প্রিয় কুটুমিয়া,
আজ চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস, আজ দুপুরে তোমার নিমন্ত্রণ ছিল আমাদের সাদা বাড়িতে, এসে ফিরে গেছ তাইনা? কিন্তু মজার ব্যাপার আমরা কেউ বাসায় নেই, এসেছি অচিনপুর, যেন এক যশোহা বৃক্ষের দেশে। তুমি আবার ভেবোনা সবাই গেছে বনে, এটা একটা ছোট ইষ্টিশন, গৌরীপুর জংশন এর কাছে। এখানে আকাশ জোড়া মেঘ, এই মেঘ রৌদ্র ছায়া। যেদিন এখানে এসে পৌঁছলাম দিনের শেষে, অপরাহ্ণ; চারিদকে যেন অন্ধকারের গান। অনন্ত নক্ষত্র বীথি আমাদের পথে আলো দেখিয়ে যাচ্ছে। অপার্থিব এক অনুভূতি, আমি গুণগুণ করে গাইছিলাম বাউলা কে বানাইলো রে। তোমাদের এই নগরে মনটা কেমন যেন বসন্ত বিলাপ করছিল, তাইতো গৃহত্যাগী জোছনার আলোয় নিজেকে ভাসাতে আমাদের এই প্রস্থান।
শুভ্র আর মৃণ্ময়ীকেও সাথে এনেছি, যদিও মৃণ্ময়ীর মন খারাপ। কারণ, আজ চিত্রার বিয়ে, চিত্রা হল মৃণ্ময়ীর বান্ধবী, বড়ই একজন মায়াবতী মেয়ে। তার উপর ভুল করে তিথির নীল তোয়ালে নিয়ে এসেছে নিজেরটা ভুলে। এখানে আমাদের ছায়াসঙ্গী হয়ে সাথে আছেন অন্তরার বাবা। উনার ছেলেটা, নাম হিমু, একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক নিয়ে খেলায় ব্যস্ত থাকে। কাল রাতে দেখি হিমু এবং কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকা এখানকার ঘেঁটুপুত্র কমলা’র সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারাক্ষণ বুঝি ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে ছেলেটা। আজ সকালে দেখি হিমুর হাতে কয়কেটি নীলপদ্ম, সাথে ছিল তার ছোট বোন ইরিনা, মেয়েটা যেন পেন্সিলে আঁকা পরী, ওর হাতে পুতুল। দুজনেই পড়ে জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলে। ওদের দেখে মনে পড়ে যায় আমার ছোট বেলা।
গত পরশু আমাদের কেয়ারটেকার আঙ্গুল কাটা জগলু সাথে নিয়ে এল কালো জাদুকর, ম্যাজিক মুন্সি। তোমার ভাবী, নবনী, এই লোককে দেখেই রেগে গেল। জাদু আর দেখা হল না। নীল হাতী চেপে নীল মানুষ নাকি উড়ে যাবে তার মেঘের উপর বাড়িতে, অদ্ভুত জাদু না? গতকাল আসলেন নলিনী বাবু বি.এস.সি. উনি নাকি পোষেন মজার ভূত, শখ করে ডাকেন বোতল ভূত। আমি মজা পাচ্ছি, কিন্তু নবনী এসবে খুব বিরক্ত হচ্ছে, “একি কাণ্ড! এ যে সাক্ষাত বিপদ” বলে ঝেটিয়ে এদের বিদায় করেছে। গম্ভীর স্বরে বলল, “রাবনের দেশে আমি এবং আমরা বেড়াতে চলে এলাম নাকি? কিছুক্ষণ পর হয়ত দেখতে হবে রাক্ষস খোক্ষস এবং ভোক্ষস। আসলে এরকম জায়গায় না বেড়াতে এসে দারুচিনি দ্বীপ গেলেই পারতাম, অথবা রূপালী দ্বীপ”। বলে হাসতে লাগলো, জবাবে আমি কি বলব, মনে মনে বললাম তোমাদের জন্য ভালবাসা আছে বলেই তো একান্ত সময় কাটাতে এই নির্জন নিবাস।
