অনেকক্ষণ ধরে কিবোর্ডে হাত দিয়ে বসে আছি; কি করে একটা শৈশব স্মৃতি লিখব সেটাই ভাবছিলাম। বাম হাতের কনিষ্ঠা একবার কিবোর্ডের উপরে রেখে কিছু-একটা লিখে দ্রুতই সেটা কেটে দিলাম। এবার ডান হাত দিয়ে শুরু করলাম।
সেমিকোলন এল কে জে - এ এস ডি এফ --- কিছুই লেখা যাচ্ছে না। আমার শৈশব কিছুই লেখা হচ্ছে না। আমার শৈশব লিখতে গিয়ে বারবার যা লিখছিলাম তা মোটেই আমার শৈশব হচ্ছিলো না; তা হয়ে উঠছিল আমার পিতা-মাতার পিতা ও মাতা হয়ে ওঠার গল্প। আমার শৈশব যেহেতু লেখা হচ্ছে না তাই অগত্যা তাঁদের কথাই লিখি।
আমি আমার পিতা-মাতার সর্বকনিষ্ঠ ছেলে। আমার পূর্বে তাদের আরও দুইজন ছেলে রয়েছে। একজন আমার যমজ। নাম জহির; আমার থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার বড়! এটা নিয়ে তার অহংকারের শেষ নেই যেন!
অন্য একজন, অর্থাৎ আমার সর্ব জ্যৈষ্ঠ ভাই, তাকে আমি কখনও দেখি নি। দেখার সৌভাগ্য হয় নি। আমার জন্মের দশ থেকে বারো বছর পূর্বে তার জন্ম হয়। এবং জন্মের দুই দিনের মধ্যেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।
তিনি বেঁচে নেই এতে আমার কোন আফসোস নেই। তাকে কখনোই দেখি নাই, তার সাথে আমার কথা হয় নি, সে আমাকে আদর করেন নি। অন্য বড় ভাইয়েরা যেভাবে তাদের ছোটভাইকে আদর করেন তিনি কখনোই আমাকে সেভাবে আদর করত পারেন নি। তার প্রতি আমার কোন আক্ষেপ নেই, অভিযোগ নেই।
কিন্তু আশ্চর্য হই; তারপরে এতগুলো বছর কেটে গেছে কখনোই আমার বাবা-মাকে তাদের সেই প্রথম সন্তানের জন্মদিন কিংবা মৃত্যুদিন কিছুই পালন করতে দেখি নি। পালন করা তো দূরের কথা তার নাম পর্যন্ত কেউ কোনদিন উচ্চারণ করেন নি। তারা কেউ কোনদিন আমাকে বলেন নি আমার আরও একটা বড় ভাই ছিল। হয়ত এরা কেউ বলতেনও না, আমি কোনদিন জানতামও না।
একদিন বিকেল নানু গল্প করতে করতে মুখ ফসকে বলে ফেলেন তার প্রয়াত দৌহিত্রের কথা, সেখান থেকেই জানতে পাই আমার একটা বড় ভাই ছিল যাকে আমি কোনদিন দেখি নাই, শুনি নাই-অথচ শ্রদ্ধা করি সবথেকে বেশি।
মজার কথা হচ্ছে, তার বয়স আমার কাছে মাত্র দুই দিন। বাড়ে নি আর। অথচ তিনি দুনিয়ায় এসেছিলেন আমার থেকে আরও প্রায় একযুগ আগেই। সে হিসেবে তার বয়স বাড়ার কথা। কিন্তু বাড়েনি। মৃত মানুষের বয়স বাড়ে না।
আমার জন্মের পরে যে স্মৃতিটা সব থেকে বেশি মনে পড়ে সেটা একটা টাইপ মেশিন। সাল ১৯৯৮।
এক শীতের সকাল বেলায় ঘুমিয়ে আছি। হঠাত খুব ভোরে দরজায় করাঘাত। আমি যেভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম সেভাবেই ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম। কমিয়ে রাখা হারিকেন আলোটা বাড়িয়ে নিয়ে উঠে গিয়ে মা দরজা খুললেন। দরজা খোলার সাথে সাথেই এক ঝাঁপটা শীত এসে ঘরের সমস্তটা শীতল করে দিল এবং মুখে লাল মাফলার পেঁচানো একজন লোক দ্রুতগতিতে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন যার হাতে রয়েছে লোহালক্কড় সাদৃশ কিছু একটা মেশিনের মত দেখতে। মাফলার খুলে ফেলার আগেই হারিকেনের নিভু নিভু আলোতে মশারির ভিতর থেকেই চিনতে পারলাম ইনি আমার বাবা ছাড়া আর কেউ না।
ঘরে ঢুকেই মা’কে কড়া নির্দেশ দিলেন, তাড়াতাড়ি দরজা আটকাও বাইরে ভীষণ শীত।
বাইরে যে ভীষণ শীত সেটা আমি লেপের মধ্যে থেকেও টের পাচ্ছিলাম। শীতের ভয়ে সেখান থেকে নাক জাগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- আপনার হাতে ওটা কি আব্বু?
