ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম । ঘুমানোর আগে প্রায় আধা লিটার পানি খেয়েছি। খুব গরম লাগছিল। শুয়ে আছি প্রায় ২০ মিনিট। ঘুম আসছে না। তৃষ্ণা পাচ্ছে। আবার উঠে পানি খেলাম। ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। শুয়ে পড়লাম। আরও ১০ মিনিট গেল। কিছুতেই ভ্যাঁপসা গরম কমছে না।
আমার পাশে ঝিলমিল শুয়ে আছে, একটু ধাক্কা দিয়ে বললাম,
- এই তোমার গরম লাগছে না? ফ্যানের স্পিডটা একটু উঠে বাড়িয়ে দাও না !
সে গায়ের কম্বলটা আরও একটু গুটিসুটি দিয়ে বলল-
একটু আগে তুমিই ফুল স্পিডে দিয়ে এসেছ।
আমি অন্ধকারেই ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাই তো! ফ্যানতো ঘুরছে দৈত্যের মত!
কিন্তু গরম কমছে না কেন? মনে মনে ভাবলাম রুমে একটা এসি লাগাতে হবে। এসি ২৩ ডিগ্রীতে থাকলে এখন বেশ একটা আরামের ঘুম হত।
গত জানুয়ারি তে একটা এসি বসানো হয়েছে অপুর রুমে। এখন আগস্টেই আর একটা এসি কেনা প্রায় অসম্ভব, তবুও চেষ্টা করতে হবে।
অপু, আমাদের ছেলে। বয়স আট। আট বছর বয়সে সে একটা নিজস্ব রুম পেয়েছে, রুমে এসি পেয়েছে।
আর ওর বাপ হয়েও এখনো নিজস্ব রুম পেলাম না, এসি তো বহুত দূরের কথা!
ছোট বেলায় আমার বাবা মা কোনোদিন অনুভবই করেন নি যে তাদের ছেলে বড় হচ্ছে একটা আলাদা রুম তাকে দেয়া উচিত। আমরা দুই ভাই থাকতাম এক রুমে। রুমে একটা খাট থাকত, ফ্যান থাকত। ফ্যানের স্পিড বাড়ানো কমানো নিয়ে প্রায়শই আমাদের মধ্যে কলহ হত।
বাড়ি ছেড়ে যখন আলাদা থাকা শুরু করলাম অর্থাৎ কলেজ ভার্সিটিতে উঠলাম তখন থেকেই হলে, হোস্টেলে ও মেসে থাকছি।
একান্ত ব্যক্তিগত রুম ছিল না সেখানেও। রুমমেট ছিল। কখনো দুইজন কখনো একজন।
কখনো তারা মাঝ রাতে ফ্যানের স্পিড কমিয়ে দিত নাহলে সকাল বেলায় জানালার পর্দা উঠিয়ে দিত। ঘুম ভেঙে যেত।
এরপর বিয়ে করে বউ এলো ঘরে। বউ এর সাথে একরুমেই থাকতে হচ্ছে ।
একা একটা রুম কি তাহলে কবর ছাড়া আর পাব না!
এসব ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে উঠে গেলাম।
বউ ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করল- কোথায় যাচ্ছ?
উত্তর দিলাম, স্ট্যাডি রুমে।
রাত বেশি বাজে নি। ১২ টা ২৯।
স্ট্যাডি রুমের চেয়ারে বসে থাকতে ভাল লাগছে। এখানেও একটা ফ্যান, তবুও বেড রুমের থেকে গরম কিছুটা কম। বুক শেল্ফ থেকে একটা বই নিলাম।
আগেও পড়া। নতুন বা না পড়া বই নেই।
পড়া বইটার পাতা উল্টাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি ঝিলমিল দাঁড়িয়ে আছে রুমের দরজার পাশে।
আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালাম ওর দিকে, চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলাম উঠে গেলে যে?
ঝিলমিল উত্তর দিল,
- রাত জাগবে?
বললাম, জানি না, দেখি।
ঝিলমিল চলে গেল, ১০ মিনিট পরে দু মগ কফি নিয়ে হাজির।
প্রশ্ন করলাম,
- হঠাত কফি?
