অনেকটা সময় আনমনে হাঁটার পর রন্তুর খেয়াল হল পথ ভুল করে সে অচেনা কোন জায়গায় চলে এসেছে। আগে কখনো এখানে এসেছে বলে মনে পরে না। কিন্তু, কীভাবে সে এখানে চলে এসেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে মনে ভয় হচ্ছে, সে যদি আর বাসায় ফিরতে না পারে? ভাবতেই কেন জানি খুব কান্না পেল। আপ্রাণ চেষ্টা করল এভাবে রাস্তায় কান্না না করার। কিন্তু সেই চেষ্টা করার কারনেই কি না, তার গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল। কেন যেন মনে হচ্ছে সে আর কখনই বাসায় ফিরতে পারবে না।
কিছু সময় পর আতঙ্ক কেটে গেলে রন্তু একটা বুদ্ধি বের করল, উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল। কিন্তু কিছু দূর এসে যখন একটা চৌরাস্তায় এসে পড়ল, তখন দ্বিধায় পড়ে গেল। এখন কোন দিকে যাবে? চৌরাস্তার মুখে একটা দোকান দেখে দোকানীকে জিজ্ঞাসা করল তার নানুর বাড়ীর এলাকায় যাওয়ার পথ কোনটা? লোকটা খুব অবাক হল। রন্তুকে বলল, অনেক দূর, হেঁটে গেলে দুই-তিন ঘণ্টা লাগবে। রন্তু ঘাড় কাত করে বুঝিয়ে দিল কোন ব্যাপার না। রন্তুর ভয় হচ্ছিল লোকটা যদি বুঝে যায় সে হারিয়ে গেছে, তাহলে হয়ত তার কোন বিপদ হতে পারে। কে জানে, হয়ত তাকে ছেলেধরা দলের কাছে বিক্রি করে দিল! রন্তু লোকটির দেখানো পথ এবং নির্দেশনা মতে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ আগের অজানা ভয়ের অনুভূতি অনেকটাই কেটে গেছে, এখন চারিদিকের রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মানুষজন দেখতে দেখতে সে হাঁটতে লাগল।
(পূর্ব ঘটনা প্রবাহঃ রন্তু, শায়লা আর জাভেদের একমাত্র সন্তান। জাভেদের সাথে শায়লার প্রনয় থেকে পরিণয়, পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর শায়লা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে জাভেদ ভয়ঙ্কর রকমের মানসিকভাবে অসুস্থ। এক সময় মানিয়ে নিতে না পেরে ছোট্ট শিশু রন্তুকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। তাদের মিউচুয়ালি ডিভোর্স হয়ে গেছে। মা-বাবার এই টানাপোড়নে শিশু রন্তুর মানসিক জগতের গল্প, সাথে তার নিত্যদিনকার প্যাচালি, এই হল এই গল্পের উপজীব্য। কয়েক মাস আগ পর্যন্ত জাভেদ রন্তুকে স্কুলের গেটে মাসে এক-দুইবার দেখা করতে আসতো, গত মাস ছয়েক আগে শেষবারের মত ছেলেকে দেখতে এসেছে। মানসিক সমস্যাগ্রস্থ জাভেদ পরিবার, আত্মীয় পরিজন হতে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী জীবন পথে হেঁটে চলেছে। অপর দিকে রন্তুর মা শায়লা এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করছে, যেখানে তার এক সিনিয়র পোস্টের সহকর্মী ইরফানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে গড়িয়েছে প্রণয়ের। ইদানীং রন্তুর মাঝে একটি মানসিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে, সে বাবা-মা সহ নিজেদের একটি পরিবার খুব মিস করে। আর সেই অপ্রাপ্তি থেকে সে নিজের মনে একা একা এক কাল্পনিক জগতে বিচরন করে। এরমাঝে শায়লার প্রবাসী বড়ভাই দেশে এসেছে ছুটিতে। কিছুদিন আগে রন্তু মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছিল, ডাক্তাররা প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু কোন বিপদ ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু বিপদ যখন আসে, চারিদিক দিয়েই আসে। রন্তুর বাবা জাভেদ বহুদিন পর দেখা দিয়েছিল উপন্যাসে। শায়লাকে ইরফানের সাথে বাইরে ঘোরাফেরা করতে দেখে উত্তেজিত হয়ে বাসায় এসে বাজে আচরণ করেছে