে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা যাওয়ার জন্য।
বিমানবন্দরের পাশেই এক রেস্তোরাঁয় গেলাম লাঞ্চ করতে। একই অবস্থা। এখানেও সেই আলু আর আলু। সে দিন মেনুতে চিংড়ি দেখে আমি এবং পাকিস্তানের নাসির বেশ খুশি হলাম। ভাবলাম আজ একটু ভিন্ন স্বাদ নেয়া যাবে। দু’জনে মিলে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে খাবারের অর্ডার দিলাম। টেবিলে খাবার দেয়া হলে আমাদের চক্ষু তো চড়কগাছ। স্রেফ কাঁচা অসিদ্ধ চিংড়ি সালাদ ও মেয়োনিজের সাথে খেতে দেয়া হয়েছে। আমরা কাউকে কিছু না বলে একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর মুচকি হাসছিলাম। ভাবছিলাম কী করা যায়। দাম বেশ। ফলে অপচয় করতে মন চাচ্ছিল না। আমি ঠিক করলাম যে করেই হোক সালাদ ও মেয়োনিজ দিয়ে খেয়ে ফেলব। যা ভাবার তাই করলাম। নাসির বলল, আমি ভাই খেতে পারব না। তার পয়সাটা জলে গেল আর কি।
রাতে গরম করা হোটেল রুমে টের পেলাম শীতের তীব্রতা। পরের দিন যাত্রা একবারে উত্তর দিকে ডোনেগাল হয়ে উত্তর সাগরের পাড়ে। সে দিন সকাল থেকেই আবহাওয়া খুব খারাপ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সাথে জোরালো বাতাস ছুটে আসছে আটলান্টিক থেকে। মধ্যাহ্ন পেরোতে না পেরোতেই পথে তুষারপাত। রাস্তায় তুষার জমে যাওয়ায় গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছিল। পার্বত্য এলাকার উঁচুনিচু পথ অতিক্রমকালে মাঝে মধ্যে আমরা আটলান্টিকের ভয়াল দৃশ্য দেখতে পেলাম। আয়ারল্যান্ডের বিশাল এলাকা পাথর আর পাহাড়-পর্বতে ঢাকা। আটলান্টিকের তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি পাহাড়। সে পাহাড়ে আছড়ে পড়ছে মহাসাগরের দৈত্যসম এক একটা ঢেউ।
শুনেছি আটলান্টিকের রয়েছে আগ্রাসী চরিত্র; যেখানে প্রশান্ত মহাসাগর যেন আসলেই প্রশান্ত। সাগর তখন এতটাই উত্তাল যে আশপাশে কোনো নৌযান চোখে পড়ল না। এ দিকে রাস্তায় বরফের নিবিড়তা যেন বেড়েই চলেছে। গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে গেছে। রাস্তায় কোনো যানবাহনও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে আমাদের গাড়ি গেল বিকল হয়ে। বাইরে অবিরত তুষার ঝরছে। আশপাশে কোনো বাড়িঘর দেখা গেল না। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। তীব্র শীতে গাড়িতেও হাত-পা যেন জমে যাচ্ছিল। পাশেই সমুদ্রের গর্জন। আমরা আড়ষ্ট হয়ে মুক্তির প্রহর গুনছিলাম। ভাবলাম গাড়ি সচল না হলে আমাদের সামনে বড় বিপদ অনিবার্য। মহান স্রষ্টা আমাদের আকুতি শুনলেন; কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িটি চালু হলো। সন্ধ্যা হতে না হতেই আমরা পৌঁছে গেলাম একটি ছোট্ট শহরে যার নামটি মনে নেই। মনে হলো ২০০ বছর আগে আমেরিকানরা ঘোড়ার গাড়িতে করে দূরের যাত্রায় যেমন পথে পথে পান্থনিবাসে যাত্রাবিরতি করত তেমনি একটি ছোট্ট হোটেলে আমরা জায়গা পেলাম। সেখানেও শীত; হিটারও ভালো কাজ করছিল না। শীতের কারণে রাতে ভালো ঘুম হলো না।
সকালে নাশতা সেরে আবার যাত্রা শুরু। মনে হচ্ছিল প্রতিকূল পরিবেশের জায়গাটা যত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাওয়া যায় ততই ভালো। এদিন আবহাওয়াটা অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল। আকাশ মেঘলা থাকলেও বৃষ্টি ছিল না। দুপুর নাগাদ আমরা এক পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামলাম। আমাদের গাইড বললেন ইউরোপের অন্যতম বিখ্যাত সি-বিচটি দেখে যাও। নামটি আজ আর মনে নেই। তবে এটি যে ডোনেগাল বদ্বীপে অবস্থিত সেটুকু মনে আছে। এত ঠাণ্ডায় সি-বিচ দেখার কি কোনো মজা আছে! তবু দেখলাম কিছু লোক সেখানে আছে। কিন্তু সি-বিচটি এতই ছোট এবং অনাকর্ষণীয় যে, আমার হাসি পেল। আমাদের কক্সবাজার বা কুয়াকাটার সাথে তার কোনো তুলনাই চলে না। আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর যে অনুপম দান দুটো বড় সমুদ্র সৈকত তা পৃথিবীর বহু দেশের মানুষের ভাগ্যেই নেই। আমাদের দেশের আবহাওয়াটাও কত চমৎকার। যেকোনো মৌসুমেই সমুদ্রতীরে যাওয়া যায়।
