"ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে"- বাংলায় বহুল প্রচলিত এ প্রবাদটি আমরা কমিবেশি সবাই শুনেছি। বাঙালিদের চিরায়ত অভ্যাসের কথা বুঝাতে আমাদের সমাজে প্রবাদটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বাঙালিরা/বাংলা ভাষাভাষীরা পৃথিবীর যেসব দেশে বসবাস করে সেখানে তারা তাদের আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার ও অভ্যাসগুলোকেও সাথে করে নিয়ে যান। এটা চিরায়ত। এতে দোষের কিছু নেই। তবে বাংলাদেশীরা বাকি সবকিছুর সাথে দেশের রাজনীতিটাও নিয়ে যায় চর্চা করার জন্য। এটা এখন অনেকটা বাংলাদেশী সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সাথে বাংলাদেশের বাঙালিদের কিছুটা গুণগত পার্থক্য আছে। পশ্চিমবঙ্গের লোকজন দেশান্তরিত হওয়ার সময় নিজস্ব সংস্কৃতিটা নিয়ে গেলেও রাজনীতির চর্চাটা দেশে রেখে যায়।
পৃথিবীর যেসব দেশে বাংলাদেশীদের সংখ্যা বেশী সেখানে দেশীয় রাজনীতির চর্চাও বেশি হয়। এসকল দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ সংগঠনগুলোও সমানভাবে সক্রিয়। দেশের মত সেখানে ছোট ছোট শহরগুলোতেও রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি আছে। বাংলাদেশের বাইরে সম্ভবত যুক্তরাজ্যে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো অন্য যেকোন দেশের চেয়ে বেশী সক্রিয়।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সহিংস মনোভাব যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী কমিউনিটির কাছে লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুস্থ ধারার রাজনীতি বাদ দিয়ে দেশের মত সহিংস মনোভাব কমিউনিটিকে প্রতিনিয়ত করছে ক্ষত-বিক্ষত। এতে দেখা দিয়েছে সামাজিক বিভেদ ও বিশৃংখলা। কমিউনিটি এখন স্পষ্টত ডান ও বাম দু"টি ধারায় বিভক্ত। এছাড়াও আছে বিভিন্ন ইসলামী দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম। মিছিল, পাল্টা-মিছিল, হাতাহাতি, গালাগালি, বোতল ছোড়াছুড়ি থেকে ডিম নিক্ষেপ পর্যন্ত সব রকম ইতরামি/বিনোদন আছে তাতে। বিশেষ করে দুই নেত্রীর যুক্তরাজ্য সফরের সময় রাজনৈতিক চুলাচুলি ও প্রতিহিংসা চরম পর্যায় পৌছায়।
২০১৫ সালের কথা। একদিন সেন্ট্রাল লন্ডনের পার্কলেন (Park Lane) দিয়ে যাওয়ার সময় একটি নামীদামী পাঁচ তারকা হোটেলের পাশে অনেক বাংলাদেশীকে বিক্ষোভ করতে দেখলাম। দুই দল হোটেলের দুই পাশে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অবস্থান করছে। পুলিশ মাঝখানে। মিছিল পাল্টা মিছিল চলছে। শুধু কি মিছিল? এক দল অন্য দলকে জুতা পর্যন্ত দেখাচ্ছে! কৌতুহলী হয়ে একটু এগিয়ে এসে জানতে পারলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হোটেলটিতে অবস্থান করছেন। এখানে একদল এসেছেন নেত্রীর বন্ধনা করতে, আর অন্যদল এসেছেন নেত্রীকে তিরষ্কার করতে, প্রতিবাদ জানাতে। সাধারন পথচারীরা ভয়ে আতংকিত হয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। এলাকাটি লন্ডনের অন্যতম ভিআইপি ও ব্যস্ততম। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার টুরিস্ট প্রতিদিন এখানে আসে।
লন্ডনের বিখ্যাত হাইড পার্ক, হার্ডরক ক্যাফে ও রীজ হোটেল এখানে অবস্থিত। এছাড়া আমেরিকা, কানাডা সহ পৃথিবীর অসংখ্য দেশের কুটনৈতিক মিশন এ এলাকায়। আছে অসংখ্য পাঁচ তারকা হোটেল, নামীদামী রেস্টুরেন্ট, বার ও শপিং মল। আর হোটেলটির সামনের রাস্তা পার হয়ে পার্কের পথ ধরে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই বাকিংহাম প্যালেস (রাণীর বাড়ি)। হোটেলটির গাঁ ঘেসে জাপানী এম্বেসি। এম্বেসির লোকজনকে দেখলাম ভীত হয়ে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। লাইনে দাঁড়ানো ভিসা প্রত্যাশিরা যার পর নাই বিরক্ত হচ্ছে। আর দেশের মহান এ রাজনৈতিক নেতাদের পাহারা দিতে লন্ডন মেট্রপলিটন পুলিশ তো আছেই।
