বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজাল ও বিষাক্ততা যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তাতে ভেজাল ঠেকানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। এভাবে চলতে থাকলে ভেজালযুক্ত খাবার খেয়ে এ জাতি একদিন পঙ্গু জাতিতে পরিনত হবে। বিভিন্ন সময়ে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনায় সামান্য কিছু অর্থ জরিমানা করা হচ্ছে তাতে কাঙ্খীত ফলাফল আসছেনা। বরং ভেজাল বিক্রেতা ও প্রস্তুতকারীরা নব উদ্যোমে নিরব গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। শাক-সবজি, মাছ-মাংস, দুধ, মরিচ, মসলা থেকে শুরু করে ফলমূল ও নিত্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্যে ভেজালে পূর্ণ। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল পাওয়া গেছে। মাছে মেশানো হচ্ছে জীবন ধ্বংসকারী বিষাক্ত ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথেফেন, প্রোফাইল প্যারা টিটিনিয়াম (পিপিটি) পাউডারসহ নানা ক্ষতিকর উপাদান। বিস্কুটসহ বেকারি দ্রব্যে রয়েছে বিষ সমতুল্য রং আর মুড়িতে রয়েছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত ইউরিয়া সার। এর বাইরেও রয়েছে নানা রাসায়নিক সংমিশ্রনের কারসাজি।
বিষাক্ত এসব খাবার গ্রহণের ফলে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে দেশবাসী। বিশেষ করে শিশুরাই এর প্রধান শিকার। চিকিৎসকরা শিশুদের নানা রোগের জন্য ভেজাল ও রাসায়নিক যুক্ত খাবারকেই দায়ী করছেন। এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন চিকিৎসক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা। অধিক মুনাফার লোভে অসাধু এসব ব্যবসায়ীরা জনসাধারণের হাতে বিষ তুলে দিচ্ছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ীকে হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। টাকার জোরে, পেশীশক্তির কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বিষাক্ত খাদ্য। মাছ হিমায়িতকরণের জন্য বরফ পানিতে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। এতে ফরমালিন মাছের খোলসের মধ্যে মিশে যায়। ফলে ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ফরমালিন পরীক্ষায় যে কিট ব্যবহার করেন, তাতে ফরমালিন ধরা পড়ছে না। খাদ্যে ভেজাল বা খাদ্যদ্রব্যে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান মেশানোর বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সারাদেশে আলোচিত হয়ে আসছে। কিন্তু এসব বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
ভেজাল খাদ্যগ্রহণজনিত কারণে ক্রমান্বয়ে মৃত্যুহার বাড়ছে। খাদ্যে ভেজালের কারণে মানুষ ১২ থেকে ১৫টি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল পণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহারে মৃত্যুর হার বাড়াচ্ছে। খাদ্যে ভেজালজনিত বেশ কয়েকটি রোগ, বিশেষ করে আমাশয়, অ্যাপেনডিক্স, রক্তচাপ, হূদরোগ ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এসব রোগে মানুষের মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, খাদ্যে ভেজাল ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং তা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। নিয়ন্ত্রণহীন খাদ্যবাজারকে দ্রুততার সঙ্গে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে না পারলে খাদ্যগ্রহণে মৃত্যুহার সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের তথ্যানুযায়ী দেশে ডায়াবেটিস, আলসার, অপুষ্টি, আর্সেনিক, চর্ম ও কুষ্ঠরোগে মৃত্যুহারও ঊর্ধ্বমুখী। এছাড়া ভেজাল খাদ্যগ্রহণে ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে শারীরিকভাবে অযোগ্য হয়ে পড়ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভেজাল খাদ্যগ্রহণ জনিত কারণে ২০১০ সালে মৃত্যুহার ছিল প্রায় ৪০ শতাংশে। বিবিএস এর তথ্য মতে ২০০৩ সালে মৃত্যুহার ছিল ৩১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০০৫ সালে এই মৃত্যুহার বেড়ে দাড়ায় ৩৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। আর ২০০৭ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৩ এবং ২০১০ সালে তা আরো বেড়ে হয় প্রায় ৪০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যে ভেজাল বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ার কারণেই মানুষ এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে কাঁচা তরিতরকারি, মাছ বা ফলমূল সতেজ রাখতে ফরমালিনের ব্যবহার হচ্ছে অহরহ। চালের চাকচিক্য বাড়াতে ও মুড়ি তৈরিতে ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়াসহ নানা রাসায়নিক দ্রব্য। শিশুখাদ্য হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন চকোলেট কিংবা ক্যান্ডিতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রঙ ও ট্যালকম পাউডার। স¤প্রতি রাজধানীর বেশ কয়েকটি কাঁচাবাজার ফরমালিনমুক্ত ঘোষণা করা হলেও এসব বাজারে তদারকির অভাবে খাদ্যদ্রব্যে দেদার ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্যাকেটজাত জুস বা