বই বিশ্লেষণঃ আদর্শ হিন্দু হোটেল
লেখকঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ধরণঃ সামাজিক উপন্যাস
প্রকাশকালঃ ১৯৪০
পৃষ্ঠাঃ ১৪৩
"আদর্শ হিন্দু হোটেল" ইংরেজ সময়ের পটভূমিতে রচিত বিভূতিভূষণের একটি বিখ্যাত উপন্যাস। এ উপন্যাসে তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজের একজন "রাঁধুনি বামুণ" হাজারি দেবশর্মার জীবনকাহিনী লেখক সিদ্ধহস্তে বইয়ের পাতায় তুলে এনেছেন।
রাণাঘাটের রেল-বাজারে বেচু চক্কত্তির "আদর্শ হিন্দু হোটেল" বিখ্যাত হোটেল। এই হোটেলে রাঁধুনি বামুণের কাজ করে হাজারী ঠাকুর। মাসিক সাত টাকা, দুইবেলা আহার পায় হোটেল থেকে। রাতে হোটেলেই ঘুমায় সে। তার বাড়ি এঁড়োশোলা গ্রামে, গ্রামে তাঁর স্ত্রী, মেয়ে টেঁপি(আশালতা), ছেলে খোকা থাকে। সেখান থেকে কাজের সন্ধানে রাণাঘাট এসে সে বেচু চক্কত্তির হোটেলে কাজ শুরু করেছে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে।
বেচু চক্কত্তির "আদর্শ হিন্দু হোটেল" এর উন্নতির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হাজারী ঠাকুরেরই। তার মত ওস্তাদ বামুণ রাণাঘাটে আর কেউ নেই। যারা একবার তার হাতের রান্না খেয়েছে, তারা বারবার এসেছে তার রান্না খাওয়ার জন্য। প্রতিবারই, লোকজন এসে তার রান্না খেয়ে প্রশংসা করে যায়, হাজারী ঠাকুরও বড্ড খুশি হয় প্রশংসাবাক্য শুনলে।
হোটেলের একজন বাদে সবাই তাকে ভালো জানে, হাজারী ঠাকুর মানুষটাও আগাগোড়া ভালো।
হোটেলের একজনই তাকে দেখতে পারে না, পদ্ম ঝি। হাজারী ঠাকুর তাকে "পদ্মদিদি" ডাকে। এই পদ্মঝি'র কথাই হোটেলের শেষকথা। এমনকি বেচু চক্কত্তিও তার কথার ওপরে কথা বলেনা। বেচু চক্কত্তির সাথে পদ্মঝি'র কোনো সম্পর্ক আছে কী না এ নিয়েও লোকজন বহু কথা বলে।
পদ্মঝি পদেপদে হাজারী ঠাকুরকে অপমান করে, বেচু চক্কত্তির কাছে হাজারী ঠাকুর সম্পর্কে বহু মিথ্যাচার করে তাকে অপদস্থ করে প্রায়শই। এ নিয়ে হাজারী ঠাকুরের কোনো অভিযোগ নেই, সব মিথ্যা অপবাদ সে মুখবুজে সহ্য করে নেয়। পদ্মদিদিকে সে ভীষণ ভয়ও পায়।
হাজারী ঠাকুরের বড় ইচ্ছে, সে একটা হোটেল খুলবে। রান্না, বাজার করা সে জানেই। এখন চারশো টাকার মত হলেই সে হোটেল খুলতে পারে। কিন্তু, টাকা কে দেবে? হোটেল নিয়ে অনেক বড় পরিকল্পনা তার। কিন্তু, টাকার প্রসঙ্গ এলেই সব পরিকল্পনা কেমন যেন চুপসে যায়
একদিন, পদ্মঝি'র ষড়যন্ত্রে মিথ্যা চুরির অপবাদে হাজারী ঠাকুরকে "আদর্শ হিন্দু হোটেল" এর চাকরী ছাড়তে হয়। কপর্দকহীন হয়ে রাস্তায় নেমে আসে হাজারী দেবশর্মা।
এখন কী করবে হাজারী ঠাকুর? তার হোটেল করার স্বপ্ন কী সত্যি হবেনা?
অতসী, কুসুম, রতন ঠাকুর, মতি, বংশী ঠাকুর, যদু বাঁড়ুয্যে,নরেন এদের নাম মনে রাখুন। "আদর্শ হিন্দু হোটেল" উপন্যাসে প্রবেশ করলে এই চরিত্রগুলোর সাথে আপনারও দেখা হয়ে যাবে।
সবারই বইটি পড়া উচিত। বিভূতিভূষণের অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাস এটি। আমি একটানে বইটি শেষ করেছিলাম। অনেক বই পড়তে গেলে বারবার পৃষ্ঠার দিকে তাকাতে হয়। এ বই পড়ার সময়ে একবারও পৃষ্ঠার দিকে তাকাতে হয়নি। কাহিনী কোথাও ঝুলে যায়নি।ঘটনার টানটান গাঁথুনি ছিলো শেষপৃষ্ঠা পর্যন্ত। বিভূতিভূষণের লেখায় প্রকৃতির একটা ঘনিষ্ঠ বর্ণনা সবসময়ই পাওয়া যায়, এ উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
আমার কাছে অদ্ভুত সুন্দর লেগেছে উপন্যাসটি। সহজ, সরল, মসৃণ গতিতে এগিয়েছে কাহিনী।
এটা এমন একটা উপন্যাস যেটা পড়ে মন খারাপ থাকলেও ভালো হয়ে যাবে, শেখারও আছে অনেককিছু। হেরে যেতে যেতে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, একটু সহযোগীতা পেলে মানুষ কতটা অসাধ্যসাধন করতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ "আদর্শ হিন্দু হোটেল।"
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৫৪