বিছানাকান্দি আর পানতুমাই ঘুরে হোটেলে পৌছুতে রাত হয়ে এল। পরদিনের প্রোগ্রাম জাফলং দেখে শ্রীমঙ্গল চলে যাব। শ্রীমঙ্গলে আরো দু’দিন থাকব আমরা।
পরদিন জাফলং-এর উদ্দেশ্যে বেরোতে একটু দেরীই হয়ে গেল। সেই গোয়াইনঘাটের রাস্তা ধরে চলেছি আমরা, আমাদের পাশে পাশেই চলছে মেঘালয়ে সবুজ পাহাড়ের সারি। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে শ্বেতশুভ্র ঝর্ণা। কোথাও সারা মাঠ জুড়ে সবুজ ধানক্ষেত-এর মাতামাতি, মন ভোলানো সবুজ চা বাগান, সবুজ পাহাড় আর শুভ্র ঝর্ণা দেখতে দেখতে, সবুজ মুগ্ধতা নিয়ে এক সময় চলে এলাম আমরা জাফলং!
সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, গোয়াইনঘাট উপজেলায়, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত জাফলং, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভূমি। এখানে ভারতের ডাউকি নদী আর বাংলাদেশের পিয়াইন নদীর মোহনা। প্রকৃতি কন্যা হিসাবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। একসময় পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছিল আকর্ষণীয়। এখন আসলে একটা ধূ ধূ প্রান্তর ছাড়া আর কিছু না । সেই পাথুরে সৌন্দর্য্য কবেই আমরা বিলুপ্ত করে ফেলেছি , পড়ে আছে কেবল বালি!এখনও নদীতে পর্যটকের নৌকার চেয়ে পাথর তোলার নৌকাই বেশী দেখা যায়। বিছানাকান্দিতে দেখে এলাম সেই পাথুরে সৌন্দর্য্য! জানিনা এ সৌন্দর্য্য কতদিন স্থায়ী হবে!
পিয়াইন নদীর ওপারে ভারতের ডাউকি শহর দেখা যাচ্ছে। পাহাড়, টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় নেমে আসা জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ঠ করে। এসব দৃশ্যপট দেখতে প্রতিদিনই দেশী-বিদেশী পর্যটকরা ছুটে আসেন এখানে। আমি অনেক ছবি তুললাম এখানকার। প্রকৃতি কন্যা ছাড়াও জাফলং বিউটি স্পট, পিকনিক স্পট, সৌন্দর্যের রাণী- এসব নামেও পর্যটকদের কাছে বেশ পরিচিত। ভ্রমণ পিয়াসীদের কাছে জাফলং-এর আকর্ষণই যেন অন্য রকম। সিলেট ভ্রমনে এসে জাফলং না গেলে ভ্রমণ যেন অসপূর্ণই রয়ে যায়।
দূরের পাহারের উপরেই ডাউকি শহর।
মাঝে মাঝেই এমন পাহাড়ি ঝর্ণা।
পাহাড়ি রাস্তায় চলছে এমন বড় বড় যান বাহন।
ডাউকি ব্রীজ
নৌকার মাঝির কাছে শোনা, ডাউকি পাহাড়ে এই বড় পাথরের উপরে কোন একজনের মাজার আছে।
জাফলং পৌছে, সংগ্রাম সীমান্ত ফাঁড়ীর পাশে থেকে আমরা নৌকা ঠিক করলাম সংগ্রামপুঞ্জী/মায়াবী ঝর্ণা দেখতে যাব। নদীর কূল থেকে অনেকখানি ঢালু পথ পেরিয়ে আমরা নৌকায় উঠলাম। সেদিন বৃষ্টি ছিল না বলেই এতটা ঢালু পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছি আমরা। আমাদের সাথে ছোট দু’টো বাচ্চা ছিল, ওদের নিয়ে কোনভাবেই এপথে আসা যেত না। নৌকার মাঝির কাছেই জানলাম ছোট-বড় ১৬টি ঝর্ণা নেমে এসেছে ওই খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় থেকে। কিন্তু জাফলং-এর এই অংশের পিয়াইন নদীতে পানি এত কম কেন ভেবে পেলাম না আমি। নদী পার হয়ে আরো দশ মিনিট বালুর মধ্যে হাঁটার পরে পেলাম সেই মায়াবী ঝর্ণা। ভারতের সীমানায় এই ঝর্ণা, টহল দিচ্ছে বিজিবি। প্রচুর পর্যটকের ভীড়। বড় বড় পাথর বেয়ে নেমে আসছে এই উচ্ছল ঝর্ণাধারা। পাথর বেয়েই উপরে উঠছে সবাই, লাফালাফি ঝাপাঝাপি করছে স্বচ্ছ পানিতে। বেশী উপরে গেলেই বেজে উঠছে বিজিবি-র বাঁশি। এমনিতেই এটা ভারতের সীমানায়, তারপরে এত উপরে ওঠাও ঠিক না। আমার সাথীরাও পাথুরে পাহাড় বেয়ে কিছুটা এগিয়ে যেয়ে ঝর্ণায় ভিজলেন সাধ মিটিয়ে। বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে, অনেক অনেক ছবি তুলে ফিরে এলাম আমরা।