- কেন খেতে ইচ্ছে করছে না?
আমি কিছু বললাম না। ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সে বলে উঠল,
- খাবে না তো বললে কেন?
- আমি আবার কখন বললাম! তুমি তো নিজেই নিয়ে এলে!
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল ঝিলমিল। বিয়ের আগে তো প্রায়ই বলতে,
" মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে কেউ যদি এক মগ কফি করে দিত! তাকে দেবী করে রাখতাম ’
আমি তাকিয়ে রইলাম ঝিলমিলের দিকে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ওর হাতে কফির মগটা বেশ মানিয়েছে।
বললাম,
- একদম নড়ো না, এক মিনিটের মধ্যে আসছি।
ঝিলমিল জানে আমি এখন ওর বেশ কয়েকটা ছবি তুলব। এই কাজ আমি আগেও করেছি।
স্ট্যাডি থেকে বেড রুমে গেলাম, ক্যামেরা নিয়ে আবার স্ট্যাডিতে আসতে আমার লাগলো ৪০ সেকেন্ড।
আমাদের দুজনেরই কফি প্রায় শেষ। এই প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও কফি খেতে খারাপ লাগছে না।
আমি ল্যাপটপ অন করলাম। ঝিলমিল আমার পাশেই বসা। ভ্রু কুচকে বলল,
- এখন আবার ব্লগে যাবে??
আমি মুচকি একটা হাসি দিলাম।
ল্যাপটপ অন হতেই ব্লগে গেলাম। রাত প্রায় ১ টা, এই সময়েও ৫৭ জন ব্লগার অনলাইনে আছেন। কয়েকজন প্রিয় ব্লগারের নাম দেখলাম অনলাইন তালিকায়। ঝিলমিলকে বললাম,
- দ্যাখো, দ্যাখো ইনাদেরও মনে হয় গরমে ঘুম আসছে না, এরাও ব্লগে আছে।
কিছুক্ষণ স্ক্রল করতে করতে ব্লগের প্রথম পাতা থেকে একটা কবিতা পাঠ করে ঝিলমিল কে শুনালাম।
পড়া শেষে প্রশ্ন করলাম,
- বল তো এটা কার লেখা?
ঝিলমিল একদম ঠিক জবাব দিল।
ব্লগের প্রায় সবাইকেই ঝিলমিল চেনে। আমার মাধ্যমেই চেনে। আমিই রোজ রাতেই শুয়ে শুয়ে ব্লগ থেকে আজ কি কি পড়লাম কার কার লেখায় কি কি মন্তব্য করলাম এসব নিয়ে কথা বলি ঝিলমিলের সাথে। সেখান থেকে প্রায় সঠিক ও নিখুঁতভাবে ঝিলমিল ওর মনের মধ্যে প্রত্যেকের জন্য আলাদা একটা চেহারা ও লেখার স্টাইল সিলেক্ট করে রেখেছে।
আরও কিছুক্ষণ পরে নির্বাচিত অংশ থেকে একটা কবিতা পড়ে শোনালাম ঝিলমিলিকে।
বললাম,
- বল, এটা কার লেখা?
ঝিলমিল উত্তর দিল, এটা যার লেখা সে লোকটা মোটেই সুবিধার না, মাঝরাতে বউকে দিয়ে কফি বানায়।
আমি হাসলাম। ঝিলমিলও হাসছে।
ঝিলমিল কে বললাম,
- জানো, এই কবিতাটা আজকে নির্বাচিত পাতায় গেছে।
ঝিলমিল কিছুটা বিদ্রূপ করে বলল,
- ওহ আচ্ছা তাই নাকি!
আমার কবিতা আলোচিত পাতায় গেলে আমার বেশ লজ্জা লাগে সেটা জানে ঝিলমিলি।
ঝিলমিল উঠে গেল, আমি ওর পিছু নিলাম। অপুর রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম রুমের লাইট জ্বলছে।
ঝিলমিল আমার দিকে তাকাল, আমি কিছু না বলে অপুর রুমে ঢুকে গেলাম। দেখি অপু বিছানায় বসে আছে। চোখ মুছছে।
- কি হয়েছে অপু, ঘুম ভেঙে গেল কেন ?
