চিরুনীর আচড় এখনও যখন মাথার সেলাই দেওয়া অংশে ভুলক্রমে উঠে যায়, কেঁপে উঠি ব্যাথায়, বাজারের ব্যাগটি তুলতে গিয়ে যখন ভাঙ্গা আঙ্গুলটি চিন চিন করে ওঠে, ঝাকুনি দিয়ে ওঠে শরীর। সেদিনের কথা স্মরণ হয়।
দিবস মেনে আমাকে ২৮শে অক্টোবর স্মরণ করতে হয়না, প্রতিদিনের ছোটছোট ব্যাথাগুলো আমাকে প্রতিদিনই ২৮শে অক্টোবরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
মনে পড়ে সেদিনটির কথা। কিচ্ছু ছিলনা আমাদের হাতে। জীবনে এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করিনি কোনদিন। সাত সকালে ফ্রিজ থেকে বের করে দেয়া মায়ের হাতের গরম করা পোলাউ খেয়ে বের হয়েছি পল্টনের উদ্দেশ্যে। সব মিলে মোটে প্রায় ২৫জন ছিলাম পল্টন মসজিদ গলিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্লোগান। দেখি সবার হাতে লগি বৈঠা। কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই দেখি বৃষ্টির মত ইট এসে পড়ছে। কি করবো বুঝতে পারছিলামনা। অন্যদের দেখাদেখি আমিও ওদের ছোড়া ইটগুলো পাল্টা ছুড়তে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ধাওয়া দিয়ে কাকরাইলের দিকে তাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু কাকরাইলের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শত শত মানুষের বিশাল এক মিছিল এগিয়ে আসছে, প্রত্যেকের হাতে উদ্ধত লগি বৈঠা।
জীবনে মঞ্চে বহু গান গেয়েছি। শহীদি গান, কাশ্মির কি ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মীতা নিয়ে গান। কিন্তু সত্যিকারের ময়দানে দাঁড়িয়ে মনে হলো মঞ্চে গান গাওয়া আর বাস্তবে মৃত্যুকে ময়দানে মোকাবেলা করা- আকাশ পাতাল তফাৎ। এগিয়ে আসছে আকাশ কাঁপানো মিছিল, আমি আতঙ্কে ফ্রিজ হয়ে আছি। ভাবছি, আমাদের এ কয়জনের উপর দিয়ে ওরা যদি শুধু হেঁটে যায়, তাতেই চলবে, স্রেফ পিষে যাব। এক মুহুর্তে কত ভাবনা ঘুড়ে ঘুড়ে এলো মাথায়, আজকের সংঘাত হয়তো এখানেই শেষ, দিন শেষে ফিরে যাব যার যার গৃহে, কিন্তু এমন আতঙ্ক নিয়েই তো প্রতিটি দিন পার করে ফিলিস্তিন, কাশ্মিরের জনগণ। কেন যেন ভাবনাগুলো মুহুর্তের মধ্যে ঘুরে গেল মাথা থেকে।
মাথায় চিন্তা এলো- যা হয় হোক, পালাবোনা। গলির মধ্যে ঢুকে আগের জায়গায় দাঁড়ালাম সবাই । এগিয়ে আসা মিছিল আমাদের গলিমুখে থমকে দাঁড়ালো। শুরু করলো বৃষ্টির মত ইট নিক্ষেপ। আমরাও যথাসাধ্য ফিরিয়ে দিলাম। কিন্তু কতক্ষণ? একটি ইট এসে লাগলো মাথায়। পৃথিবীটা দুলে উঠলো যেন। মাথাটা হাত দিয়ে চেপে পিছু হটতে লাগলাম। আরেকটি ইট এসে পড়লো সেই চেপে ধরা হাতে। মধ্যমা আঙ্গুলটি ভেঙ্গে গেল। একটু নিরাপদে এসে দাঁড়াতেই টের পেলাম রক্তের স্রোতে ভিজে যাচ্ছে শার্ট। কে একজন একটি টিস্যু দিল। চেপে ধরে দাঁড়াতেই একজন জোড় করে মহানগরী অফিসের দিকে ধরে নিয়ে চললো। পথে দেখলাম একের পর এক রক্তাক্ত ভাইদেরকে পল্টনের দিক থেকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে তাদের সাথীরা। সে এক বিভৎস দৃশ্য।
মাথায় সেলাই ও ব্যান্ডেজ বেধে দুপুরের পরে যখন ফিরেছি আবার, ততক্ষণে আমার পাশে থাকা মুজাহিদ ভাইয়ের শাহাদাতের খবর পেলাম। চলেই গেলেন তিনি চীরতরে। আজ বিকেলে যখন শহীদ মুজাহিদ ভাইয়ের বাবার সাথে দুই বছর পর পিরিচিত হলাম। বললাম, সেদিন আমি আর মুজাহিদ ভাই এক সাথেই ছিলাম। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। শুধু কষ্ট ঠেলে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার কি নাম?