খালেদা জিয়াও যুক্তরাজ্যে অবস্থান করলে ঠিক এমনটাই হয়। অনেকটা মূদ্রার এপিট ওপিট। কেউ কাউকে এক চুল পরিমাণ ছাড় দিতে রাজি নয়। দেশীয় রাজনৈতিক চর্চায় যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমানে সমান, শক্তিতে ঊনিশ কুড়ি। এমন পরিস্থিতি শুধু কি হোটেলের সামনে? এ রাজনৈতিক বিনোদন মঞ্চায়ন হয় এয়ারপোর্টে পর্যন্ত। সুনামির গতিতে এরা খবর পায় কোন নেত্রী কখন, কোন বিমানে হিথ্রোতে পৌছিবেন। যাবতীয় কাজ ফেলে দুই দলের সব নেতা নেত্রীরা প্লে কার্ড, ফেস্টুন নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। পাশাপাশি চলে পক্ষের সাপোর্টারদের নেত্রী তোষণ ও বন্ধনা। এ সময় বিপক্ষের নেতা নেত্রীদের মুখে জ্বালাময়ী স্লোগানে থাকে ভৎসনা ও তিরস্কার। কখনো নোংরা গালি-গালাজ, সাথে সাম্প্রদায়িক উস্কানি।
কিছু মিছিলের নমুনা,
হই..... হই..... রই..... রই
----(নাম)---- গেল কই।।
হরে কৃষ্ণ হরে রাম
-()- বাপের নাম।।
----(নাম)---- গালে গালে
জুতা মারো তালে তালে।।
এছাড়া- চুরের মা, জুতার ফিতার কণ্যা, ভোট চোর, ভারতের দালাল, পাকির জারজ/দালাল কত নামে গলা ফাটিয়ে স্লোগান, সাথে নোংরা ভাষায় লেখা প্লে কার্ড, জুতা প্রদর্শনী আর বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি তো আছেই!
আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাশাপাশি ইসলামী দলগুলোও যুক্তরাজ্যে বেশ সক্রিয়। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতি কর্মকাণ্ড মূলত ইস্ট লন্ডন মসজিদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। ইস্ট লন্ডন মসজিদ যুক্তরাজ্যের সর্ব বৃহৎ মসজিদ হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতবেদের কারণে অনেকে মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসে না। দেশের প্রতিহিংসার রাজনীতি সেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা পর্যন্ত বিস্তৃত। ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও ব্রিকলেন মসজিদ ঢিল ছোড়া দূরত্বে থাকলেও মসজিদ পরিচালনা কমিটির রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা থাকায় কট্টরপন্থিরা ভূলেও অন্য মসজিদে সালাত আদায় করতে যায় না। ব্রিকলেন মসজিদ বাংলাদেশের একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়।
লন্ডনের বৃহত্তম "ইস্ট লন্ডন মসজিদ" যতটুকু নামাজ পড়ার জন্য বিখ্যাত, তারচেয়ে অনেক বেশি বিখ্যাত রাজনীতির কেন্দ্র হিসাবে। আর আলতাব আলী পার্ক যতটুকু না শহীদ মিনারের জন্য বিখ্যাত তারচেয়ে অনেক বেশি বিখ্যাত মিছিল-মিটিং, গালি-গালাজ, মারামারি আর জোতা ছুড়াছুড়ির জন্য।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস, প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন ও রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপল হাই স্ট্রিটে অবস্থিত আলতাব আলী পার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৮ সালের ৪ মে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে আলতাব আলী নামের এক বাংলাদেশী এখানে বর্ণবাধীদের হাতে নিহত হন। তার বাড়ি সিলেট জেলায়। ১৯৯৮ সালে স্থানটিকে সরকার আলতাব আলী পার্ক হিসাবে নামকরণ করে। ১৯৯৯ সালে পার্কের এক কোনায় একটি শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য এখানেও চলে রাজনৈতিক নোংরামি। কে কার আগে ফুল দেবে, কোন রাজনৈতিক দলের বহর কত বড় হবে তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। এজন্য প্রতি বছর স্থানীয় কাউন্সিল থেকে বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়ন করা হয়। এসব দিবসগুলোতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মৃতিচারণের চেয়ে ব্যক্তিগত প্রচারণা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মূখ্য হয়ে উঠে।
পাকিস্তান আমল থেকে বাঙালিদের বাস যুক্তরাজ্যে থাকলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশি রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় হতে থাকে। নব্বই এর দশক থেকে গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর গতি বেগতিক হয়। এসময় বাংলাদেশে রাজনীতিতে সক্রিয় তরুণ ও যুবকরা বিলাতে এসে দেশীয় রাজনীতির মোহ ত্যাগ করতে না পারায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রাজনীতির মত একটি সিরিয়াস বিষয়কে তারা বিনোদন হিসাবে নেয়। কালের বিবর্তনে এখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিলাতের স্থানীয় রাজনীতিতে তাদের তেমন আগ্রহ নেই।