কোমলপানীয় তৈরিতে মানা হচ্ছে না বিএসটিআইয়ের নিয়ম। আইন অনুযায়ী এসব তরল খাবারে যে পরিমাণ ফলের পাল্প মেশানোর কথা, তা না মেনে অন্যান্য দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহূত এসব দ্রব্য স্বাস্থ্যসম্মত কিনা, তার সঠিক তদারকি নেই। সম্প্রতি ৩২টি জুস উত্পাদনকারী কোম্পানির সিএম লাইসেন্স বাতিল করে বিএসটিআই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ওলিংগং বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে বাংলাদেশের চার ধরনের খাবার- মিষ্টি, বিস্কুট, পাউরুটি ও আইসক্রিমের ওপর ভেজাল নিরূপণে একটি গবেষণা জরিপ পরিচালনা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর ৯৬ শতাংশ মিষ্টি ভেজাল কিংবা তা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি। ভেজাল উপাদানে তৈরি হয় ২৪ শতাংশ বিস্কুট, ৫৪ শতাংশ পাউরুটি ও ৫৯ শতাংশ আইসক্রিম। এক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষায় প্রায় ৫০ শতাংশ খাদ্যপণ্যে অস্বাস্থ্যকর উপাদান পায় জাতীয় জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান (আইপিএইচ)। সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী মুনাফাপ্রবণতা, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) নজরদারির অভাবই ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতের মাত্রা বাড়াচ্ছে। দেশে প্যাকেটজাত কয়েকশ খাদ্যপণ্য বাজারজাত হলেও বিএসটিআইয়ের মাধ্যমে মাত্র ৬৪টি খাদ্যপণ্য তদারক করা হয়। সমন্বয়হীনতা ও তদারকির অভাবে খাদ্যে ভেজাল মাত্রাহীনভাবে বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিএসটিআইয়ের সনদ দেয়া পণ্যগুলো মান যাচাইয়ে বছরে দুই বা ততোধিকবার পর্যবেক্ষণ করা হলেও থানা বা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ অথবা রোধে তেমন কোনো তদারকি নেই। তাছাড়া আইনগত সীমাবদ্ধতায় বিএসটিআইয়ের করণীয় খুবই সীমিত। শুধু প্রক্রিয়াজাত ৬৪টি খাবার তদারক করলেই চলবে না, বাজারের প্যাকেটজাত সব পণ্যই এর আওতায় আনতে হবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই নকল-ভেজালকে কঠোর হাতে দমন করা সম্ভব হয়েছে। আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভেজাল রোধে কেন্দ্রীয়ভাবে গড়ে তোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে স্বায়ত্বশাসন, আর রয়েছে কাজ করার স্বাধীনতা ও অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের সুপারিশের ক্ষমতা। এসব প্রতিষ্ঠান কোথাও কোথাও শুধু খাদ্য সামগ্রী আবার কোন কোন দেশে খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, প্রসাধনী, গার্হস্থ্য রাসায়নিক ইত্যাদি সবই নিযন্ত্রণ করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রতিষ্ঠানের নাম ফেড়ারেল ফুড় এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ), কানাডায় ফেডারেল রেগুলেটরী কমিশন এবং কানাডিয়ান ফুড ইন্সপেকশন এজন্সী, ইংল্যান্ডে ফুড সেফটি কমিটি, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ফুড স্টান্ডার্ডস অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড, নরওয়েতে নরওয়েজিয়ান ফুড সেফটি অথরিটি, আয়ারল্যান্ডে ফুড সেফটি অথরিটি অব আয়ারল্যান্ড, সুইডেনে ন্যাশনাল ফুড এডমিনিস্ট্রেশন, থাইল্যান্ডে এফডিএ থাইল্যান্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশেও বিভিন্ন ধরণের খাদ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও ভেজাল খাদ্য ও ঔষধের মান নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্টভাবে কোন প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে নকল-ভেজাল রোধে কোন যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। উল্লেখ্য খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ বা রোধে কাজ করছে ১৭টি মন্ত্রণালয়।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে কোন সময় ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে একদিকে ভেজালকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা অন্যদিকে ভেজাল দ্রব্য থেকে সাধারন মানুষকে সচেতন করার কাজটিও হতে পারে। 'বাংলাদেশেও ভেজাল রোধ অবশ্যই সম্ভব এবং এই কাজে সরকারী ভূমিকা অত্যন্ত জরুরী। এজন্য আইন যুগোপযোগী করে নিরাপদ খাদ্য আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।’এছাড়া তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি খাদ্যে ভেজালের অপরাধের শাস্তি ও জরিমানার বিধান আরো কঠোর করতে হবে। কঠোর আইনের সঙ্গে সামাজিক সচেতনতাও বাড়াতে হবে। তা ছাড়া এফডিএ এর আদলে একটি রেগুলেটরী সংস্থা গঠন করলে আমাদের দেশের কৃষিজাত বিভিন্ন পণ্যের বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্যের গায়ে রেগুলেটরী বডির পক্ষ থেকে মান নিশ্চিতকারী সিল দেওয়া যেতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসটিআইকে আরো সচল ও কার্যকর করতে হবে। যাতে করে আমাদের আগামী প্রজন্ম বেড়ে ওঠে নিরপদ ও স্বাস্থ্যঝুকি মুক্ত বাংলাদেশে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৩ সকাল ১০:৫২