somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আলো আঁধারিতে একজন "পবিত্র মুখ"

০৫ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক ফ্রেন্ডের বাসায় বেড়াতে গতকাল বিকেলে গিয়েছিলাম কিংস ক্রসে! এই জাগাটাকে সিডনী সিটির 'লাস ভেগাস' বলা যেতে পারে। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের "চিত্ত বিনোদনের" সমস্ত প্রকার সুব্যবস্থা সেখানে রয়েছে। সিডনীতে যখন প্রথম আসি, অনেকদিন গিয়েছিলাম সেখানে জব খুঁজতে। এলাকায় আসার পর সিনিয়র ভাইরা যখন জানতে চাইলেন, কই গেছিলা, বল্লাম "কিংস ক্রসে"। সবাই দেখি আমার দিকে বার বার ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। আমি তো মনে মনে বলি "রহস্যটা কি? কি এমন মহা ভারত অশুদ্ধ করে ফেল্লাম!" তখনও জানতাম না জা'গাটা কি কারনে বিখ্যাত। (নাকি কুখ্যাত!) নারায়নগন্জের টানবাজার আর সিডনীর কিংস ক্রস দুটো একই কারনে কুখ্যাত!
আমার এক রুমমেট এক সময় পোটস পয়েন্টের একটা ডিপার্টমেন্টল স্টোরে কাজ করত, শিফট শেষ হত অনেক রাতে, ফোন করে 'আপনি এখন কোথায়' জিগেস করলে বলত, 'আমি এখন নরকপুরী দিয়ে হাঁটছি প্রলয়দা।' এরপর থেকে যতবারই সেখানে গেছি, নরকপুরীই মনে হয়েছে। মাথা নিচু করে হনহন করে হেঁটে পাতাল রেলে এসে দম ফেলতাম।
রাস্তার দুধারে প্রচুর ৪/৫ স্টার হোটেল, ব্যাকপেকারস একোমডিশন, পাব, রেষ্টুরেন্ট, ডিসকো ক্লাব, নাইট ক্লাব, পকার শপ এমনকি বোথ্রেলও! শত শত যৌবনাবতী তরুনীরা সেগুলোর সামনে বিভিন্ন ব্যাশে, বিভিন্ন ভংগিমায় উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকে ফুটপাথ ধরে হেটে যাওয়া মানুষগুলোর দিকে। তাই ওখান দিয়ে হাটার সময় গা শিরশির করে উঠত। মনে হত ওরা যেন অচ্ছুৎ। বিধাতার এই পবিত্র পৃথিবীটা ওরাই অপবিত্র করে দিচ্ছে।
এমনিতেই জাগাটা বেশ সরগরম থাকে। উইকএন্ডে তো কথাই নেই। বিকেল তিনটার পর থেকে ভীড় বাড়তে থাকে, মাঝরাত পর্যন্ত চলে সিডনী সাইডারদের উদ্দামতা। এরপর অনেকেই ক্লান্ত হয়ে চলে যায়। রয়ে যায় শুধু 'প্রমোদবালারা'। ওরা কি কখনো ক্লান্ত হয়না?


বন্ধুর বাসা থেকে ডিনার শেষে একপাশের রাস্তা ধরে আমি সেদিন মাথা নিচু করে হাঁটছি, বাড়ীর ফিরতি ট্রেন ধরব। ইচ্ছে করলে আমার ছোট্ট নিশানটা নিয়ে আসা যেত, কিন্তু সিটিতে গাড়ি নিয়ে আসা মানে পার্কিংয়ের বিশাল একটা হ্যাপাকে নিজের কাঁধে চাপানা। ওটাকে বাড়ীর স্টেশানে রেখে এসেছি। ট্রেন থেকে নেমে চড়ে বসব।

আমার আশে পাশের মেয়েরা একটার পর একটা অশ্লীল শব্দ ছুঁড়ে দিচ্ছে আমার দিকে। কিন্তু আমার মনে হল, সেগুলোর কোনটাতেই নিজেকে বিলিয়ে দেবার ইংগিত নেই। নেই আমন্ত্রনের আভাসটুকুও। যেটা খুঁজে পেয়েছিলাম সেটা হল ক্রোধ আর ধিক্কারের এক সংমিশ্রন।