সি-বিচের এক রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সেরে আবার গাড়িতে চলা শুরু হলো। এবারে আমরা বিকেল নাগাদ পৌঁছলাম উত্তর সাগরের তীরে। ডান দিকে ব্রিটেনের স্কটল্যান্ড আর পূর্ব কোণে ডেনমার্ক ও নরওয়ে। জায়গাটি আয়ারল্যান্ডের সর্বশেষ উত্তর প্রান্ত। সাগরতীরে বালু নেই; শুধু কাদা আর কাদা। বেশ কিছু জেলেবোট দাঁড়িয়ে আছে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। কিছুই ভালো লাগল না। পাহাড়ের ঢালে সাগরের পাড়ে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত কিছু ঘরবাড়ি দেখা গেল। মনে মনে ভাবলাম তবুও এখানে মানুষ বাস করে, তাদের জীবনও চলছে। এরূপ প্রাণচাঞ্চল্যহীন একটি এলাকা দেখে নিজ মাতৃভূমির অপরূপ সৌন্দর্য আর সহজ জীবনযাত্রার কথা বার বার মনে পড়ছিল। এরপর আমাদের জানানো হলো যে, আশপাশে কিছু ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। আমরা এরূপ একটি শিল্প এলাকায় গেলাম। আমরা কয়েকটি পশম শিল্প দেখলাম। কিছুটা সস্তায় অরিজিনাল উলেন স্যুটপিসও কিনলাম।
এরপর আমাদের যাত্রা উত্তর আয়ারল্যান্ডের সীমান্ত শহর লন্ডন ডেরিতে। এ ছোট্ট শহরটি একটু ঘুরে দেখার পর আমাদের বাস রওনা হয় বেলফাস্টের দিকে। আশির দশকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সর্বত্র চলছিল যুদ্ধাবস্থা। গেরিলা সংগঠন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ) ব্রিটিশ সরকারের আধিপত্য থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করছিল। আবার এ লড়াই ছিল অনেকটা ধর্মভিত্তিক।
আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ছিল ক্যাথলিক এবং তারা প্রোটেস্ট্যান্ট ব্রিটিশদের শাসন মেনে নিতে পারছিল না। সশস্ত্র যুদ্ধ চলছিল অনেক দিন ধরে। প্রায় প্রতিদিন বহু হতাহত হচ্ছিল। হাজার হাজার ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছিল। বেলফাস্টে প্রায় প্রতিদিন বোমা ফুটছিল। কার্ফ্যু জারি হতো প্রায়ই। প্রোটেস্ট্যান্ট আবাসিক এলাকায় চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছিল। আমরা বিকেলের দিকে যখন বেলফাস্টের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছি তখন চার দিকে একটা মহা আতঙ্ক; মানুষ দ্রুত ছুটে চলছে যার যার গন্তব্যে। আমাদের শিক্ষকরা বললেন, আমরা কিছুক্ষণের জন্য একটা রেস্তোরাঁয় চা পান করে দ্রুত বিদায় নেবো। কিন্তু পরিবেশ এমনই আতঙ্কের ছিল যে, আমাদের সাথের নারী শিক্ষার্থীরা রাজি হলো না। তারা একদম কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওরা বলল চা পানের দরকার নেই; তাড়াতাড়ি এ এলাকা ছেড়ে পালাও। ড্রাইভার যেন পড়িমরি করে বাস ছেড়ে দিলো।
সেই উত্তর আয়ারল্যান্ডে এখন আর গেরিলা যুদ্ধ নেই। ২০০৫ সালে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা হয়েছে। আইআরএ অস্ত্র পরিহার করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে।
একটা মজার ঘটনা দিয়ে আয়ারল্যান্ড সফরের কাহিনী শেষ করছি। আমার ধারণা ছিল যে, আমাদের উপমহাদেশের মতো মাজার-দরগা সংস্কৃতি বোধ হয় আর কোথাও নেই; বিশেষ করে ইউরোপের কোনো দেশে এর অস্তিত্ব হয়তো আদৌ নেই। আমার ভুল ভাঙল যখন আমরা ফেরার পথে এক জনবসতি নেই এমন একটি এলাকায় অবস্থিত একটি ক্রিশ্চিয়ান চার্চে পৌঁছলাম। দেখলাম ওই চার্চকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো একটি টাউন গড়ে উঠেছে। অনেকটা আমাদের দেশের মাজার-দরগার মতো।
চার্চের প্রবেশপথে আমাদের দেশের মতোই অসংখ্য মোমবাতি, আগরবাতি ইত্যাদির দোকান। এতে আবার ক্রুশ, বাইবেল ও যিশুর মূর্তিও পাওয়া যায়। আমি ভাবতে লাগলাম যে, কুসংস্কারবাদী মানুষ সব দেশে সব সমাজেই আছে। আমাদের গাইড জানালেন, কয়েক বছর আগে কারা নাকি এখানকার আকাশে কিছু ফেরেশতাকে ডানা মেলে থাকতে দেখেছেন। তারই স্মরণে বা শ্রদ্ধার্ঘে এখানে বিশাল ক্রিশ্চিয়ান চার্চ ও সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। এটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিক ধর্মযাজকরা ভ্যাটিকানের পোপকেও ওই স্থানটি ভিজিট করতে অনুরোধ জানান। ভ্যাটিকানের পোপ একে প্রথমে স্বীকৃতি দিতে চাননি। কিন্তু পরে আইরিশ ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের পীড়াপীড়িতে তিনি সেখানে যেতে বাধ্য হন। আমরা সেন্টারটির সৌন্দর্য ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা ঘুরে দেখলাম এবং কিছু কেনাকাটা করলাম। অবশেষে ভ্রমণ শেষ করে এবার ফেরিতে করে অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের স্কটল্যান্ডের বন্দরে অবতরণ করলাম।