তিনি জবাব দিলেন-
তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠ, আজকে আর হাতে লেখা প্রশ্নে পরীক্ষা নিব না, আজকে পরীক্ষা নিব টাইপ করা প্রশ্নে।
সেদিন সেই মুহূর্ত থেকেই আমার পিতার সেই টাইপ মেশিনটা আমার দুই চোখের শত্রু!
পিতাজান বসে বসে খটখট করে প্রশ্নপত্র টাইপ করে দিতেন আর আমাদের দুইভাগকে বসে যেত হত পরীক্ষা দিতে। কি সকাল, কি বিকাল, কি সন্ধ্যা! সারাদিন খট খট খট আর আমাদের দুই ভাইয়ের পরীক্ষা দেয়া !
কাগজের মধ্যে কার্বন পেপার ঢুকিয়ে এক সাথে টাইপ করা হত দুই কপি প্রশ্ন, লেখা শেষ হওয়া মাত্রই মেশিন থেকে কাগজ নামিয়ে আমাদের ডাকা হত; যেন গরম গরম রুটি ভাজা হয়েছে খেতে ডাকছে।
এই টাইপ মেশিনের যন্ত্রণায় আমাদের দুই ভাইয়ের জীবন অতিষ্ঠ!
আমার পিতা টাইপ মেশিন নিয়ে এতটাই মগ্ন হয়ে গেলেন যে সংসারের অন্যান্য সব কাজ ভুলে গেলেন। আমরা ঘুমিয়ে গেলেও রাত দুইটা তিনটা পর্যন্ত টাইপ করতেন। পরেরদিন ইশকুলে গিয়ে তার ছাত্রদের উপর চালাতেন প্রশ্নপত্রের নির্যাতন!
একদিন ঘরে বাজার নেই। মা এসে কয়েকবার বলে গেছেন যে বাজার নেই। কিন্তু কিসের কি! তিনি মেতে আছেন টাইপ করা নিয়ে।
আবারো এসে মা বলে গেলেন যে বাজার নেই, রান্না হবে না। টাইপ করা বাদ দিয়ে বাজারে যাও। অথচ তিনি টাইপ করেই যাচ্ছেন। এক লাইন লিখছেন আবার খ্যাঁট করে রোলার ঘুরিয়ে কাগজ উঁচিয়ে নিয়ে আবার লেখা শুরু করলেন। এভাবে চলছে।
শেষ পর্যায়ে মা এসে চূড়ান্ত রাগ দেখানোর পরে তার মনে হলো হ্যাঁ বাজার করা উচিত সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন বাজার না করে দিলে রাতে না খেয়ে থাকতে হবে।
না খেয়ে টাইপ করা বেশ কঠিন হবে। তাই অগত্যা বেশ ক্ষুণ্ণ হৃদয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। উঠেই হাঁক ছাড়লেন;
কে কে যাবে বাজারে ?