এবং ফলস্বরূপ শায়লার বড় ভাই শিপলু তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। গত কয়েক পর্বে দেখা গেছে শায়লা'র সাথে ইরফানের প্রনয়, পরিণয়ের দিকে গড়াচ্ছে। ইরফান শায়লাকে বিয়ে করে বিদেশ নিয়ে যেতে চায়। বছরখানেকের মধ্যে রন্তুকেও তাদের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু শায়লার মা আর বড় ভাই এই সম্পর্ক মেনে নিতে রাজী নয়। এই নিয়ে প্রায়ই বাক-বিতন্ডতা চলে শায়লা আর তার মা'র মাঝে। এইসব ঘটনা পরিক্রমা রন্তুর মনোজগতে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। তার আচরণে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাবা-মায়ের সম্পর্কের এই টানাপোড়নের সাথে তার শিশু মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং পরিবারের মানুষগুলোর মিথস্ক্রিয়া’য় কেমন চলছে আমাদের রন্তুর জগত তা জানার জন্য আসুন এবার আবার শুরু করা যাক)
‘এই রন্তু, তুই এখানে কি করছিস?’ রন্তুর পেছন হতে কে যেন ঘাড়ে হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল। ঘটনার আকস্মিকতায় রন্তু প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেল ছোট মামাকে। রন্তু এতোটাই অবাক হল যে, কয়েক মুহূর্ত কোন কথাই বলতে পারছিল না। একটু ধাতস্ত হতেই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘তুমি তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে। উফ...’। রন্তুর ছোট মামা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই এখানে এলি কার সাথে? বাবা এসেছিল স্কুলে?’। রন্তু ঘাড় নেড়ে জানালো “না”, ঠোঁটটা বড়দের মত বাঁকিয়ে বলল, ‘আমি বুঝি একা একা তোমাদের মত ঘুরে বেড়াতে পারি না, হুহহ...’। শিবলি ভাগ্নের কথা বলার ধরন দেখে হেসে দিল। একা একা সেই পুরাতন ঢাকার স্কুল হতে রন্তু এই শাহজাহানপুর কিভাবে চলে এল এটাই এক বিস্ময়! নিশ্চয়ই হাঁটতে হাঁটতে পথ ভুল করে চলে এসেছে। পুঁচকেটার ইদানীং এই অভ্যাস হয়েছে, স্কুল ছুটির পর এলোমেলো হেঁটে বেড়ায়, খুব মায়া লাগে ছেলেটার জন্য। কিন্তু তাই বলে এতো দূর!
রন্তু মামা’র সাথে রিক্সায় চেপে বাসায় ফিরছে, চুপচাপ চারিপাশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। বেলা অনেক গড়িয়েছে বুঝতে পারছে রন্তু, চারিদিকে সূর্যের আলোর রুপ দেখে বুঝতে পারছে দুপুর গড়িয়ে সময়টা এখন বিকেল ছুঁয়েছে। বাসায় গেলে না বুঝি কি বকাটাই খেতে হবে নানু আর মা’র কাছ থেকে। পর মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল এখন আর কেউ তাকে কিছু বলে না, এমন কি সে কখন কি করছে তাও বুঝি কেউ লক্ষ্য করে না।
‘কি রে, বোবা হয়ে বসে আছিস কেন?’
‘এম্নি, দেখছি...’
‘কি দেখছিস?’
‘এই তো রাস্তাঘাট’
‘রাস্তাঘাট! খোকা তুমি কোন লঞ্চে ঢাকা এসেছ? ঢাকা শহরে প্রথম বেড়াতে এসেছো বুঝি?’ শিবলি মজা করে বলল। ছোট মামার কথায় রন্তু’ও খুব মজা পেয়েছে, ঘাড় নেড়ে মামার কথায় সম্মতি জানালো।
হঠাৎ রন্তু “বাবা, বাবা...” বলে শিবলির হাত জোরে চেপে ধরে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে গেল। রন্তুর চিৎকারে রিকশাওয়ালা হুট করে ব্রেক কষল। শিবলির হাত চেপে ধরে থাকায় রন্তু রিকশা হতে ছিটকে গেল না। শিবলি ঘটনা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
‘কিসেরে বাবা? কোথায় বাবা?’ শিবলি রন্তুকে জিজ্ঞাসা করল।
‘ঐ পেছনের গলিতে...’ রিকশার পেছন দিকে বাম পাশের একটা গলির দিকে ইশারা করল রন্তু।
‘এই চলন্ত রিকশা থেকে ঐ গলির ভেতর বাবাকে দেখে ফেললি!’
