দিন তারিখ ঠিক মনে নেই। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। সকাল বেলা আম্মু ঘুম থেকে উঠিয়ে বললেন, আজ তোমার পরীক্ষা। কয়েকদিন ধরেই পরীক্ষার কথাটা শুনছিলাম। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে কীসের পরীক্ষা। যা হোক, শীত উপেক্ষা করেই উঠে পড়লাম। আমার একটা ছোট লাল সোয়েটার ছিল। আম্মু সেইটা পরিয়ে দিল। আমি নাস্তা করে রওনা হলাম। আমার সাথে আব্বু আর আমার এক চাচা। উনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের বাসাতেই থাকেন। আমাদের বাসা তখন গোরান। সেখান থেকে যেতে হবে। আব্বু বেবিট্যাক্সি ডাকলেন। এর আগেও বেবিতে চড়েছি। মামা বাসায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু তখন বেবিতে চড়ার মধ্যে যে আনন্দ ছিল আজ সেটা অনুভব করছিলাম না। আব্বু-আম্মুর চিন্তিত মুখ দেখে আমিও কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম। যা হোক বেবিওয়ালাকে বলা হলো ঢাকা কলেজ যাবে কিনা। ২০ টাকা ভাড়ায় উনি রাজি হলেন। আমি কিছুটা অবাক হলাম মনে মনে। এতদিন ধরে শুনে আসছিলাম আমাকে ‘ল্যাবরেটরি’ স্কুলে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে। আজ বেবিওয়ালাকে বলা হলো ঢাকা কলেজ! যাহোক, সেটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামালাম না। আমার চাচা আর আব্বু আমাকে অভয় দিতে লাগলেন।
যাই হোক, যথাসময়ে আমরা স্কুলে পৌঁছালাম। এটাই নাকি সেই বিখ্যাত ‘ল্যাবরেটরি’স্কুল। আমি তখনও স্কুলের পুরো নাম জানি না। এসে দেখি সে এক এলাহি কাণ্ড। আমার মতো আরও অনেকে আব্বু-আম্মুসহ স্কুলে এসে হাজির হয়েছে। সবাইকে লাইন ধরে ঢোকানো হচ্ছে। আমাদের সাহায্য করছে ‘ছোট্ট পুলিশরা’। একটু বড় হওয়ার পর জেনেছি এদের স্কাউট বলে।
আমার সিট দোতালায়। আমি আমার সিটে গিয়ে বসলাম। ইতোমধ্যে স্যাররাও এসে গেছেন। দু-একজন এমন সময়েও ছোটখাটো দুষ্টুমি করছে। স্যাররা তাদের শক্ত ধমক লাগাচ্ছেন। আমি কিছুটা অবাক। এর আগে এক বছর একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়েছিলাম। সেখানে ম্যাডামরা তো অনেক সুন্দর ব্যবহার করতেন।
যাহোক, পরীক্ষা শুরু হলো। শুরুতেই এলোমেলো অক্ষর। এদের মিলিয়ে শব্দ গঠন করতে হবে। আমার দুইটা শব্দ এখানে অজানা। একটা বাগেরহাট। আমি গেট শব্দটা চিনি। আবার বাহার মানে সুন্দর কিছু সেটাও বুঝি। তাই আমি লিখে দিলাম গেটবাহার। আরেকটা শব্দ কাগজীলেবু। আমি লেবুর নাম শুনেছি। আর কাজী নজরুল যে আমাদের জাতীয় কবি সেটাও জানি। তাই কাজী লেবু শব্দ দুটা মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু মেলাতে পারছিলাম না। শেষমেশ লিখে দিলাম কাজীলেবুগ!!! কী আর করা! গ কে কোথাও বসাতে না পেরে শেষে রেখে দিলাম। এরপর খালিঘর পূরণ। সব কয়টা জানা থাকলেও মা_চিত্র শব্দটা মনে করতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল মানচিত্রের কথা। কিন্তু মানচিত্র মানে কি সেটা জানি না। সেটা নিয়ে ভাবারও সময় নেই। বাংলা শেষ করে আমি অঙ্ক অংশে এসে পড়লাম। এই অংশটা সহজ মনে হলো। সবগুলো অংক ঠিকমতো করে ফেললাম।
এরপর সাধারণ জ্ঞানের পালা। সাধারণ জ্ঞান কী জিনিস তা জানি না। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলাম। বাকিগুলো ঠিকমতো লিখলেও বাংলাদেশের দুইটি জাতীয় স্টেডিয়ামের কোনটি কোথায় সেটি লিখতে হবে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। তখন এদের নাম ছিল ১নং আর ২নং স্টেডিয়াম। আমি ২নং মিরপুর লিখলেও বাসার কাছেরটা মনে করতে পারছিলাম না। হঠাৎ খেয়াল হলো কয়েকদিন আগে সার্ক গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠানে যে বাজি পোড়ানো হয়েছিল সেইটা আমাদের বাসার জানালা থেকে দেখা গিয়েছিল। তখন তো আর এত হাই রাইজ বিল্ডিং ছিল না তাই অনেক দূরের জিনিসও জানালা থেকে দেখা যেত। আমি লিখে দিলাম ১নং স্টেডিয়াম খিলগাঁওগোরান অবস্থিত!!
