আগের রাতে ফিশ ফ্রাই খেয়ে হোটেলে ফিরে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে হিমশীতল কামরায় লেপমুড়ি দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারালাম। ঘুমটা যখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে নিজের রাজত্বে তখনই বেরসিক এলার্ম বেজে উঠলো... কি আর করা, কোন মত নিজেকে তুলে নিয়ে শাওয়ারের নীচে ছেড়ে দিলাম। ট্যুরে বের হলে, খুব সকাল সকাল উঠে রওনা দেয়ার জন্য এর চেয়ে ভাল কিছু নাই। যাই হোক নিজে তৈরী হয়ে বাকী সবাইকে তাড়া দিলাম তৈরী হয়ে নিতে। আজও ভোর পাঁচটা নাগাদ চেক আউট করতে হবে হোটেল থেকে। ঠিক ভোররাত পাঁচটা দশে আমরা যখন গাড়ীতে চেপে বসলাম, আমাদের ড্রাইভার মিঃ বিনয় পি যোশ আমাকে মনে করিয়ে দিল যে, আমরা দশ মিনিট লেট

তামিলনাড়ু'র কণ্যাকুমারী হতে আমাদের গাড়ী ছুটে চলল আড়াইশ’ত কিলোমিটার দূরের কেরালা রাজ্যের আলিপ্পে শহরের দিকে। বেলা নয়টা নাগাদ ত্রিভান্দ্রাম পার হয়ে একটা রোড সাইড ধাবা টাইপের রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সারা হলে পরে ফের যাত্রা। ২৫০+ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেলা ১২টা নাগাদ এসে পৌঁছলাম আল্লিপপে, সরাসরি চেকইন হাউজবোটে। কেরালা’র হাউজবোটগুলো সত্যিই চমৎকার, কাঠ, বাঁশ আর কিছু ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরী এই নৌঘর’গুলোতে রয়েছে বেডরুম, ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন সহ একটি ফ্ল্যাটের সকল সুবিধা। বিগ স্ক্রিন এলইডি টিভি, ডিভিডি প্লেয়ার...
আলিপ্পের বিখ্যাত “রামাদা” হোটেল সংলগ্ন জেটি’তে আমরা যখন পৌছলাম; তখন ঘড়িতে প্রায় এগারোটার উপরে। আমাদের হাউজবোটে চেকইন করার সময় সকাল দশটায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছে শুনি; এখনো হাউজবোট রেডি হয় নাই। পরে জানতে পারি যে, আমাদের আসতে একটূ দেরী হবে শুনে ভোরবেলা ঘন্টা তিনেকের জন্য আরেকটা ইউরোপীয় পর্যটক গ্রুপকে নিয়ে ব্যাকওয়াটার ট্যুর করে এসেছে। :O বেশকিছুটা সময় অপেক্ষার পর, আমাদের পদার্পন ঘটল আমাদের আগামী ২৪ ঘন্টার নিবাস, “Golden Mist Yacht” এ। দু’টি বেডরুম, একটি ডাইনিং এন্ড ড্রইং স্পেস, পেছনে রান্নাঘর, তারও পেছনে ইঞ্চিন রুম, জেনারেটর; মোটামুটি সুন্দর আয়োজন। কেরালার হাউজবোটগুলো সিঙ্গেল রুমের থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ দশ বেডরুমের দ্বিতল হয়ে থাকে। এছাড়া শ’খানেক লোক নিয়ে পিকনিক টাইপ আয়োজন করার মত ভিন্নধরনের হাউজবোটও রয়েছ। সকাল বেলা চেকইন করে পরদিন সকাল পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কিলোমিটারের ব্যাকওয়াটার রাইড করে ফের আগের যায়গায় ড্রপ করে দেয়; রাতে প্রতিটি বোটের নিজস্ব কোন স্থল আবাসের সংলগ্ন স্থানে পার্ক করা হয় বোট। সেখান হতে কানেকশন দিয়ে রাত ন’টা হতে ভোর ছ’টা পর্যন্ত বেডরুমগুলোতে এসি সংযোগ দেয়া হয়। এই ২৪ ঘন্টার ট্যুরে তিনবেলার মূল খাবারের সাথে সকাল বিকাল হালকা নাস্তা, চা দেয়া হয়। ভাড়া বোট ভেদে ৫,০০০ রুপী থেকে ৮,০০০ রুপী; প্রতি সিঙ্গেল রুমের জন্য। প্রতিরুমে ডবল বেড; দুইজন গেস্টের জন্য। এক্সট্রা ম্যাট্রেস দিয়ে তৃতীয় একজন থাকা যায় রুমে; সেইক্ষেত্রে থার্ড পারসনের জন্য আলাদা চার্জ করা হয়।
যাই হোক; আমরা চেকইন করে কিছু ছবি তুলে রুমে গিয়ে গোসল সেরে বোটের সম্মুখপানের ড্রইং রুমে বসে ভুবনখ্যাত কেরালার ব্যাকওয়াটারের সৌন্দর্য উপভোগ করার মাঝে ডাইনিং টেবিলে খাবার চলে এল। আইটেম মন্দ নয়; ভাত, দু’তিন পদের সবজি, রূপচাঁদা ফ্রাই, কেরালার নারিকেল ডাল জাতীয় একটা পদ... কেরালার স্পাইস দিয়ে রান্না করা খাবার পেটপুরে খেলাম। যদিও আমার ভ্রমণ সঙ্গীরা বরাবরের মত তৃপ্তি করে খেতে পারলো না। শেষে রাতের খাবারের জন্য রান্নাঘরে গিয়ে আমাদের বোটের রাঁধুনি ভদ্রলোক

