প্রতিদিনের মতো আজ দুপুরেও কিছুই খেলাম না।আজলা ভরে পরপর তিনবার জলপান করে পেট ভরিয়ে নিলাম। আমার তেমন কোনো সমস্যা হয়না । তবে একটানা আর ক্লাস করতে পারিনা। প্রসাবের খুব বেগ আসে।
তারপরও তো আমার টিফিনের কিছু টাকা জমে যায়। একটা স্কুল ব্যাগের দামতো শুনেছি মাত্র তিনশত টাকা। আচ্ছা তিনশত টাকা কি অনেক টাকা! এভাবে কতদিন টিফিনের টাকা জমালে তিনশত টাকা হবে ?
কলের পানি খেয়ে ক্লাসে ফিরেছি। স্কুলব্যাগের ওপর হাত রাখা। দেখি হঠাৎ করে কী যেন নড়ে ওঠলো। বুঝলাম- আজো ও আমার ব্যাগের ভিতর ওরা ব্যাঙ ঢুকিয়ে রেখেছে। আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে দেখি ভিতরে বই খাতা পত্র সব ভিজা। আমার খুব কষ্ট হয়, আমার খুব কান্না আসে।
আমার পাশ থেকে একদল বলে ওঠে-
রাজু হিসু করে টয়লেটে,
রাজুর ব্যাঙ হিসু করে রাজুর ব্যাগের পকেটে।
অন্য দল যোগ দেয়-
রাজুর ব্যাগ থালি মারা, রাজুর ব্যাগ ছিড়া।
কুনো ব্যাঙের আন্ডা বাচ্ছায় রাজুর ব্যাগ ভরা।
ছেলে মেয়েরা এবার একসাথে হি হি করে হেসে ওঠে।
আমার মায়ের ওপর খুব রাগ হয়। সেদিন রাতে মা বলছে-
মানিক আমার ডাক্তার হবেই।
এসব কথা শুণতে আমার আর ভালো লাগেনা।
আমি মায়ের মুখের উপর বলি-
যার একটা ভালো স্কুল ব্যাগ নেই সে ডাক্তার হবে? যে ছেড়া ব্যাগ নিয়ে রোজ স্কুলে যায় সে ডাক্তার হবে? যার ব্যাগ থালি মারা সে ডাক্তার হবে? যার ব্যাগের ভিতরে ক্লাসের ছেলেরা ব্যাঙ ঢুকিয়ে মজা করে সে ডাক্তার হবে? যে ব্যাঙ আবার ব্যাগের ভিতর হিসু করে বই খাতা সব ভিজিয়ে দেয় সে ডাক্তার হবে? আমার স্বর ক্রমশঃ উঁচু হতে থাকে। ডাক্তার না, ছাই হবে।
ছেড়া ব্যাগ নিয়ে আর কতদিন এভাবে স্কুলে যাওয়া যায়। আর ব্যাগটা যে কয়েক জায়গায় ছিড়া তা মা চোখেও দেখেনা।
সবাই বলে মায়ের নাকি রাতকানা রোগ। সন্ধ্যার পর আর কিছু ভালো করে দেখতে পায়না। আমার মায়ের ওপর খুব রাগ হয়। এতো বেশি রাগ হয় যে রাতে কিছুই না খেয়ে আমি দুঃখে, অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ি।
প্রচন্ড খিদায় রাতে ঘুম ভাঙে। দেখি চেরাগের আলোতে মা আজকে আবারও সুই সুতা নিয়ে বসেছেন। মা চেষ্টা করেই যাচ্ছেন- সুঁচের ভিতর সুতা ঢুকাতে। আমাকে ওঠতে দেখে মা ব্যাগটা কাঁথার ভিতর লুকিয়ে ফেলেন। আমিও মাকে না দেখার ভান করে -এক গ্লাস পানি পান করে আবার শুয়ে পড়ি।
পরদিন,স্কুল ছুটি হলে আমি ব্রীজের ওপর আসি। ব্যাগটা পিটের পিছন থেকে হাতে নেই। এখন খালের পানিতে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলেই সব ঝামেলা শেষ। ছেড়া ব্যাগ আর বয়ে বেড়াতে হবেনা। হঠাৎ দেখি সাইকেল চালিয়ে স্যার আসছেন।
কীরে রাজু, এখানে কি করছিস?