যাহোক, পরীক্ষা শেষ হলো। আসার সময় চাচা সাথে ছিলেন না। আমি আর আব্বু রিকশাতে উঠলাম। আমি প্রথমেই আব্বুকে মানচিত্র বলে কোন শব্দ আছে কিনা জানতে চাইলাম। আব্বু বললেন আছে। আমি জানতে চাইলাম এর মানে কী। আব্বু চেষ্টা করলেন কিছুক্ষণ আমাকে মানচিত্র কী জিনিস তা বোঝানোর। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না। যাহোক, আমি যে মানচিত্র শব্দটা লিখে এসেছি সেটাই যথেষ্ট বলে আব্বু খুশি। কিন্তু কাগজীলেবু নিয়ে অনেক অফসোস করলেন। গ টা কাজীর মাঝে বসালেই তো হতো!
বাসায় এসে স্টেডিয়ামের অবস্থানের ভুলটাও ধরা পড়ল। আমি তো কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। যে জিনিসটা আমার বাসার জানালা থেকে দেখা যায় সেটা কেন আমার বাসার এলাকায় হবে না?
কিন্তু এই সব ভুল নিয়ে বেশি চিন্তা করার সময় নেই। কারণ দু দিন বাদেই ‘আইডিয়াল’স্কুলে পরীক্ষা। আবারও আমাকে নিয়ে আব্বু আর চাচা আসলেন। এই স্কুলটা বাসার কাছে। তাই আসলাম রিকশায়। বাসার কাছে বলে এইটা আব্বু-আম্মুর ফার্স্ট চয়েস। আমি তো আর অতশত বুঝি না তখন। পরীক্ষা দিতে আসলাম। এইখানেও অনেক ভিড়। কিন্তু আগের স্কুলটার চেয়ে বেশি সুশৃঙ্খল। অনেকে গার্ডিয়ানের মাঝে টেনশন কলম না পেন্সিল কী দিয়ে লিখতে হবে সেটা নাকি ফর্মে উল্লেখ ছিল না। আমিও কিছুটা চিন্তিত। আমি তখনো কলম দিয়ে লেখা শিখিনি। তবুও আব্বু পকেট থেকে একটা কলম বের করে আমার বক্সে দিয়ে দিলেন;ইন কেস অফ ইমারজেন্সি। এমন সময় মাইকে ঘোষণা এল কলম ও পেন্সিল উভয়ই অ্যালাউড। আমি আর আব্বু হাঁফ ছাড়লাম।
আমাদের ক্লাসরুমে নিয়ে যাওয়া হলো। একটা জিনিস লক্ষ করছিলাম। এইখানে মেয়েরাও পরীক্ষা দিতে এসেছে। আমার বেঞ্চেও আমার পাশের সিটে একটা মেয়ে বসেছে। আমি কি আর তখন ছেলে মেয়ে বুঝি! আমি পরীক্ষা দিতে লাগলাম। এইখানে আবার ইংরেজিও আছে। আর সব কিছু পারলেও ওয়ার্ড মিনিং-এ আমি তখন থেকে কাঁচা। আমি পেয়ারা শব্দের ইংরেজি জানি না। তাই সেইটা ফাঁকা রাখলাম। এদিকে সব লেখা প্রায় শেষ। এমন সময় দেখলাম আমার পাশের সিটে যে মেয়েটা বসেছে সে আমার খাতার দিকে তাকাচ্ছে। আমাকে বলল, এই তুমি পেয়ারা ইংরেজি লিখনি কেন? পেয়ারা ইংরেজি হলোGuava. আমি কিছুটা চিন্তিত। আমি কী লিখিনি তা দিয়ে ওই মেয়েটার দরকার কী? আমি মেয়েটার কথা অনুযায়ী শব্দটা না লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওইটা শেষ পর্যন্ত ফাঁকাই থাকল। মেয়েটা একটু পরে আমাকে আবার বলে আচ্ছা তুমি কি বলতে পার একের সাথে শূন্য যোগ করলে