সংগ্রাম সীমান্ত ফাঁড়ী
এখান থেকেই আমরা নৌকায় উঠলাম।
জাফলং-এ পিয়াইন নদী।
এখানে নৌকা থেকে নেমে, আরো দশ মিনিট হেঁটে আমরা পৌছুলাম সংগ্রামপুঞ্জী ঝর্ণার ধারে।
এমন ঝর্ণার ছবি তুলেই চলেছি, তুলেই চলেছি।

বর্ষায় জাফলং-এর রূপ লাবণ্য যেন ভিন্ন মাত্রায় ফুটে উঠেছে। ক্ষণে ক্ষণেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি, ধূলি ধূসরিত পরিবেশ হয়ে উঠেছে স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় তুলার মত মেঘরাজির বিচরণ এবং যখন-তখন সেই মেঘ অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি হয়ে, সে যেন এক ভিন্ন শিহরণ। সেই সংগে কয়েক হাজার ফুট উপর থেকে নেমে আসা ছবির মত শুভ্র ঝর্ণাধারার দৃশ্য যে কারোরই চোখ জুড়ায়, মনে আনে প্রশান্তি!
নদীতে পর্যটকের নৌকার চেয়ে পাথরবাহী নৌকাই বেশী। জাফলং-এর অতীতের সেই পাথুরে নদী দেখবার সৌভাগ্য আমার হলো না!
ফেরার পথে আরো দেখলাম তারুণ্যের চঞ্চলতা!
ফিরে এলাম আবার সেই সীমান্ত ফাঁড়ীর ঘাটে।
ঘাটের পাড়েই দেখলাম একজন ফটোগ্রাফারকে, এই সিংহাসন আর একটা ক্যামেরাই তার জীবিকার হাতিয়ার। এই সিংহাসনে বসিয়ে ছবি তুলে দিচ্ছেন নিজের ক্যামেরায় অথবা চাইলে আপনার ক্যামেরায়।
ফাঁড়ীর পাশে অনেকগুলো দোকান। খাবারের সাথে সাথে টুকিটাকি অনেক কিছুই পাওয়া যায়। একজন পাথরে ছবি আঁকছেন, নাম লিখছেন। আপনি চাইলে, আপনার প্রিয়জনের জন্য উপহার হিসেবে কিনতে পারেন, স্মৃতি হিসেবে নিয়ে আসতে পারেন একটি ফলক, জাফলং ভ্রমণের।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীন নির্জন বনভূমি। জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পরে খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটে। তারপরও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পতিত পড়ে ছিল। ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌ পথে জাফলং আসতে শুরু করেন। পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকায় গড়ে উঠে নতুন জনবসতিও। আশির দশকে সিলেটের সাথে জাফলং এর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়। এরপর থেকে জাফলংয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্যের কথা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা সিনেমায় দেখতাম জাফলং-এর পাথুরে নদীর ছবি! দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পাশাপাশি প্রকৃতি প্রেমীরাও ভীড় করতে থাকেন জাফলংয়ে। জাফলং এখন দেশের সেরা পর্যটন স্পট। নাগরিক জঞ্জাল আর কোলাহল ছেড়ে দু’দণ্ড শান্তি খুঁজে নিতে তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, এমনকি দেশের বাইরে থেকেও দলবেঁধে জাফলংয়ে বেড়াতে আসেন পর্যটকরা।
বাংলাদেশ-এর প্রায় প্রতিটি স্থানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সৌন্দর্য্যের সমাহার। তেমনই এক নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর প্রকৃতি কন্যা জাফলং।
প্রথম পর্বে ছিলঃ ভরা বর্ষায় আমার সিলেট ভ্রমণ - বিছানাকান্দি, সিলেটের আরেক বিস্ময়!!!
দ্বিতীয় পর্বে ছিলঃ পানতুমাই একটি চোখ জুড়ানো গ্রাম!!!
ঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃঃ