(১ম পর্বের পর)
অসাম্প্রদায়িক চেতনা, জাতীয়তাবোধ ও শিল্পের আন্তর্জাতিক সেতু রচনায় আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন শিল্পী সুশান্ত কুমার অধিকারী। বনলতা ও অপরাপর কুশলীবগণ সেভাবেই উপস্থাপিত হয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে ভাব, ভাষা ও টেকনিকে।
সাঁওতাল পল্লীতে ঘরের দেওয়ালে ঘুটের ছোপ ছোপ বুনটের সামনে দাঁড়িয়ে সুনয়নার মতোই পার্শ্বচিত্রে বাঙ্গালী ললনা কৃষ্ণকলী।
ওই পল্লীতে রয়েছেন সাঁওতাল রমনী বরেন্দ্রীও। যুগের বিবর্তনে বনলতার জীবনমানের বদল হলেও বরেন্দ্রীদের জীবনের কোন পরিবর্তন নেই। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির এই বরেন্দ্রীদের জীবন কেবলই বঞ্চনার ইতিহাস। ঘুটে কুঁড়িয়ে এনে ঘরের বাইরের দেয়ালে ছোপ ছোপ করে শুকোতেই অর্ধেক জীবন চলে যায় তাঁদের।
তবু থেমে নেই তাঁরাও, ঘুটের ছোপের বিন্যাসের বাইরেও শিল্পের ছোঁয়া লাগে তাঁদের ঘরের দেয়ালেও। হাতি, গরু, ময়ুর, ফুল, মাছ, অন্যান্য পাখিসহ বিভিন্ন মোটিফ ফুটিয়ে তোলে সেখানে। শিল্পের তৃষ্ণা মানুষের চিরন্তন। কাজের অবসরে পরম্পরায় শিল্পচর্চা ওদের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই সাজসজ্জায়ও স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলে সাঁওতাল রমনীরা।
বনলতার নায়ক হিসেবে এঁকেছেন শিল্পী তাঁর নিজের প্রতিকৃতি। রসভান্ডারে তব অমিয় সূধা! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়তো এই রোমান্টিকতায়ই লিখেছিলেন,
“আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে , চাও কি –
হায় বুঝি তার খবর পেলে না।
পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি –
হায় বুঝি তার নাগাল মেলে না।”
শিল্পী সুশান্ত সে সূধার খবর দিলেন, দর্শকগণও নাগাল পেল পারিজাতের মধুর গন্ধের। নায়ক এসেছেন একাধিকবার বিভিন্ন রূপে।
কখনো সরাসরি বনলতার নায়ক, কখনো শিরোনামহীনে নায়িকার মুখোমুখি, কখনোবা অনুসন্ধানরত অবস্থায়। এদিক থেকে শিল্পীকে বেশ সাহসী বলা যায়। শিল্পচর্চায় নারীর রূপ অনুসন্ধান, আর রূপের স্তুতি একটা সাধারণ বিষয় হয়ে আসছে। অন্য কোন পুরুষকে তো দূরে থাক, নিজেকে উপস্থাপনের অনীহায় অনেক শিল্পী আড়ষ্টতা কাটাতে পারেন না। সুশান্ত এখানে একধাপ এগিয়ে। মাথার তালু বিস্তৃত সুডৌল কপাল, আর দুপাশে ঝাঁকড়া লম্বা চুলের বাহার শিল্পীর ভাবগত সৌন্দর্য্যকেই মৃদু আলোয় দীপ্ত করেছে। তাঁর এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে, ভবিষতে তাঁর শিল্পচর্চায় নারীর পাশাপাশি পুরুষ সৌন্দর্য্যও উন্মোচিত হবে একদিন।
প্রদর্শিত অধিকাংশ চিত্রের চিত্রায়নে শিল্পী কাগজে টেম্পারায় ধৌত পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, যা প্রাচ্যরীতির ঐতিহ্যকে ধারন করে। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু এই পদ্ধতিতে অনেক কাজ করেছেন। এদেশে বর্তমানে এই পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কন খুব কম হয়। শিল্পী সুশান্ত একে পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন ধারায় রূপান্তর করেছেন। রঙ ও রেখার পরিমিতিবোধে যথেষ্ট মুনশিয়ানা রয়েছে শিল্পীর। নিখুত রেখা এবং টেকচারে চিত্রগুলো সাবলীল প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিটি শিল্প সৃষ্টিতে পরম নিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।
সুশান্ত অধিকারী চারুশিক্ষা গ্রহণ করেছেন খুলনা আর্ট কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ (তৎকালীন চারুকলা ইনষ্টিটিউট), শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে। শিল্পী অধ্যাপক নাসরীন বেগমএর কাছে প্রাচ্যধারায় ছন্দায়িত রেখাংকন, জলরঙের ধৌত পদ্ধতি, শিল্পী অধ্যাপক শওকতুজ্জামানের কাছে ওপেক পদ্ধতিতে টেম্পেরা ও সিল্ক পেইন্টিং আয়ত্ব করেছেন। এছাড়াও অনেক জ্ঞানী গুণী শিল্পীদের নিকট শিল্পের করণকৌশল ও নান্দনিকতার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পিএইচডি করার সময় ডঃ সঞ্জয় কুমার মল্লিকএর কাছে মিথিক চরিত্র বিশ্লেষণের কৌশল চিন্তার ধারণা পেয়েছেন। সেসময় তিনি মিথিক চরিত্র, ঘটনা ও ইতিহাসের চরিত্র চিত্রায়ন ভাবনার গভীরে প্রবেশ করেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি গৌতম বুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধএর বিভিন্ন বিষয়সহ নানাধরনের চরিত্র চিত্রণে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আজকের বনলতাসহ সকল চরিত্রসমূহ শিল্পীর সেই চেতনাভাবেরই ফসল।
বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিষয়ের অধ্যাপক ডঃ সুশান্ত কুমার অধিকারী। মূলতঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদের "প্রাচ্যকলা" বিষয়ের যাত্রা তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছে।
মূর্তধারায় সহজ সরল প্রকাশভঙ্গীর শিল্প নিয়ে শিল্পী সুশান্ত অধিকারীর এই চিত্রপ্রদর্শনীটি ছিল দর্শকদের জন্য সহজবোধ্য, শিল্প রসাস্বাদনে সহায়ক এবং উদ্দীপক। (শেষ)
সম্পর্কিত পোষ্টঃ
শিল্পী সুশান্ত কুমার অধিকারীর সৃষ্টিতে বাংলার চিরায়ত নারীরূপঃ বনলতা
শিল্পী সুশান্ত কুমার অধিকারীর সৃষ্টিতে চিরায়ত বাংলার আধুনিক নারীরূপঃ বনলতা ও অনেকে (১ম পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২১ রাত ৮:২৭