- বাবা, অনেক শীত, অনেক শীত ! মা, মা, কম্বল কোথায় ??
(এসির দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা ১৮ ডিগ্রীতে)
ঝিলমিলকে বললাম,
- এত কমিয়েছ কেন ?
ছেলেকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হতে হতে ঝিলমিল উত্তর দিল,
- তোমার ছেলে কি কম ইঞ্জিনিয়ার ! সে নিজেই কমাতে পারে।
অপুকে কোলে করে ঝিলমিল বের হয়ে গেল রুম থেকে, বেড রুমে নিয়ে কম্বলের মধ্যে শুইয়ে দিল।
পিছু পিছু আমিও গেলাম। ছেলেটা হাইচ্চু-মাইচ্চুতে আক্রান্ত হয়ে গেছে। আমি মুখ দিয়ে আফসোস করার শব্দ করলাম। ঝিলমিল আমার দিকে রেগে তাকিয়ে বলল,
- ছেলেটাকে দেখ, রান্নাঘরে যাচ্ছি। (হরলিক্স কিংবা স্যুপ বানাতে) ।
অপুকে একটা ধমক দিয়ে বললাম,
- এই ব্যাটা ! এসি এত কমিয়েছিস কেন ?
- খুব গরম লাগছিল বাবা ! কমাতে কমাতে দেখি ১৮’র নিচে আর কমে না!
( কি সাংঘাতিক কথা! সে আরও কমাতে চেয়েছিল! )
ছেলেটার মাথায় হাত রাখলাম, নাহ ! জ্বর-টর নেই। হঠাত অপু বলে উঠল,
- বাবা, একটা গান শোনাও না ! ভূতের গান।
এত রাতে ভূতের গান ! কি আর করা ! অগত্যা ! গান ধরলাম,
আগডুম বাগডুম আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঢাক -ঢোল ঝাঁঝর ………………
ছেলেটা চিৎকার করে উঠল,
- বাবা ! এটা ভূতের গান ? এটা তো বাচ্চাদের ছড়া !
বললাম, হু তাই তো! একটু ওয়েট কর বাবা তোর মা অনেক ভূতের গান পারে। সে আসুক। সে নিজেই একটা ভূত!
কোত্থেকে হুট করে আমার পিছনে ঝিলমিল এসে হাজির।
অপু চেঁচিয়ে উঠল,
- বাবা বাবা, তোমার পিছনে ভূত !
ঘটনাটা ধরতে পেরেছে ঝিলমিল। একবার আমার দিকে তাকিয়ে ছেলের দিকে গেল, খেঁকিয়ে উঠল,
- এই ভুতের বাচ্চা ওঠ ! স্যুপ খেতে হবে।
নাআআআআ !! আমি স্যুপ খাব না, আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল অপু।
ভাবখানা এমন যেন, “পিতা, এই মহাবিপদ থেকে একমাত্র তুমিই পারো আমাকে রক্ষা করতে।”
অসহায় ভঙ্গিতে অপুর দিকে তাকালাম আমি।
ভাবে-সাবে বোঝালাম, “পড়েছ মোঘলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে”।
একপ্রকার অনিচ্ছাতেই বিছানা থেকে উঠতে উঠতে অপু জিজ্ঞেস করল,
- মা, বাবা তোমাকে ভয় পায় কেন? তুমি কি সত্যিই ভূত ?
ঝিলমিল আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,
- তুমি যাও তো এখান থেকে, তোমার স্ট্যাডিতে যাও। ব্লগিং করো, যা ইচ্ছা করো। ছেলেটাকে স্যুপ খেয়ে ঘুমাতে দাও।
মা আর ছেলেকে রেখে আমি পড়ার ঘরে এলাম। টেবিল ঘড়িতে রাত তিনটা কুড়ি ! এত সময় কখন হয়ে গেল কিছুই টের পেলাম না। চেয়ারে টেনে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম, ব্লগে এখনো ৪৫ জন অনলাইনে আছে। এরা এখনো অনলাইনে কেন? এই ৪৫ জনের তো নিশ্চয়ই ৪৫ টা পরিবার আছে। এদের বাচ্চারও কি সর্দি লেগেছে !
ছবিঃ গুগল