‘সত্যি মামা, বাবাকে আমি ঐ গলির ভেতরে ঢুকতে দেখেছি।’
ভাগ্নের চেহারা দেখে মনে হল সে এখনি কেঁদে ফেলবে। শিবলি রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘুরিয়ে ঐ গলির দিকে নিতে বলল। রিকশা গলির মুখে যেতেই রন্তু লাল-কালো চেকের একটা শার্ট আর নেভিব্লু ট্রাউজার পরিহিত একটা লোকের দিকে ইশারা করল। পেছন থেকে দেখতে অনেকটা রন্তুর বাবা’র মতই দেখাচ্ছে, কিন্তু লোকটা অন্য কেউ তা শিবলি বুঝতে পারল। রিকশা লোকটার কাছাকাছি যেতেই রন্তু বুঝতে পারল সে ভুল দেখেছে, দূর থেকে দেখতে বাবার মত মনে হলেও লোকটি বাবা নয়।
ছোট মামার সাথে বাসায় এল যখন, ভেবেছিল সবাই জিজ্ঞাসা করবে রন্তু স্কুল থেকে ফিরতে এত দেরী করল কেন? শিবলির সাথেই বা একসাথে ফিরল কিভাবে? কিন্তু, কেউই যেন ব্যাপারটা লক্ষ্যই করল না। রন্তু ঘরে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টে রান্না ঘরে উঁকি দিতেই নানু খাবার জন্য ডাক দিল।
‘কিরে? আজ এতো দেরী? রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাঘুরি বুঝি বেড়েছে খুব?’
রন্তু কোন উত্তর দিল না, মাথা নিচু করে খেতে লাগল।
‘এই ছেলে কথা বলিস না কেন?’
‘উম...’ মুখে খাবার নিয়ে একটা শব্দ করল রন্তু।
‘তোদের মা ছেলের জ্বালায় আমি শেষ হয়ে গেলাম। হতচ্ছারা বদমাশ, তোর ঐ পাগল বাপ, তোদেরকে আমার এখানে ফেলে রেখে গেছে আমার হাড়-মাংস ভুনা ভুনা করতে।’
অন্য সময় হলে রন্তু হয়ত বলত, ‘আমাকে একটু দাও, ভাতের সাথে খেয়ে দেখি টেস্ট কেমন?’
নানু বলত, ‘কি?’... রন্তু ফিক করে হেসে দিয়ে বলত, ‘হাড় মাংস ভুনা’
কিন্তু সময়টাই ছিল অন্যরকম, রন্তু মুখ গোমড়া করে চুপচাপ খেতে লাগল। নানু স্বভাবসুলভ গজগজ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেল রান্নাঘর হতে। রন্তুর মা শায়লা ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে এই বিকেল বেলা শুয়ে আছে। কিছুদিন হল সে অফিসের চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে, সারাদিন বাসায় থাকে, প্রায় দিনই বিকেল বেলা বের হয় বাসা থেকে, সন্ধ্যার পরপর ফিরে। এটা নিয়ে প্রতিরাতে শায়লা আর তার মা’র মাঝে ঝগড়া হয়ে যায়, উচ্চস্বরে নয়, অতি চাপা স্বরে। ছোট্ট রন্তু এসবের মাঝে থেকেও কোন দূর অজানায় যেন হারিয়ে যায়। ধীরে, অতি ধীরে, আঁধারেরা যেমন করে গ্রাস করে রাতের নিস্তব্ধতাকে; তেমনি করে রন্তুর কালো আকাশে আরও কালো মেঘে ছেয়ে যেতে থাকে প্রতিদিন, একটু একটু করে।
'রন্তু'র কালো আকাশ' এর আগের সব পোস্টগুলোঃ
রন্তু'র কালো আকাশ - ১
রন্তু'র কালো আকাশ - ২
রন্তু'র কালো আকাশ - ৩
রন্তু'র কালো আকাশ - ৪
রন্তুর কালো আকাশ - (১-৫)
রন্তু'র কালো আকাশ - ৬
রন্তু'র কালো আকাশ - ৭
রন্তু'র কালো আকাশ - ৮
রন্তু'র কালো আকাশ - ৯
রন্তু'র কালো আকাশ - ১০
রন্তু'র কালো আকাশ - ১১
রন্তু'র কালো আকাশ - ১২
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৩
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৪
রন্তু'র কালো আকাশ (পর্ব ১-১৪ ফিরে দেখা)
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৫
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৬
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৭
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৮
রন্তু'র কালো আকাশ - ১৯
রন্তু'র কালো আকাশ - ২০
রন্তু'র কালো আকাশ - ২১
রন্তু'র কালো আকাশ - ২২
রন্তু'র কালো আকাশ - ২৩
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৪৯