বলার আগেই আমি আর জহির বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাজির।
আমাদের বাসা থেকে বাজার প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। যেতে হলে হেঁটে যেতে হয় অথবা রিক্সা বা সাইকেল।
বাবার একটা ফনিক্স সাইকেল ছিল। যেটার বয়স আমার থেকে বেশি। তিনি সেটাকে নিজের পুত্রধিক বেশি যত্ন করতেন। সেটাতে চেপেই আমরা তিনজন রওনা হলাম বাজারের দিকে। সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারের উপরে টর্চ লাইট ধরে জহির আর সামনে রডের উপরে দুই পা একদিকে করে হ্যান্ডেল ধরে আমি। বাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যেত। সন্ধ্যা সাতটা মানেই প্রবাহ বিবিসি বাংলা।
ক্লাব ঘরের টেবিলের উপরে বেশ বড়সড় একটা রেডিও সেটার চারপাশে বসে আছেন বাবা সহ আরও সাত আটজন। তারা সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে প্রবাহ শুনছেন। কেবল বিরক্ত হতাম আমি আর জহির। বিরক্ত হতাম আর যাই হতাম, কাদের কল্লোল যখন আসত তখন সবাই বেশ নড়েচড়েই বসত। আমরাও মন দিতাম রেডিওতে।
রেডিও থেকে সবথেকে কাছাকাছি যিনি বসতেন তিনি এলাকার হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক আনিস স্যার। তার পাশে বসতেন গার্লস স্কুলের গণিত শিক্ষক সুলতান স্যার। তার থেকে ঠিক বিপরীতে বসতেন বয়েজ স্কুলের গণিত শিক্ষক আইয়ূব স্যার। এভাবে আরও যারা সেখানে বসতেন সবাই কোন না কোন স্কুলের শিক্ষক। সারা জীবন শিক্ষকদের এত কাছাকাছি থেকেছি ফলে শিক্ষকদের যে ভয় পেতে হয় সেটা ভুলেই যেতাম বরং মনে হত উনারা যেহেতু বাবার বন্ধু তাই আমার ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।
রেডিওতে খবর শেষ হতে হতে কয়েক রাউন্ড চা বিস্কুট চলে যেত। পাশেই বিমলের চায়ের দোকান ছিল, সেখান থেকেই রতন নামে আমারই বয়সী একটা ছেলে টিচারদের জন্য চা নিয়ে আসত আর আমার ও জহিরের জন্য পেপসি। মূলত এই পেপসির লোভে লোভেই সন্ধ্যার পরে বাজারে আসা নাহলে বসে বসে রেডিও খবর শুনতে আমার বা জহির কারও বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।
রেডিওর খবর এবং চা পেপসি শেষ হলে আমাদের দুই ভাইকে অন্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে রেখে বাবা চলে যেতেন বাজার করতে। বাজার করে ফিরতে কমপক্ষে আধাঘণ্টা লাগত। এই আধা ঘণ্টা আমার আর জহিরের উপর চলত অমানুষিক নির্যাতন।
সবগুলো টিচার মিলে শুরু করতেন শিক্ষাদান।
বাবা বলো তো, মশা ইংরেজি কি ?
আচ্ছা বলো তো, আমি যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতাম তবে সব জনগণের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করতাম, এটার ট্রান্সলেশন কি হবে ?
আচ্ছা এটা বলো তো দেখি কে পারো, পুত্রের বর্তমান বয়স ৯ বছর এবং পিতার বয়স পুত্রের বয়সের ৪ গুন হলে দশ বছর পরে পিতার বয়স কত হবে?
যতক্ষণে বাবা বাজার করে না ফিরতেন ততক্ষণ বসে বসে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হত। কিছুকিছু পারতাম আবার কিছুকিছুই পারতাম না। যখন কোন প্রশ্নের উত্তর পারতাম না, একবার আমি জহিরের দিকে তাকাতাম আরেকবার জহির আমার দিকে তাকাতো; এতেই প্রশ্নকর্তারা বুঝে নিত যে পারব না।
বাজার করা শেষে বাবা এসে জিজ্ঞেস করতেন তার বন্ধুদের কাছে,
- কি খবর স্যার, আজকের কি রিপোর্ট?
উনারা বলতেন, জহির খুব ভালো পাড়ছে, জাহিদের অবস্থা একটু নড়বড়ে।
বাবা তখন আমার দিকে তাকাতেন আর আমি ডান হাতের আঙ্গুল খেতে শুরু করতাম।
বাসায় এসে আবার শুরু হত টাইপ মেশিন অত্যাচার!