কত হয়? আমি অবাক হলাম। এই সহজ জিনিসটাও পারে না! আমি বললাম দশ হয়। ও এইবার চিন্তিত। আমাকে বলে তুমি নিশ্চিত যে দশ হয়? আমি বলি হ্যাঁ। আমার খাতায় দেখল দশ লেখা। ও ওইটা দেখে দশ লিখেছিল কিনা জানি না। কিন্তু স্যার যখন আমার খাতায় সই করতে আসলেন তখন বললেন তোমার খাতায় কিছু ভুল আছে। ওইগুলা ঠিক কর। কেন বলেছিলেন জানি না। হয়ত ১+০=১০ দেখে উনার মায়া লাগছিল। আমি খুঁজে কোনো ভুলই পেলাম না।
বাসায় এসে পরীক্ষার বৃত্তান্ত বর্ণনা করলাম। আবারও আক্ষেপ। কেন Guava লিখলা না? আর ১+০ নাকি ১!!! আমি তো ভিরমি খেলাম। আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না বিষয়টা। আমি ভাবছি যোগ করা মানে পাশাপাশি বসানো। যোগ করা মানে যে যোগ অঙ্ক সেটা বুঝতে না পেরেই এই ভুল।
যাহোক, আমি পরীক্ষার পর তো সারাদিন শুয়ে বসে আর খেলে কাটাচ্ছি। হঠাৎ একদিন আব্বু অফিস থেকে ফোন করেন। আম্মু দোতলায় বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়েফোন ধরলেন। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। ফোন বলতেই ল্যান্ডফোন। আমি বাসায়ই ছিলাম। আম্মু ফোন শেষে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন তুমি ল্যাবরেটরিতে চান্স পেয়েছ। আম্মু খুশি দেখে আমিও খুশি। আব্বু বাসায় ফিরলেন খুশি মনে। দু একদিন পর আইডিয়াল স্কুলের রেজাল্ট দিল। আমি চান্স পাইনি!! আব্বুর আবার আইডিয়াল স্কুলের একজন টিচারের সাথে পরিচয় ছিল। উনি জানালেন আমি পেয়েছি ৫০-এ ৪৪। আর যারা ৪৫ বা তার বেশি পেয়েছে তারা চান্স পেয়েছে। আবারও ১+০-এর আক্ষেপ। তবুও সবাই খুশি। ল্যাবরেটরি নাকি অনেক ভালো স্কুল।ওখানে চান্স পাওয়াও কম না।
আমার সেই চাচাও খুশি। কিন্তু তিনি বললেন তোমাকে এখন থেকে স্কুলে ফার্স্ট হতে হবে। আমি তো অবাক। আমি তো ভেবেছি চান্স পেয়েই বিশ্বজয় করেছি। এখন আবার শুনি সেই স্কুলে নাকি আবার ফার্স্ট হওয়া লাগবে। এ কী যন্ত্রণা!!!
এই বিষয়টা নিয়ে লেখার একটা বিশেষ কারণ আছে। এবার থেকে তো এই ক্লাস ওয়ানে ভর্তি পরীক্ষা বাদ হয়ে গেল। তাই আমাদের পরের জেনারেশন তো আর জানবে না ক্লাস ওয়ানে ভর্তিযুদ্ধ জিনিসটা কী ছিল।এই বিষয়ে একটা ডকুমেন্ট হিসেবে এই লেখাটা থাকল। জীবনে পরীক্ষা সব জায়গাতেই আছে। কিন্তু এই যুদ্ধটা ছিল এমন একটা যুদ্ধ যার সৈনিকরা জানত না কীসের জন্য তারা এই যুদ্ধে আসছে। তাই এই পরীক্ষাটা বাদ হওয়ায় বিরাট একটা ঝামেলা হতে বাচ্চার মুক্তি পেল। এবার ভর্তি হওয়া ক্লাস ওয়ানের সব শিশুর প্রতি রইল শুভকামনা।