রাস্তার লোকজন খানিকটা কমে এসেছে ততক্ষনে। হাতের ডানপাশে ম্যাকডোনাল্ডস পরল। এই গরমে একটা কোন আইসক্রিম খাবার ইচ্ছাটা 'পেট চাড়া' দিয়ে উঠল। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা আর এক্সট্রা কশানের জন্য বাইরে বেরুলে ঐ জিনিসটা ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয় না। আইসক্রিম কিনে বাইরে বেরুতেই, স্টেশানে ঢোকার প্রবেশপথে, আলো আঁধারিতে হঠাৎ দেখলাম ছোটখাট একটা মেয়ে মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু এগোতেই বুঝলাম আমার হাতের আইসক্রিমটার দিকে সে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুটা অবাক হলাম। কি মনে করে মেয়েটার সামনে গিয়ে থমকে দাড়ালাম। সেটা দেখে মেয়েটা আইসক্রিম থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আধো আলো; আধো আধারে মেয়েটার অপূর্ব মায়াময় আর নিস্পাপ একটা চেহারা দেখলাম। রাতের মেয়েদের সমন্ধে আমার ধারনা আরেকবার একটা ধাক্কা খেল।

ছোট শরীরটাতে কাপড় বলতে কিছু নেই বল্লেই চলে। হাঁটুর ছয় ইন্চি উপরে এসে লাল স্কার্টটার প্রান্ত শেষ হয়ে গেছে। আমাকে দেখে লজ্জায়(!)কোরিয়ান সেই মেয়েটা সেটাকে টেনে খানিকটা নীচে নামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। আরো অবাক হলাম। নিজেকে বিজ্ঞাপয়িত করার বদলে আড়াল করতে চাইছে! মনে হল নতুন, তাই মানুষের পাষবিকতাকে এখনো পুরোপুরি হজম করতে পারেনি। আমি মেয়েটার চোখের দিকে তাকালাম, অদ্ভুত এক বিষন্নতা চোখের মনির পুরোটা জুড়ে। একটু চুপ করে থেকে বল্লাম: 'Do you wanna have my icecream?'মেয়েটা মাথা নাড়ল। চায় না। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছিল পিপাসার্ত। আমি পাশের একটা নিউজ এজন্সি থেকে একটা এর্নাজি ড্রিংকস কিনে মেয়েটাকে সাধলাম। নিলো না। আমি ওর পায়ের কাছে সেটা রেখে দিয়ে চলে আসলাম। কয়েকটা ওজি অ্যাবো (অ্যাবোরোজিনাল) আমাদের খেয়াল করছিলো একটা স্পোর্টস কার থেকে। আমি যাবার জন্য পা বাড়াতেই মেয়েটাকে লক্ষ্য করে "হেই প্রসী, প্রসী" বলে কুকুরের মত চেঁচিয়ে উঠল।

কয়েকটা ডলারের আশাতে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পেশাকে বেছে নিতে হয়েছে। মেয়েটা তৃষ্নার্ত ছিল। হয়ত ক্ষুধার্তও। নিজের সেই ক্ষুধা মেটাতে নিজেকেই সঁপে দিতে বসে আছে আরেক ক্ষুধার্ত হায়েনার ক্ষুধা মেটাতে। হায়েনা আগে নিজের পেট ভরবে, তারপর এই মেয়েটা দুটো খেতে পাবে। খেয়ে গায়ে শক্তি বাড়াবে। তারপর আবার আরেক ক্ষুধার্ত হায়েনার খাবার হবে নিজে। বাহ। কি দারুন প্রথা!