সবাই জানেন যে টাইপ মেশিনে কালি থেকে ফিতায় বা রিবনে। রিবনে ঘুরে একবার এই মাথা থেকে ঐ মাথায় যায় আবার ঐ মাথা থেকে এই মাথায় আসে।
তো, লিখতে লিখতে একদিন হঠাত আমার পিতাজি দেখলেন যে টাইপ হচ্ছে কিন্তু কালি বেশ ঝাপসা! কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারলেন ফিতার কালি শেষ হয়ে গেছে।
উনি প্রচণ্ড হতাশ হয়ে বসে রইলেন! রিবন কিনতে হলে যেতে হবে আবার সেই জেলা শহরে। পুরো একদিনের মামলা!
পরের দিন যথারীতি আব্বা চলে গেলেন জেলা শহরে, আর এদিকে আমি আর জহির রাগে দুঃখে কেঁচি দিয়ে পুরাতন রিবনটাকে কেটে কুচিকুচি করে ফেললাম! যত রাগ সব ঝাড়লাম রিবনের উপরে।
এরপরে আবার রিবন এলো। আবার আমাদের উপর অত্যাচার!
এরমধ্যে টুকটাক করে আমরাও কিছু কিছু টাইপিং শিখতে লাগলাম। একদিন আঙুল দিয়ে বোতামের উপরে জোরে চাপ দেই তো আরেকদিন খুব আস্তে চাপ দেই। টাইপ মেশিনে লিখতে হলে বোতামের উপরে বেশ জোরে চাপ দিতে হত। এখানে টাইপ করতে করতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল জোরে বোতাম চাপার। এর অনেক পরে যখন কম্পিউটার ধরলাম, তখন মনে আছে কিবোর্ডের বোতামের উপরেও অনেক জোরে প্রেস করতাম আর একসাথে অনেকগুলো অক্ষর উঠে যেত !
এভাবে চলছিল আমাদের টাইপিং।
টাইপ মেশিনের বাম দিকে Tab নামে একটা বোতাম আছে যেটায় চাপ দিলে কাগজসহ রোলার এই মাথা থেকে ঐ মাথায় চলে যেত, এবং স্প্রিং এর সাথে ছোট্ট একটা ধাক্কা খেয়ে টুং করে শব্দ করত। এই ব্যাপারটা আমাদের দুই ভাইয়েরই বেশ ভাল লাগত। আশেপাশে কেউ না থাকলেই যত-খুশি ততবার Tab বোতামে চাপতাম।
বেচারা টাইপ মেশিন, আমাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন কট কট করে দুইটা স্প্রিং কেটে গেল!
পরে আব্বাজান যখন টাইপ করতে এলেন দেখলেন যে রোলার আগাচ্ছে না।
প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝেছিলেন এটা তার দুই গুণধর পুত্রেরই কাজ!
টাইপ মেশিন নষ্ট! আহ শান্তি! আর পরীক্ষা দিতে হবে না।
সেই টাইপ মেশিন নষ্ট হয়েও রক্ষা হল না, সেটাকে পরের দিনই নিয়ে যাওয়া হল জেলা শহরে মেরামতের জন্য। তিনদিন পরে সেটা যখন বাসায় ফিরে এলো, আমাদের উপর কড়া হুকুম দেয়া হল, কেউ যেন টাইপ মেশিনের ধারেকাছেও না আসে!
চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী; আর আমরা শুনব আদেশ উপদেশ!
বাসায় আব্বাজান না থাকলেই টাইপ মেশিন চলে যেত আমাদের দখলে। একটা পর্যায়ে আমরাও টাইপ মেশিনটাকে ভালোবেসেফেলি।
কবি মনিরা সুলতানা’র কেয়া পাতায় নৌকা ভাসানো দিনগুলিতে মন্তব্য করতে গিয়ে আমার শৈশব নিয়ে কিছুটা কথা হয়েছিল কবি খায়রুল আহসান সাহেবের সাথে। তাকে কথা দিয়েছিলাম আমার শৈশব নিয়ে লিখব একদিন।
এরপরে ভুলেই গিয়েছিলাম এই ব্যাপারটা।
কিছুদিন আগেই আহসান সাহেব ব্যাপারটা আবার মনে করিয়ে দিতেই ভীষণ লজ্জা পেলাম। তাই খায়রুল আহসান ও মনিরা সুলতানা দুজনকে উৎসর্গ করেই প্রকাশ করলাম আমার শৈশবের টাইপ মেশিন পর্ব।
জাহিদ অনিক
৭-১-২০১৮
ঢাকা।
ছবিঃ গুগল