আজ মধ্যাহ্নভোজের পর শুভ্র গেছে বনে , সাথে গেছেন মিসির আলী আর তার পোষা বেড়াল পুফি। এখানে আসার পর থেকে সে মেতে আছে মিসির আলী সাহেবকে নিয়ে, ওর পাল্লায় পড়ে একেবারে বাঘবন্দী মিসির আলী। দুদিন আগে তারা তিনজন একদিন তেতুল বলে জোছনা দেখতে গেল। কি অদ্ভুত প্ল্যান, আসলে মিসির আলী সাহেব একজন শখের ছবি নির্মাতা। এই অজপাড়া গাঁয়ের কেউ এমন ভাবনা নিয়ে বসে আছে চিন্তা করতে পার। উনি যে ছবি বানাতে চান, তার নাম দিয়েছেন “জোছনা ও জননীর গল্প”, এই গল্পের জন্যই নাকি সেই জোছনা দেখতে যাওয়া। অন্যদিন উনার ছবি বানানোর গল্প শোনাবো তোমাকে। উনি আবার একজন ভাব কবি, পায়ের তলায় খড়ম গলিয়ে কাঁচা মাটির উঠোনে প্রিয় পদরেখা এঁকে দেন, লিখে যান হাজারো কবিতা।
চক্ষে আমার তৃষ্ণা, আর তা মেটাতেই বুঝি একদিন দেখি আকাশ জুড়ে বৃষ্টি ও মেঘমালা। আমার তৃষ্ণা মিটিয়েছিলাম সেই বৃষ্টিতে বর্ষা বিলাস করে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম দীঘির ধারে, কাককালো জলে নিজের ছায়া দেখে নিজেকেই জিজ্ঞাসিলাম, “দীঘির জলে কার ছায়া গো?”। আসলে অদ্ভুত এই জীবন, চলে যায় বসন্তের দিন; জল জোছনা আসে চলে যায়, ঝরে যায় কত না অশ্রু জল।
বুঝলে মন চাইছে অনেক কিছু লিখে রাখি, কিন্তু আমার ফাউনটেন পেন আনা হয়নি, লিখছি কাঠপেন্সিল দিয়ে, তুমি কিছু মনে কর না যেন। এই আমি, একা একা বসে ভাবি দিনের শেষে কেউ কোথাও নেই, একেবারে জনমানব শুন্য। আমার ভেতর কে কথা কয়? সে আসে ধীরে, নিয়ে যেতে চায় যেন নন্দিত নরকে। কিন্তু এখনো যে ছুঁয়ে দেখা হয় নাই বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল, উড়ালপঙ্খী চড়ে ঘুরে দেখা হয় নাই উঠান পেড়িয়ে দুই পা ফুটে থাকা নীল অপরাজিতা অথবা দূরের নিউইয়র্কের নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ। বাইরে নক্ষত্রের রাত, আমায় ডেকে যায় নিশীথিনী তার আয়নাঘরে, অপেক্ষা আমায় শোনাবে তার প্রেমের গল্প। চলে যাব অন্যভুবন, যখন নামবে আঁধার, গায়ে মেখে লিলুয়া বাতাস। এখন যদিও সন্ধ্যা, কিন্তু মনে হয়ে জনম জনম বসে আছি কৃষ্ণপক্ষ রাতে এই অনন্ত নক্ষত্রবীথি পাণে চেয়ে। দিনের শেষে চেয়ে দেখি কোথাও কেউ নেই, তবুও আমার মাঝে এ কে কথা কয়? যেন আমায় নিয়ে যেতে চায় অচিনপুর, শোনাতে চায় অন্ধকারের গান। যেথা হতে আর হবে না ফেরা, পড়ে থাকবে আমার ইপিটাফ, যদিও আমি কোন বাদশাহ নামদার নই। আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই এখনো, চলে যাব যখন নামবে আঁধার, কোন এক অন্যভুবন।
থাক এসব মন খারাপের উদাসী কথা। আসছে মাসে তুমি এসো আমার বাড়িতে, সেদিন কেউ ডাকলেও বলে দেব আজ আমি কোথাও যাব না। তুমি কিন্তু আবার খোটা দিও না দেখা হলে এই বলে, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে। সেদিন তোমাকে শোনাবো আরও অদ্ভুত সব গল্প, সাথে আমার প্রিয় ভৌতিক গল্প, তুমি আবার ভয় পেয়ো না যেন। চাইলে শোনাবো শীত ও অন্যান্য গল্প।
ইতি
সৌরভ
=============================================================================
হুমায়ুন আহমেদ এর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী স্বরূপ রচিত
=============================================================================