বিকেলবেলা পাকোড়া আর চা দিয়ে নাস্তা করতে করতে বোট এসে ভিড়ল, একটা ছোট্ট গ্রামে; সারি সারি বোট ভিড়ে আছে সেখানে। বোট হতে নামতে দেখলাম ছোট ছোট দোকান; স্থানীয় নারী-পুরুষ চালাচ্ছে সেসব। নানান মাছ; ফল, আইসক্রিম, নানান পদের সফট ড্রিংকস, চকলেট, চিপস ইত্যাদি সাজিয়ে বসেছে। আমরা সেখান হতে রূপচাঁদা কিনে নিলাম, প্রতি পিস দুইশত রুপীতে। সেই রূপচাঁদা আমাদের বোটের শেফ এর হাতে দিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যের পর যখন মেমরী কার্ড হতে (বোটেই ছিল) “বাজরাংগী ভাইজান” মুভিটি দেখছিলাম আর নয়টা বাজার অপেক্ষা (অত্যাধিক গরমে অস্থির তখন); তখন সেই মাছ ফ্রাই করে নিয়ে এল আমাদের শেফ বাহাদুর। আমার এই এক জীবনে যত মাছভাজা খেয়েছি; তা ছিল সবচেয়ে সেরা। পারফেক্ট মসলা, ঝাল এবং ফ্রাই। সফট এন্ড ইয়াম্মি... তখন দুঃখ হল কেন আরও এক পিস করে কিনে নিলাম না।
এরপর মুভি শেষে রাতের খাবার; ভাত, সবজি, ডাল, মুরগীর মাংস, সালাদ; এবার যদিও মসলার যন্ত্রণা কিছুটা কম ছিল; কিন্তু এক্কেবারেই ছিল না বলা যাবে না; আগেই ব্যাখ্যা করেছি। আমাদের শেফ চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এসব মসলা ছাড়া কিভাবে রান্না করা যায়’। শেফ প্রসঙ্গে বলি, আমি বিকেলবেলা চায়ের খোঁজে রান্না ঘরে গিয়ে দেখি সে রাতের খাবারের আয়োজন করছে। তখন তার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, সে পেশায় কি করে? উত্তরে বলল, “রান্না”। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায়? কোন রেস্টুরেন্ট নাকি হোটেলে?”। সে অবাক হয়ে উত্তর দিল, কেন? এই বোটে। আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, “মানে কি?” সারা মাস এই বোটে গেস্ট আসে? সে আমাকে আরও অবাক করে জানাল, মাসে ২২ থেকে ২৬ দিন টানা বুকিং থাকে। সারা ভারতে তাদের ছয়টি এজেন্টের মাধ্যমে গেস্ট আসে, কখনো একই দিনে দুইদল গেস্ট চলে আসলে সামলাতে মুশকিল হয়; যেমন আজ সকালে হয়েছিল। এরপর আরও গল্পে গল্পে জানা গেল, কেরালার এই হাউজবোট ইন্ডাস্ট্রি’র অনেক কথা। “ইন্ডাস্ট্রি” শুনে অবাক হচ্ছেন? কেরালা ব্যাকওয়াটারের হাউজবোটে একদিন না কাটালে বুঝা যাবে না সেই কর্মযজ্ঞ। আমরা গিয়েছিলাম অফ সিজনে, তখনই হাজারে হাজার বোট চলতে দেখেছি সেখানে।
তো আজকের গল্প এখানেই শেষ; খাবার শেষে ঘুমাতে গেলাম। অনেকদিন পর সকালে উঠার তাড়া নেই; কাল সকাল দশটার পর হাউজবোট হতে চেক আউট। সো... নো টেনশন। শুভরাত্রি।

আগের পর্বগুলোঃ
যাত্রা শুরুর গল্প (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০১)
ট্রানজিট পয়েন্ট কলকাতা... অন্যরকম আতিথিয়তার অভিজ্ঞতা (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০২)
অবশেষে কোচিন - তৃতীয় রাতে যাত্রা শুরুর স্থানে (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৩)
ডেস্টিনেশন মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৪)
মুন্নার টি মিউজিয়াম (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৫)
মুন্নার ভ্রমণ - মাতুপত্তি ড্যাম এবং ব্লোসম পার্ক (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৬)
ইকো পয়েন্ট এবং টপ ষ্টেশন অফ মুন্নার (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৭)
ট্রিপ টু কুলুক্কুমালাই... (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৮)
পেরিয়ার লেক - ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি (থিক্কাদি - কেরালা) (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ০৯)
শিকারা রাইড এন্ড সানসেট এট ব্যাকওয়াটার (কুমারাকোম - কেরালা) (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১০)
কোভালাম সী বিচ (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১১)
কন্যাকুমারী দর্শন (ট্রিপ টু কেরালা ২০১৬) (পর্ব ১২)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১:৫১