জীবনের লক্ষ্য নিয়ে কখনো তেমন মাথা ঘামাইনি। কি হতে চাই এ ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যেতাম। পড়াশুনায় বরাবরই ছিলাম অমনোযোগী। প্রতিদিনের ধরাবাঁধা নিয়মকানুন ভালো লাগতো না। প্রতিদিন সকালে মায়ের ঘ্যানর ঘ্যানর, মক্তবে হূজুরের বেত, স্কুলে অংক-ইংরেজি স্যারের এ্যাকশন এসব বিষের মতো ঠেকতো।
স্কুল ছুটি হলে এক দৌড়ে বাড়ী ফিরে আসতাম। বইগুলো কোনমতে খাটের উপর ছুড়ে ফেলে ভো-দৌড়। নাওয়া-খাওয়ার কথা মনেই হতো না। পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, শিতলক্ষ্যার শীতল পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা ডুব সাঁতার খেলে চোখ লাল করে ফেলা বর্ষার বৃষ্টিতে ছুটাছুটি করে সর্দি-জ্বরের বাহানায় স্কুল কামাই, বিলের নতুন পানিতে খুঁচি জাল আর বড়শিতে মাছ ধরা।
সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে সূর্যটা বিলের ঐ পাড়ে গাছগাছালির আড়ালে লুকাতেই কখন যে অন্ধকার নেমে আসতো টেরই পেতাম না। এই তো ছিলো কৈশরের দুরন্তপনা। এসব নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ছেলেটা বুঝি এক্কেবারে বখে গেলো। রাতে বাড়ি ফিরতেই মায়ের বকুনি আর মাঝে মাঝে কিছু উত্তম-মধ্যম।
দশটা মানুষের কৈশর যেমন কাটে আমার কৈশর তার খুব বেশি ব্যাতিক্রম কিছু নয়। তবে সবার মাঝে কিছু বৈচিত্র তো থাকেই। আমার কৈশরের আগের কথা। বয়স তখন ঠিক কতো মনে নেই তবে যেহেতু ঘটনাগুলো মনে আছে তাই খুব বেশি ছোট হওয়ার কথা নয়।
দুপুরে রান্না করে মা গিয়েছেন গোছল করতে। আমি বাড়ান্দায় সদ্য ডিম থেকে ফোটা হাঁসের বাচ্চাগুলো নিয়ে খেলছিলাম, হঠাৎ মনে হলো তাঁদের গোছল করানো দরকার। ভাবনামতো কাজ। বালতির পানিতে গোছল করাতে করাতে সাত-আটটা বাচ্চার সবগুলোকে মেরে সারি করে শুইয়ে রাখলাম। মা এসে তো থ!
- এইডা কি করছস?
- চুপ কতা কইয়্যেন না, গোসল করাইয়্যা গুম (ঘুম) পাতাইছি।
মা আমাকে এজন্যে মারধর বা বকাঝকা করেননি। শুধু আল্লাহর কাছে বলতেন-
- এইডা আমার গরো (ঘরে) কি দিলা মাবুত! এই বেক্কলরে (বোকা) ইটটু জ্ঞান বুদ্দি দেও।
আরেক দুপুর, যথারীতি মা রান্না করে গেলেন গোছল করতে। উঠোনে কয়েকটা মুরগী ঘুড়াফেরা করছে। ভাবলাম দুপুরের সময়, ওদের নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। ঘরে গিয়ে কিছু ভাত এনে ছিটিয়ে দিলাম। খাওয়া শেষ হলে ওরা চলে যাচ্ছিলো তাই আরো কিছু ভাত এনে দিলাম। এবার এদের সাথে যোগ হলো আরো কিছু মুরগী, হাঁস।
