১০ই মার্চ, ২০১৩ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের শিবরাত্রি। নেপাল হিন্দু রাষ্ট্র, এখানে সেদিন ছিল সরকারি ছুটির দিন। আমি যেখানে ছিলাম, সে এলাকাটি একটি ছোট্ট পাহাড়ী শহর। নাম ধারান। সেখান থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে, নেপালে অন্যতম বৃহত্তর নদী "সপ্তকোশী " অবস্থিত। যেটিকে স্থানীয় লোকেরা কোশী নদী বলে। নদীর পারাপারে জন্য একটি ব্রীজ বানানো হচ্ছিল। ইষ্ট-ওয়েষ্ট হাইওয়ে ওই ব্রীজের উপর দিয়েই ওপারে যাবে। ওই ব্রীজ প্রজেক্ট-এ কন্সালটেন্ট-এর টিম লিডার হিসেবে বছর দুই কর্মরত ছিলেন আমার সাহেব। অখ্যাত একটি জায়গা। এর পরিচিতি বাড়িয়েছে, বি পি কৈরালা মেডিক্যাল কলেক ও হাসপাতাল। আমি যতটুকু জেনেছি, এর প্রতিষ্ঠাতা, এক সময়ের পর্দা কাঁপানো বলিউড নায়িকা মনিষা কৈরালার দাদা। বিশাল কমপ্লেক্স। পূর্বে এটি ব্রিটিশদের ক্যাম্প ছিল। ব্রিটিশরা এখান থেকে সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগ করত। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে "গুরখা রেজিমেন্ট" আছে, যেখানে সবাই নেপালী। এখনও ওখানে আরো ব্রিটিশ ক্যাম্প আছে, যেখান থেকে গুরখা রেজিমেন্ট-এ লোক নিয়োগ করা হয়।
যা বলছিলাম, শিবরাত্রির ছুটিতে আমরা দু'জন ঘুরতে বেরোলাম, পাহাড়ী পথের উদ্দেশ্যে। পাহাড় পেরিয়ে, আরেক পাহাড়ের উপরের একটি শহরে যাব, ঘুরব-বেড়াব, বিকেলে ফিরে আসব। যেখানে গেলাম, সেটা একটি জেলা শহর, নাম "ধানকুটা"। সকালে বেরোলাম। দুই হাজার মিটার উচ্চতার পাহাড় পেরিয়ে, গেলাম ধানকুটা। ওটাও সম উচ্চতার পাহড়ের উপরের একটি শহর। গাড়ীর আলটিমীটারে দেখাচ্ছিল, আমরা কত উচ্চতায় আছি (সমুদ্র লেভেল থেকে)। আসল উদ্দেশ্য নেপালের জাতিয় ফুল “লালিগোরাস”-দেখতে যাব। ধানকুটার জঙ্গলে কয়েক রঙের লালিগোরাস দেখা যায়।
যে রাস্তায় চলছিলাম, সেটিও ব্রিটিশদের করা। সুন্দর রাস্তা। পাহাড় কেটে বানানো। রাস্তার একপাশে সুউচ্চ পাহাড়, আরেকপাশে গভীর খাদ। পাহাড়ের দিকটা পাথর দিয়ে বাঁধানো, খাদের দিকটা ছোট ছোট স্তম্ভ করে রেলিং দেয়া।
পথে পেলাম চার্লস টাওয়ার, ওই স্থানের নাম ভেডেটর। ব্রিটিশ রাজকুমার চার্লস নেপাল সফরে এসেছিলেন। তিনি ভেডেটরের এই পাহাড়ে বসে নেপালের প্রাকৃতিক মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করেন। জায়গাটি তার খুব পছন্দ হয়। তিনি এখানে একটি ভিউ টাওয়ার বানানোর জন্য অর্থ অনুদান করেন। তাঁরই অর্থে নির্মিত টাওয়ারটিই “চার্লস টাওয়ার” নামে পরিচিত। এটি একটি ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে দূরের ধারান, ধানকুটা শহর ছাড়াও হিমালয়ের এর একটি চুড়া "মাকালু" দেখা যায়।
শিব রাত্রি ছিল বলে, পথে পথে বিভিন্ন মন্দিরে ভক্তদের ভীড়। তরুন-তরুনীদের সংখ্যাই বেশী। সুউচ্চপাহাড়, পাহাড়ী নদি, পাহাড়ী ফুল, মেঘ এসব দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে চলে এলাম ধানকুটা। পেরোলাম পাইন বন, পলাশ বন। দেখলাম লালিগোরাস বনও, তবে শুধু লাল রঙের। পথের ধারের একটা রেষ্টুরেন্টে নুডুলস খেলাম। আমরা মুসলমান, আমাদের জন্য এখানকার সব খাবারই হালাল নয়, এমনকি মুরগীর গোশতও না। রেষ্টুরেন্টের মালিক, মহিলা।কর্মচারিরাও মেয়ে এবং একই পরিবারের সদস্যা। তাদের সাথে ছবি উঠলাম, তাদের ছবি তুললাম। আরো কিছু ছবি তুলে, চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ফিরলাম ধারানের নীড়ে। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে। খুব উপভোগ করলাম এই ভ্রমণটুকু।
সেদিনের কিছু ছবিঃ-
এভাবেই ঘুরে ঘুরে ওঠে পাহাড়ী পথ
পাহাড়ের দিকে এভাবে পাথর দিয়ে দেয়াল করে নেট দিয়ে আটকানো আছে
খাদের দিকে এভাবে রেলিং দেয়া থাকে
ভেডেটর-যেখান থেকে চার্লস টাওয়ার দেখা যায়।
ভেডেটর থেকে দেখা ধারান
পর্বতশৃঙ্গ মাকালু
চার্লস টাওয়ার
চার্লস টাওয়ার (ওই দূরে পর্বতশৃঙ্গ মাকালু)
শিব মন্দিরের দিকে যাত্রা
নেপালের জাতিয় ফুল “লালিগোরাস”
যে রেষ্টুরেন্টে খেলাম, তার মালকিন
সূর্য অস্ত যাওয়ার পথে -এবার ফেরার পালা
★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২৭