না স্যার। বড়শি দিয়ে খালে ছেলেদের মাছ ধরা দেখছি।
চল, বাড়ি চল। সন্ধ্যা হয়ে এলো।
আমার তখন স্যারের উপর, স্কুলের ওপর , মায়ের ওপর, বইয়ের ওপর ,পড়ালেখার ওপর রাগ হয়। সবচেয়ে বেশী রাগ হয় ব্যাগটির ওপর।ধূর! ব্যাগটি খালের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হলোনা।
পরদিন স্কুল শেষে আমি বাজারের দোকানে যাই। নানা রকম জিনিসে ভর্তি। এতো জিনিসের ভীড়ে আমি একটি ব্যাগ,একটি লাল রঙের স্কুল ব্যাগ খুঁজে বেড়াই। হঠাৎ খুব সুন্দর একটি ব্যাগ চোখে পড়ে।
ভাই,ঐ যে লাল ব্যাগটা । ঐ টার দাম কতো? ব্যাগটা কি একটু হাতে নিয়ে দেখতে পারি।
দোকানি ব্যাগ নামিয়ে দেয়।আহা! নতুন ব্যাগের কী যে সুন্দর গন্ধ।
দাম কতো ভাই?
একদাম তিনশত বিশ টাকা।
আমি জমানো টিফিনের টাকা গুনি।
টাকা দিতে যাবো ঠিক এমন সময় মায়ের কথা মনে পড়ে। আচ্ছা, মা কি অন্ধ হয়ে যাবে! স্কুলের অংক স্যারের কথা মনে পড়ে। স্যারের চোখে কী সুন্দর একটা চশমা। চশমা চোখে দিয়ে স্যার কী সুন্দর করে আমাদের অঙ্ক শিখিয়ে যান।
মাকে আজকে দারুণ চমকে দেয়া যাবে। কী যে আনন্দ লাগছে আমার।
আমি খুব খুশীমনে বাড়ী ফিরি। মা যেন কি রান্না করছেন। মা না দেখেমতো আমি নিজের ঘরে আসি। রাতে খাবার সময় মা বলে- কীরে ডাক্তার হতে পারবিনা। ডাক্তার না হলে মায়ের চোখের রোগ সারাবে কে?
মায়ের কথা শুনে আমার খুব কান্না আসে। আমি মা না দেখে মতো নিজের ঘরে এসে শুই। রাত গভীর হয়। আমার আজ রাতে আর ঘুম আসেনা। অপেক্ষা করি কখন মা সুই সুতো নিয়ে ব্যাগ সেলাই করতে বসবে।
এক সময় রাত একটু গভীর হলেই মা ঠিকই মাটির প্রদীপের আলোতে আমার ছেড়া স্কুল ব্যাগটি নিয়ে বসে। চোখের সামনে এনে খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখে। আমি বালিশের নীচ থেকে লুকানো জিনিসটি এবার বের করি। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে পিছন থেকে এসে দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরি।
মা বলে, দে তোর হাতেই পড়িয়ে দে। কতক্ষণ ধরে বসে আছি। বালিশের নীচে নতুন চশমা কিনে লুকিয়ে রেখেছিস না?
মা চশমা চোখে দিয়ে এবার ব্যাগ সেলাই করতে বসে। এই ব্যাগের প্রতি পরতে পরতে কত নির্ঘুম রাতের আমার মায়ের হাতের স্পর্শ।
মনে মনে বলি, এই ব্যাগ নিয়েই আমি ডাক্তার হবো মা।
আজকে মা আর কিছুই লুকোয় না। আমিও লুকাই না।
শুধু মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুদানা গুলো মায়ের চুলের খোপায় লুকিয়ে রাখি।