মেয়েটা তার চোখের মাঝে সে রাতে কি দেখিয়েছিলো আমায়? একরাশ সপ্ন, সংসার গড়ার সপ্ন? নাকি একবুক ঘৃনা, সমগ্র পুরুষ জাতের উপর ঘৃনা নাকি কোন এক টেকওয়ে শপ থেকে একবাটি খাবার কেনার দুর্নিবার আকাংখা? কোনটা?
একজন পতিতার চেহারাকে পবিত্র বলার কারনে 'সুশীল' সমাজ হয়ত আমাকে আতেঁল, পাগল বা অসভ্য আখ্যায়িত করবে, কিন্তু আমি মেয়েটির চোখে কি দেখেছিলাম সেটা কি কোনদিন তারা জানতে চাইবে?

হঠাৎ চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠল, এই হয়েছে এক জ্বালা, একটুতেই....।

অনেকদিন আগে শোনা একটা গানের কথা মনে পড়ল।
Click This Link

কানে তখন বাজছিলো সেটা। আরেক ঘর.....আরেক পুরুষ....আরেক ঘর....আরেক পুরুষ। শুনছি আর ভাবছি, আজ বিশ্ব নারী দিবস। হাহ। নারী দিবস। হা হা হা। কি চমৎকার প্রহসন!

মেয়েটার দিকে ফিরে তাকাতে চেয়েও কেন যেন পারলাম না।
তাকালে কি দেখতে পেতাম মেয়েটার চোখে? পিপাসা মেটাবার জন্য কৃতজ্ঞতা; নিজেকে গৃহীত করতে না পারার হতাশা নাকি এখনো সেই প্রবল ঘৃনা আর ধিক্কার? হয়ত আর কোনদিনও জানা হবে না আমার।

স্টেশনের এ্যাসকেলেটর দিয়ে স্থবির হয়ে আমি মাটির নীচে নামছি। মাটির অনেক নীচে!! অনেক!!!



সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৮:৪০
২৪টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুনির মুখে ইতিহাস শিক্ষা ও অধঃপতিত মানস

লিখেছেন sabbir2cool, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ৯:৩৪


বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি মেজর শরিফুল হক ডালিমকে প্রকাশ্যে এনেছেন আলোচিত ফেসবুক-সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন। গত রোববার (৫ জানুয়ারি) রাতে ইলিয়াস ‘বিশেষ লাইভে যুক্ত আছেন বীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবার আসিবো ফিরে.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১০:৩৪

আবার আসিবো ফিরে.....

যেখানে গেলে অনেকদূর অব্দি মাঠ দেখা যায়, কচি রোদের তাপে পুড়িয়ে নেওয়া যায় পিঠ। রাতের আলো আঁধারিতে সমস্ত কোলাহল সরিয়ে রেখে খোলা যায়গায় দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করলেই পোকাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাজ উদ্দিন-সৈয়দ নজরুলরা যুদ্ধকালেই দেশ লিখে দিয়েছিলো ভারতকে

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১১:১৭

Sharif Osman Bin Hadi (ফেইজবুক পোষ্ট থেকে)

এই সেই ৭ দফা চুক্তি, যার মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গোলাম বানানো হয়েছিলো।
তাজ উদ্দিন-সৈয়দ নজরুলরা যুদ্ধকালেই দেশ লিখে দিয়েছিলো ভারতকে। নুরুল কাদিরের লেখা 'দুশো... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনা কি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন?

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫০


আমার মনে এখন প্রায়ই যে প্রশ্নটা আসে সেটা হচ্ছে শেখ হাসিনা কি আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদটা গ্রহন করবেন কিংবা করতে পারবেন?

আপনি মানেন কিংবা না মানেন আওয়ামীলীগ আবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা এখন আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প উপন্যাস পড়তে চাইনা‼️(জোছনা ও জননী/হুমায়ুন আহমেদ)

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১১:৪৫


মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স তেইশ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কেমিস্ট্রিতে অনার্স থিয়োরি পরীক্ষা দিয়েছি, প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্যে অপেক্ষা। সুন্দর সময় কাটছে। আর মাত্র এক বৎসর—... ...বাকিটুকু পড়ুন

×