somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ছায়াছবির প্রতিষ্ঠালগ্নের শক্তিমান অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের ৫১তম মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১১ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত চরিত্রাভিনেতা ছবি বিশ্বাস। প্রকৃত নাম শচীন্দ্রনাথ। বাংলা চলচ্চিত্রের একজন বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতা। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায জলসাঘর, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, তপন সিংহের পরিচালনায কাবুলিওযালা উল্লেখযোগ্য। এছাডাও তিনি বহু বাণিজ্য সফল চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয করেছেন। তিনি মঞ্চঅভিনয়েও বিখ্যাত ছিলেন। সমাজ, ধাত্রীপান্না, মীরকাশিম, দুইপুরুষ, বিজযা প্রভৃতি নাটকে ছিলো তাঁর উল্লেখযোগ্য অভিনয়। অভিনয় ছাড়াও তিনি "প্রতিকার" (১৯৪৪) এবং "যার যেথা ঘর" (১৯৪৯) ছবির পরিচালকও ছিলেন। তবে পরিচালক হিসেবে তিনি বিশেষ সাফল্য লাভ করতে পারেননি। আজ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে, ১৯৬২ সালের ১১ জুন একটি অনাকাঙ্খিত মোটর দুর্ঘটনায় তিনি স্তব্ধ হয়ে ছিলেন চিরকালের মতো। আজ তাঁর ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী। মুত্যুদিনে কিংবদন্তি এই অভিনেতার জন্য আমাদের গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।


ছবি বিশ্বাস ১৯০০ সালের ১৩ জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ভূপতিনাথ। ছবি বিশ্বাসারেস পরিবার ছিলো কলকাতার নিবাসী। যাত্রা ও থিয়েটারে বরাবরই উত্সাহ ছিল ছবি বিশ্বাসের। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় এমেচার থিয়েটার করেছেন শিশির ভাদুড়ী নরেশ মিত্রের মত বড় বড় অভিনেতাদের সঙ্গে। ১৯৩৮ সাল থেকে তিনি পেশাদার হিসেবে নাট্যনিকেতনে যোগ দেন। এমেচার নাটক দিয়ে জীবন শুরু করলেও পেশাদারী রঙ্গমঞ্চেও তিনি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ":দেবদাস, কাশীনাথ, সিরাজ-উদ-দৌলা," ইত্যাদিতে নাটকের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন তিনি। এছাড়া সমাজ, দুই পুরুষ, বিজয়া, ইত্যাদি নাটকেও তাঁকে আমরা তার অভিনয় দেখতে পেয়েছি। যদিও শেষের দিকে ব্যস্ততার জন্য মঞ্চাভিনয়ে ততটা সময় দিতে পারেন নি ছবি বিশ্বাস।


ছবি বিশ্বাস পেশাদার অভিনেতা হিসেবে চিত্রজগতে এসেছেন অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ”অন্নপূর্ণার মন্দির” চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রের রূপালী আকাশে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ করনে। এর পর অজস্র ছবিতে অভিনয় করেন ছবি বিশ্বাস। প্রথম দিকের কয়েকটিতে নায়কের চরিত্রে - পরে পাশ্বচরিত্রে। অসামান্য দক্ষ অভিনেতা ছবি বিশ্বারেস অভিনীত কয়েকটি স্মরণীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম ”চোখের বালি”, ”কাবুলিওয়ালা”, ”শুভদা”, ”প্রতিশ্র“তি”, ”জলসাগর”, ”দেবী, সবার উপরে”, ”কাঞ্চন-জঙ্ঘা”, ”হেডমাস্টার” ইত্যাদি। ১৯৩০ থেকে ১৯৬০-এর দশকজুড়ে তিনি একাদিক্রমে বহু বাংলা চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করে যান এবং ব্যাপক দর্শকনন্দিত হন।


ছবি বিশ্বাস ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের ছেলে। জমিদারী গেলেও তাঁর মেজাজটা তাঁকে কোনদিন ছেড়ে যায় নি। ”ছবি বিশ্বাস ছিলেন লাস্ট অফ দ্য এরিষ্টোক্রাটস"। তা কী অভিনয়ে, কী পারিবারিক চালচলনে।" ছবি বিশ্বাস মূলত সাহেবী এবং রাশভারি ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য খ্যাতিলাভ করেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই নিছকই এক চরিত্রাভিনেতা থেকে একটি বিশিষ্ট রূপকল্পে পরিণত হয়ে ছিলেন। যে কোনো চরিত্র রূপায়ণে তিনি ছিলেন স্বাভাবিক অভিনয় প্রয়াসী অভিনেতা। ছবি বিশ্বাস বললেই একটি বিশেষ উচ্চতা, জলদগম্ভীর স্বর, একটি চাহনি, পদক্ষেপের বিশিষ্ট ধরন দর্শকের মানসপটে ভেসে ওঠে। ছবি বিশ্বাস একের পর এক ছবিতে কার্যতঃ একই ধরনের চরিত্রে অভিনয করেছেন। সব মিলিয়ে, বাঙালির কল্পনায তিনি স্বযং একটি ‘টাইপ’! তবে ছাঁচ থাকলে যেমন তার ব্যবহার এবং অপব্যবহার দুইই সম্ভব তেমনি সেই ছাঁচ কী ভাবে যোগ্য পরিচালকের হাতে অসামান্য হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ ছিল ছবি বিশ্বাসের একাধিক চলচ্চিত্রে। জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, দেবী, কাবুলিওযালা তার উজ্জল নিদর্শন।


