জগৎ আপনা আপনি সৃষ্টি হয়। সহজ ভাষায় বলতে পারেন জগতেরই ইচ্ছাশক্তি জগৎকে সৃষ্টি করে। কারন হিসেবে এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে - সৃষ্টির উপাদান কোথা থেকে এলো? স্রষ্টা এবং সৃষ্টির উপাদান দুটি যদি দুই বিষয় হয়ে থাকে স্রষ্টার একত্ব থাকে না। দ্বিচারী এই তত্ব মেনে নেওয়া যায় না। অতএব এ সকল উপাদান এমন কোন মহাশক্তি হতে এসেছে এবং সেই উপাদান তার ইচ্ছাশক্তির বলে নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করে। যা আবার ধ্বংশের পর সেই স্থানেই ফিরে যাবে। (যদিও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমার ‘স্থান’ শব্দটি উল্লেখ করা উচিত হয় নাই)।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী শন ক্যারল লস এ্যাঞ্জেলস টাইমস্ এর সাথে একটি সাক্ষাতকারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছিলেন। আমি আপনাদের সুবিধার স্বাথে সাক্ষাৎকার টি তুলে ধরলাম। সাক্ষাৎকারে তিনে বলেন “ আপনি যদি বিশ্বাস করে নেন যে মহাবিস্ফোরনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে এবং এর আগে কিছুই ছিলো না, তাহলে সমস্যাটা ব্যাক্ষা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। পর্দাথবিজ্ঞানে এমন কোন সুত্র নেই যাতে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বকে নিম্ন এনট্রপি থেকে শুরু হতে হবে এবং ধীরে ধীরে এনট্রপির পরিমান বাড়তে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে মহাবিশ্ব এমন আচরনই করেছে। আমার অনেক স্মার্ট কলিগ ঠিক এ কথাটাই বলেন। তারা বলেন “তুমি এটা নিয়ে কেনো চিন্তা করছ? আদি মহাবিশ্ব ছোট ছিলো এবং তার এনট্রপি ছিলো খুব কম, এটাই তো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত”। কিন্তু আমি এটা মনে করি এটা এক ধরনের প্রেজুডিস। আমাদের মহাবিশ্বে বিষয়টা এরকম, এ কারনে আমরা মনে করি এটাই প্রাকৃতিক তথা স্বাভাবিক, অন্য কথায় এটাই প্রকৃতির নিয়ম। হ্যা, পর্দাথবিজ্ঞানের বর্তমান সুত্রগুলো দিয়ে এর ব্যাক্ষা করা সম্ভব না। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি, বিষয়টা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেওয়া উচিত নয়। এক প্যাকেট কার্ড নিয়ে প্যাকেট থেকে সেগুলো বের করলে হয়তো দেখা যাবে, সবগুলো ক্রমান্ময়ে সাজানো আছে। কিন্তু, এক প্যাকেট কার্ড থেকে দৈবভাবে কিছু কার্ড নিলে এটাই স্বাভাবিক যে, সেগুলো অগোছালো হবে। নিম্ন এনট্রপির সাথে উচ্চ এনট্রপির সংর্ঘষটাও এখানে। কার্ডেও প্যাকেট খুললে সবগুলো কার্ড সাজানো অবস্থায় দেখা যায়। এটা দেখে আপনি আশ্চার্যান্বিত হন না। কারন এটা নয় যে, সাজানো অবস্থায় থাকাই স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। বরং মূল কারন হচ্ছে, কার্ডের প্যাকেট কোন বদ্ধ ব্যবস্থা নয়। প্যাকেটটাও