জামায়াত, জাতীয় পার্টি, হেফাজত, খেলাফত, জমিয়ত, দেওয়ানবাগী, আটরশি, চরমোনাই, আল-ইসলাহ, কে নেই তাতে? সবাই বহাল তবিয়তে ঘাঁটি গেড়ে আছেন। মূল দলের পাশাপাশি উপদলগুলোর কমিটিও সেখানে বেশ সক্রিয়। এছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে বাদ পড়াদের বিদ্রোহী গ্রুপও দেখা যায়। শোনা যায় এসব দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে অনেক সময় বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়। এছাড়া দেশে বিভিন্ন মামলার আসামী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, দুর্ণীতি মামলায় পলাতক এমনকি দেশে খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্তরাও অনেক সময় এসব দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান পায়।
নেতাদের অনেকের বেগমরাও মহিলা দল/লীগে বিভক্ত। আর হ্যা, কমিটিও আছে! বড় নেতা/নেত্রী ব্রিটেনে বেড়াতে গেলে এসব নেত্রীরা তাদের বেশ আদর আপ্যায়ন করে থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ মিছিল/অবরোধেও অংশ নেন।
মূলত কেন্দ্রের আসকারা পেয়ে এসব লোক যাদের বেশির ভাগই বিত্তবান, রাজনীতির নামে কমিউনিটিতে বিভেদ সৃষ্টি ও প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। দেশ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা/নেত্রী ও মন্ত্রীরা যুক্তরাজ্য ভ্রমণে গেলে কমিটির এসব লোকজন তাদের তোয়াজ করেন, সংবর্ধনা দেয়, টাকা পয়সা চাঁদা দেয়। এসব সুবিধা পেয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা বিদেশের এসব কমিটিগুলোকে অনুমোদন করে। রাজনীতির নামে চলে কমিউনিটিকে নিয়ে টানা হেচড়া। এখন ব্রিটেনে বাঙালি কমিউনিটি নেই, এটি এখন পলিটিক্স কমিউনিটি। এসব মিছিল, মিটিং আর পিকেটিংয়ে একজনও ভাল, বিবেকবান, সুশিক্ষিত ও সভ্য মানুষ ভুলেও যায় না। এগুলো দেখে লজ্জায় মুখ লোকায়। আর ব্রিটেনে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো হলো রাজনীতির আখড়া। যদিও অতি নিম্মমানের এসব প্রচার যন্ত্র সভ্য বাঙালিরা দেখে না।
অবাকের বিষয় যুক্তরাজ্যে পৃথিবীর অন্যকোন দেশের রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম আমার চোখে পড়েনি। আমাদের চেয়েও অনেক বেশী দরিদ্র ও যুদ্ধ বিগ্রহে ক্ষতিগ্রস্ত কোন দেশেরও নয়। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রীক দেশ ভারতের কোন রাজনৈতিক দলের নাম পর্যন্ত নিতে কাউকে শুনিনি। তাদের ভাষায় ভারতীয় রাজনীতি করলে যুক্তরাজ্যে বসে করব কেন? এটা তো ভারতীয় রাজনীতির ময়দান না। পারলে এদেশের মূল ধারায় রাজনীতি করব, ভারতের নয়।
এসব দেশের প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতিকে সবাই মিলে গণ সংবর্ধনা দেয়। বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে। রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে তিনি তো আমার দেশটাকে বিশ্বব্যাপী প্রতিনিধিত্ব করছেন। তার অপমান কি নিজের অপমান নয়? এখানে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের জায়গা নেই। সবার আগে দেশ।
যুক্তরাজ্যে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্ম এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ভাল চোখে দেখে না। প্রচন্ড বিরক্ত হয়। নেতাদের সন্তানরাও তাদের এমন রাজনীতিকে সাপোর্ট করে না। যার ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারা বাপ-দাদার জন্মভূমির প্রতি কোন টান ও দায়বদ্ধতা অনুভব করে না। বাংলাদেশ মানেই একটি দরিদ্র, অধিক জনসংখ্যায় ভরপুর, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, রাজনৈতিক হানাহানির একটি অসভ্য ও বর্বর দেশ হিসাবে তাদের অনেকেই মনে করে। সাধারন মানুষ যারা সব সময় দেশের রাজনীতির খবরা খবর রাখেন কিন্তু সে দেশে কোন রাজনৈতিক দলকে সাপোর্ট করেন না তারাও এসব রাজনৈতিক কমিটির কার্যক্রমকে ভাল চোখে দেখে না। আর সে দেশের মূলস্রোতে যারা রাজনীতি করেন তারা প্রতিনিয়ত লজ্জিত হন এসব প্রতিহিংসা ও আদর্শহীন রাজনীতি দেখে।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।