তবে বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকরা তাঁর কোনও অভিনয়ই ফেলতে পারবেন না। ১৯৫৮ সালে সত্যজিত রায়ের জলসাঘর-এ এক নিঃস্ব জমিদারের আভিজাত্য আঁকড়ে রাখার করুণ চেষ্টা ছবি বিশ্বাসের মর্মস্পর্শী অভিনয়ে পূর্ণ বাস্তবতা পেয়েছে। এ ছাড়া ১৯৫৭ সালে পরশ পাথর, ১৯৬০ সালে "দেবীতে" ছিলো তার অনবদ্য অভিনয়।বাঙালি গলার কাছে দলা-পাকানো আবেগ নিয়ে এখনো দেখে সেই দৃশ্য।


১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য়, যখন গম্ভীর জমিদার জলসাঘর-এ ছড়ি হাতে দেখিয়ে চলেন পূর্ব-পুরুষদের ছবি, তখন সেই অভিনয় সবাইকে শিহরিত করে। দক্ষ চিত্র নির্মাতা সত্যজিত রায় সুযোগ পেলেই তাঁর এই অভিনয়-প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর "পরশ পাথর (১৯৫৭), দেবী (১৯৬০) ও কাঞ্চনজঙঘা (১৯৬২) ছবিতে"। মোট কথা পঞ্চাশ দশকের প্রথম থেকে ১৯৬২ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ভালো বাংলা ছবি অল্পই মুক্তি পেয়েছিল - যেখানে ছবি বিশ্বাস অভিনয় করেন নি।


তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা-তে কাবুলিওয়ালার ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস
১৯৫৬ সালে তপন সিংহের কাবুলিওয়ালা-তে কাবুলিওয়ালার ভূমিকায়ছবি বিশ্বাসের অনবদ্য অভিনয় দর্শকরা কোন দিন ভুলতে পারবেন না। এই ছবিতে তিনি যখন পাগড়ি এবং জোব্বা পরে ‘হিং চাই হিং’ বলে পর্দায আসেন কাবুলিওযালার বেশে এবং একরত্তি মিনির সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর অসমবযসী সখ্য, আর ছবির শেষে যখন রবি ঠাকুরের সেই গল্পটি দেখায, পিতৃহৃদয়ে কোথাও দেশভাগের কাঁটাতার নেই, তখন সেই বোধ একেবারে স্ব-শরীরে জেগে ওঠে আমাদের সামনে। কান্নাহাসির দোলে আকুল বাঙালি সেই আফগান পুরুষের বেশধারী বাঙালি অভিনেতাটিকে আপন করে নেয। প্রায় প্রতিটি ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান জানান ।


ছবি বিশ্বাসের আরও একটি বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি আদ্যপান্ত নাগরিক, অর্থাৎ ‘আর্বান পিপল’। পঞ্চাশের দশকে শহর কলকাতায বিলিতি কেতাদুরস্ত বঙ্গীয় অভিজাতকুল কেমন ছিলেন, তার একটি নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ছবি বিশ্বাস অভিনীত বিভিন্ন চরিত্র। স্যুট-টাই এবং ধুতি-পাঞ্জাবি, দু’টি বেশেই তিনি ঔপনিবেশিক বাংলার একটি চেহারাকে ধরে রাখেন। একই সঙ্গে একই শরীরে তিনি বহন করেছেন একটি বিলুপ্ত হয়ে-আসা সময়ের দু’রকম ছবি। তাঁর মৃত্যুর সময, অর্থাৎ ১৯৬২ নাগাদ সেই ছবিটি বিলুপ্তপ্রায ছিল। এখন তা কার্যতঃ প্রত্নবস্তু, ইতিহাসের সামগ্রী।


বাংলা ছায়াছবির প্রতিষ্ঠালগ্নের শক্তিমান এই অভিনেতা ১৯৬২ সালের ১১ জুন মাত্র ৬২ বছর বয়সে কলকাতায় এক মোটর দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন । বাঙালি সহসা বুঝতে পারেনি, ঠিক কতটা ক্ষতি হয়ে গেল! তাঁর মৃত্যুর পরে বাংলা ছবির পরিমণ্ডলে ক্রমাগত বেড়েছে শূন্যতা। তাঁর না-থাকার শূন্যতা! দুর্ঘটনার রক্তের দাগ ঝাপসা হয়ে এসেছে হয়তো। তবে সময ছবি বিশ্বাসকে গ্রাস করতে পারেনি। রূপালী আকাশে এখনও তাঁর আলো বিদ্যমান। একান্ন বছর আগের ছবি বিশ্বাস এখনো বেঁচে আছেন বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের হৃদয় মাঝে একটি কালপর্বের আকার হিসেবে।


জীবদ্দশাতেই নিছক এক চরিত্রাভিনেতা থেকে বিশিষ্ট রূপকল্পে পরিণত হওয়া কিংবদন্তি এই অভিনেতার আজ ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী। মুত্যুদিনে তাঁর জন্য আমাদের গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:৪১
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×