এ থেকে বড় কোন ব্যবস্থা থেকে এসেছে যে ব্যবস্থায় একটা কারখানা ছিলো আর সে কারখানাতেই কার্ডগুলো সাজানো হয়েছে। তাই আমি মনে করি, এর আগে আরেকটি মহাবিশ্ব ছিলো যা আমাদের তৈরী করেছে। এক কথা, আমরা সেই বৃহৎ মহাবিশ্ব থেকে বেরিয়েছি। এটা বৃহত্তর কোন স্থান-কাল থেকে এসেছে যাকে আমরা পর্যবেক্ষন করতে পারি না। উচ্চ এনট্র্রপির কোন বৃহত্তর স্থানের অতি সামান্য এক অংশ থেকে আমাদের এই মহাবিশ্ব এসেছে। আমাদের এই মহাবিশ্ব বৃহত্তর কোন স্থান-কাল থেকে উদ্ভুত। উচ্চ এনট্রপির বৃহত্তর স্থানের অতি সামান্য অংশ থেকেই আমাদের এই মহাবিশ্ব এসেছে। আবার সকল জড়জগৎ ধ্বংশ হলে মুল সত্ত্বা উচ্চ এনট্রপিতে ফিরে যাবে।”।
শন ক্যারলের উপলদ্ধিবোধ নিয়ে আলোচনা করলাম। কারন উচ্চ এনট্র্রপির বৃহত্তর কোন স্থান কাল বিষয়টি ভাবতে গেলে ভাবনা থেমে যায়। তাহলে এজগৎ কোথা থেকে এসেছে? উচ্চ এনট্র্রপির বৃহত্তর কোন স্থান কাল থেকে। আল কোরানে তিনি বলছেন “তিনি গুপ্ত এবং তিনিই ব্যাক্ত (প্রকাশ্য)”। এজগতে যা কিছুই দেখা যায় আবার যা কিছু দেখা যায় না তাই তিনি। আমি মনে করি উচ্চ এনট্র্রপির বৃহত্তর কোন স্থান কাল একটি চেতনা মাত্র। এবং সেই চেতনা হতে উদ্গত এই জগৎ সৃষ্টির শুরুতে শুধু চেতনাই ছিলো যা পরবর্তীতে নিজ ইচ্ছাশক্তিতে নিজেই নিজেকে এরুপে সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই রুপ স্থির নয়। একটি নিদীষ্ট সময় পর তা ধ্বংশ হবে এবং ঠিক আগের উচ্চ এনট্র্রপির বৃহত্তর কোন স্থান কালে পরিনত হবে। আল কোরআন বলে “আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংশশীল” (২৮:৮৮)
ষ্টিফেন ডব্লিউ হকিং তার “ গ্রান্ড ডিজাইন” বইতে পদার্থের সুত্রসমূহ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। হকিং তার বইটির নিয়মের নীতি শিরোনামের ২য় অধ্যায়টিতে পদার্থবিজ্ঞানের সুত্র বলতে কি বোঝায়, কিভাবে সেগুলো উদ্ভুত হতে পারে সে সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যপক আলোচনা করেছে। তাদের প্রশ্ন ছিলো নিয়মগুলো কিভাবে উদ্ভুত হলো? তিনি প্রসঙ্গমতে এই নিয়মগুলোকে জগতের পরিচালক বা ইশ্বর বলে অভিহিত করেছে।
তাহলে এখন আমরা আসি আল কোরআনের আয়াতে। আল কোরআন নিয়মগুলো নিয়ে কি বলে? আল কোরআন বলে “ বিধান তাহার এবং তাহারই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হইবে।”(২৮:৮৮) বিধান শব্দের অর্থ নিশ্চয় বুঝছেন? বিধান বা বিধি বা নিয়ম বা সুত্র। এটাকে পদার্থের সুত্র, জগৎ পরিচালনার নিয়ম যাই বলুন না কেনো সেটা আল্ল্রার। বিধান এবং আমরা বলতে বস্তুর উপাদান তার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবো। আল কোরআন আমাদের দুটি বিষয় তুলে ধরলো। আমরা দুটি জিনীষ পেলাম । আমরা বলতে বস্তু সকল যা শক্তিতে পরিনত হয় এবং বিধান বলতে জ্ঞান বা সুত্র যা অদৃশ্য বিষয় এক আমরা এবং