আমি ভাত দিতে থাকলাম আর আশপাশ থেকে যতো হাঁস-মুরগী, ছাগল-ভেড়া, কুকুর-বিড়ালের মেলা জমতে লাগলো। আমার উঠোনে এতো পশু পাখির মেলা আমি আর দেখিনি! তখন আমার যা আনন্দ হচ্ছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এক পর্য্যায়ে পুরো পাতিল ঢেলে দিলাম। তারপর তরকারির পাতিল। তরকারী নিয়ে দুই মুরগির টানাটানি সে কি যে মজার দৃশ্য।
তরকারি খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেলে যে যার মতো চলে যেতে লাগলো। উপায়ান্তর না পেয়ে এবার ডাউলের পাতিলটাও উপুড় করে দিলাম। খুব সামান্য সময় ওদের আঁটকে রাখলাম। ঘরে আর কিছুই খুঁজে পেলাম না। সব শেষ হলে আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলো। মাথা তুলে চারপাশে চোখ ঘুরালাম। দেখলাম কয়েক ডজন চোখের দৃষ্টি আমাকে এফোঢ় ওফোঢ় করে দিচ্ছে।
শুধু পশুপাখি নয় আমার চারপাশে মানুষেরও যে ছোটখাটো একটা মেলা বসেছিলো তা আমি টেরই পাইনি। খাবার দেওয়াতে পশুপাখির মেলা বসেছে কিন্তু মানুষের মেলার কোন কারণ আমি খুঁজে পাইনি। ওদের খিঁদে পেয়েছে খাবার দিয়েছি, খেয়েছে চলে গেছে। এতে লোক সমাগমেরই বা কি আছে আর হাসাহাসিরই বা কি আছে।
তাদের দিকেও আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম, দেখি একপাশে মা ও দাঁড়িয়ে আছেন। এতক্ষণ আমাকে কিছুই বলেননি, এবার মুখ খুললেন।
- সব যে খাওয়াইলাইছস ( খাইয়ে ফেলেছিস) আলা (এখন) আমরা কি খামু?
এ কথার জবাবে এক ঝলক হাসি ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই ছিলো না।
পাড়া প্রতিবেশী কেউ কেউ মাকে বলতেন,
- আমনের (আপনার) এই পোলা আস্ত মগা (বোকা), এইডা যদি মানু (মানুষ) অয় তাইলে আমার আতের তাল্লা দা (হাতের তালু দিয়ে) বডগাছ জালাইবো (বটগাছ গজাবে, অসম্ভব বুঝাতে এই উপমা ব্যবহার করা হয়)
আবার কেউবা বলতেন
- আরে যেইত্তানে (যারা) ছুডুবালা (ছোটকালে) বেক্কল থাহে হেইত্তানে (তারা) বড় অইলে বালা (ভালো) কিছু অয়, যেইত্তানে ছুডুবালা পাকনা থাহে হেইত্তানে বড় অইলে কিছু অইতারে না। অনেক বড় বড় মাইনসেরা ছুডুবালা বেক্কল আছিল।
মা শুধু বলতেন,
- দোয়া কইরেন আললার মাল আললায় যে হেফাজত করে।
তারপর অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়েছে। কি হয়েছি, কি হতে চাই তা নিয়ে এখনো পর্যন্ত গভীরভাবে তেমন ভাবিনি। সময়ের আস্তাকুড়েঁ নিজেকে খুজিঁ, জীবনের অঙ্ক মিলাতে চাই, সমাধান পাই না। তবে আল্লাহ যে সামান্য জ্ঞান দিয়েছেন তা দিয়ে শুধু এইটুকু ভাবতে পারি বা চাইতে পারি যে আমি একজন মানুষ হতে চাই, এটাই আমার লক্ষ্য। আচ্ছা আমার কি এর চেয়ে বেশী কিছু চাওয়া উচিত? যাই হই না কেনো মানুষ না হলে আমার সে হওয়ার কতটুকু মূল্য আছে । কিন্তু আমি কি মানুষ হতে পেরেছি?
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১:৩০