দীর্ঘদিন ভাঙ্গা আঙ্গুলটি নিয়ে আমি একপ্রকার অসহায় ছিলাম। মা সতর্ক ছিলেন সর্বক্ষণ। ছোট বোনকে কড়া নির্দেশ দিলেন, যেন প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আমার মশারী টানিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন গোসলের পরের ভেজা কাপড় মা নিজের হাতে ধুয়ে দিয়েছেন। কম্পিউটারের কী বোর্ডে বহুদিন হাত দিতে পারিনি। আমার সে ভাঙ্গা আঙ্গুলটি আজো এক প্রকার অকর্মণ্য। জানিনা আদৌ ঠিক হবে কিনা।
কি হবে এসব স্মৃতি কথা বলে। আমি তো মাতৃক্রোড়ে ফিরে এসেছিলাম মাতৃস্নেহ জয় করে। ১৪ জন ভাইতো সেদিন চিরতরে চলে গেলেন এক অন্ধ রাজনীতির কবলে পড়ে। আমার চেয়ে অনেকগুণে আহত হয়ে আজো কাতড়াচ্ছেন শত শত ভাই।
কি দোষ করেছিলাম? ঢাকা শহরের এক বাড়িওয়ালার সন্তান হয়ে নিরাপদে, সুখেই তো কাটাতে পারতাম জীবন। কুরআন-হাদিস পড়ে জানলাম পৃথিবীতে আল্লাহর বান্দাহদের দায়িত্ব শুধু ভোগ আর জীবন পার করা নয়। বরং যে আল্লাহ আমাকে খলিফা হিসেবে পাঠিয়েছেন, তার দেয়া দায়িত্ব পালন করা। তার দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো। সে চেষ্টা করতেই তো একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠনে যোগ দিয়েছিলাম। সেটাই কি আমার অপরাধ? কই, যারা আমার সংগঠনের বিরোধিতা করেন, তারা তো নিজেরা আল্লাহর দ্বীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নিয়ে আমার নিকট আসেননি কোনদিন। আমি তো প্রস্তুত, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ঘোষণা করে, সবার আগে আমি সেখানে যাব ইনশাআল্লাহ। কিংবা বিএনপি যদি করে, আমি বৃহৎ দল হিসেবে তাদের সাথে যোগ দেব। কিন্তু, কেউ তো আসেনা। শুধুই বিরোধিতা, শুধুই ত্রুটি অনুসন্ধান।
জানি, নবীদের ইতিহাস বলে, কোন নবীর সত্য দাওয়াতই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। সমাজের কুলিন শ্রেণীর লোকেরাই সে দাওয়াতকে সবার আগে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটাই ইতিহাস। রাসুল সা. এর ক্ষেত্রেও সে ঘটনাই ঘটেছে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যারই কথা বলবে, কর্মসূচি ঘোষণা করবে, তাদের বিরুদ্ধেই কায়েমী স্বার্থবাদিরা হিংস্র হয়ে উঠবে। কোথাও 'স্বাধীনতা বিরোধিতা' ইস্যু, কোথাও সন্ত্রাসবাদ, কোথাও অন্য কিছু। স্বাধীনতা বিরোধিতাই যদি আমাদের বিরুদ্ধে একমাত্র ইস্যু হয়, তবে ১৯৬৯ এ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে মালেক ভাইকে এভাবে নির্মমভাবে জীবন দিতে হতোনা। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের কল্যাণময় সমাজের বিপক্ষে আওয়াজ যুগে যুগে উঠেছিল, ভাবিষ্যতেও উঠবে।
তবে 'আতঙ্কের' কথা হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যও প্রতিটি জনপদে একদল মানুষ থাকবে। মাথা উচু করবে। শত বিরোধিতা সত্বেও জনগণের মন জয় করে সুন্দরের পথে এগিয়ে যাবে। ২৮শে অক্টোবরে আমার কয়েকফোটা রক্ত যদি আল্লাহ কবুল করেন, আমি তাতেই তৃপ্ত। যে শত শত ভাই আহত হয়েছেন, সকলেরই একই দোয়া।
যারা চলে গেছেন, তাদের আত্মীয় স্বজনরা আমৃত্যু চোখের পানি ফেলবেন। সে চোখের পানির বদৌলতে যদি আল্লাহ এ জমিন থেকে হিংসাত্মক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষদাত উপড়ে ফেলেন, তবেই সে চোখের পানি স্বার্থক, সে রক্ত স্বার্থক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হিংসা আর রক্তধারা ঘুচে আদর্শিক প্রতিযোগিতা আসুক। আজকের দিনে এটিই প্রত্যাশা।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ৭:৪০