দ্বিতীয়টি বিধান বিধি। শক্তি এবং জ্ঞান তার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। এক সর্বশক্তিমান এবং দ্বিতীয়টি সর্বজ্ঞানী। অতএব জগৎ সৃষ্টিতে দুটি উপাদান ব্যবহার হয়েছে। শক্তি ও সুত্র। সুত্রই পদার্থের পরিচালক। দৃশ্য এব্ং অদৃশ্য। অদৃশ্য জগৎই দৃশ্যমান জগতকে পরিচালনা করে। কম্পিউটার নির্মানে যেমন ০ এবং ১ কোডিং ব্যবহার হয় ঠিক তেমনি এই জগতের সৃষ্টিতে শক্তি ও জ্ঞান নামক কমান্ড ব্যবহার করা হয়েছে। শক্তি এবং জ্ঞানের পূর্বে ছিলেন তিনি “আল্লার সত্ত্বা”। আল্লার সত্ত্বাটি কি? একটি চেতনা। “আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সমস্ত কিছুই ধ্বংশশীল, বিধান তাহার এবং তাহারই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হইবে।”(২৮:৮৮) সর্ম্পন্ন আয়াতটি পড়লে বোঝা যায় আমরা যা কিছু দেখি যা সমগ্র জগৎ তা ধ্বংশশীল। চিরন্তন বলে যা থাকবে তা আল্লার সত্ত্বা বা চেহারা বা একটি চেতনতা। এবং সেই সত্ত্বার কাছে আমরা অথাৎ আমাদের জীবনের মুল সত্ত্বাটি ফিরে যাবে। লক্ষ্য করুন আধুনিক বিজ্ঞান ঠিক একই কথা বলছে। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে “জীবনের মূল সত্ত্বাটি টিকে থাকে”। আন্দ্রে লিন্ডে তো কথায় কথায় নিজেই বলেছেন ‘মহাবিশ্ব যদি কখন ধ্বংশ হয়ে যাইও জীবনের মূল সত্ত্বাটি হয়তো টিকে থাকবে অন্য কোন মহাবিশ্বে’ অন্য কোন ভাবে।’ অন্য কোন মহাবিশ্বে বা অন্য কোনখানে বলতে লিন্ডে কি বুঝিয়েছেন? তাহলে মহাবিশ্ব কি আবার সৃষ্টি হবে?
মহাবিশ্বর সৃষ্টি এবং ধ্বংশ নিয়ে আল কোরআন কি বলে? আল কোরআন এ বিষয়ে বলছে “যিনি আদিতে সৃষ্টি করেন তিনি আবারও সৃষ্টি করিবেন” (২৭:৬৪) তাহারা কি লক্ষ্য করে না কিভাবে আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করিয়াছেন তিনি অনুরুপ সৃষ্টি করিতে সক্ষম। তিনি উহাদের জন্য স্থির করিয়াছেন একটি কাল। ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।” (১৭:৯৯) “সেইদিন আকাশকে গুটাইয়া ফেলিব যেভাবে গুটানো হয় লিখিত দফতর, যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করিয়াছিলাম, সেইভাবে পূনরায় সৃষ্টি করিবো।” (২১:১০৪) এই আয়াাত গুলো দিয়ে প্রমানিত হয় এই মহাবিশ্ব একটি সময়ের চক্রে সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং তিনি এই মহাবিশ্ব আবারও সৃষ্টি করিবেন। আল কোরআন বলছে মহাবিশ্ব আবার সৃষ্টি হবে। তাহলে কিভাবে? বিধান অথাত সুত্র বা ফমূলা তার নির্দেশ কি একই রকম হবে? কিন্ত প্রশ্ন হলো যদি তাই হয় তাহলে সৃষ্টির পূর্বের বিধান বা বস্তুগত নিয়ম কি প্রতিষ্ঠিত থাকে? নাকি পরবর্তী মহাবিশ্বের বিধান (পদার্থের সুত্র) সমূহের পরিবর্তন ঘটে? আবার যে সৃষ্টি হবে সেটা কি এরকম হবে নাকি অন্য রকম হবে?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২২ রাত ১০:২৬