"রন্তু'র কালো আকাশ" সব পর্ব
হুট করে কোন কিছু বদলে গেলে কেমন যেন একটা অজানা অস্বস্তি লাগে সবারই। নিত্যদিনকার কর্মকাণ্ডের পূর্ব নির্ধারিত নির্দেশ যেন অবচেতনেই সবার মনে গেঁথে যায়। আর তাই এই নির্ধারিত কর্মযজ্ঞে ব্যাতয় ঘটলে মানুষ মাত্রই কেমন অস্বস্তি অনুভব করে। হুট করে মানিয়ে নিতে গিয়ে অনুভূত অদ্ভুত অচেনা এক অসামঞ্জস্য চোখে পড়ে। রন্তুর ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে গতকাল। ফলে আজ সকালেও যখন প্রতিদিনকার মত ভোরবেলাই ঘুম ভেঙ্গে গেল, তখন রন্তু বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো কি করা যায়। প্রথমে প্রতিদিনের রুটিনমত স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার উদ্দেশ্যে বিছানা হতে নেমেছিল; কিন্তু বাথরুম অভিমুখে যাওয়ার সময় মনে পড়ে গেল আজ স্কুল যাওয়ার তাড়া নেই। আজ শুক্রবারও নয়, তার উপর ফাইনাল এক্সাম শেষ হল গতকাল, তাই আজ কোন পড়ার চাপও নেই। তাই বিছানায় বসে বসে রন্তু কেমন যেন অথৈ সাগরে পড়ে গেল এই ভেবে ভেবে যে কি করা যায় এতো সকালে।
(পূর্ব ঘটনা প্রবাহঃ রন্তু, শায়লা আর জাভেদের একমাত্র সন্তান। জাভেদের সাথে শায়লার প্রনয় থেকে পরিণয়, পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পর শায়লা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে জাভেদ ভয়ঙ্কর রকমের মানসিকভাবে অসুস্থ। এক সময় মানিয়ে নিতে না পেরে ছোট্ট শিশু রন্তুকে নিয়ে মায়ের বাসায় চলে আসে। তাদের মিউচুয়ালি ডিভোর্স হয়ে গেছে। মা-বাবার এই টানাপোড়নে শিশু রন্তুর মানসিক জগতের গল্প, সাথে তার নিত্যদিনকার প্যাচালি, এই হল এই গল্পের উপজীব্য। গত এক বছর হল জাভেদ, রন্তুর বাবা রন্তুকে স্কুলের গেটে মাসে এক-দুইবার দেখা করতে আসে। এখন রন্তু’র ক্লাস টু এর ফাইনাল এক্সাম শেষ হল মাত্র। গত পর্বে জাভেদ ছেলেকে দেখতে এসেছিল, তার কথাবার্তা আর আচরণে মনে হয়েছে সে শেষবারের মত ছেলেকে দেখতে এসেছে। মানসিক সমস্যাগ্রস্থ জাভেদ পরিবার, আত্মীয় পরিজন হতে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে একাকী জীবন পথে হেঁটে চলেছে। অপর দিকে রন্তুর মা শায়লা এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরী করছে, যেখানে তার এক সিনিয়র পোস্টের সহকর্মী’র সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে প্রণয়ের দিকে, যার ইঙ্গিত গত পর্বে পাঠকরা পেয়েছেন। আর পিতামাতা’র সম্পর্কের এই টানাপোড়নে পড়ে কেমন চলছে আমাদের রন্তুর জগত তা জানার জন্য আসুন এবার আবার শুরু করা যাক)
বিছানা হতে নেমে রন্তু গুটি গুটি পায়ে বাইরে বের হয়ে এল, সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদের চিলেকোঠায় ছোট মামার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। রন্তুর ছোট মামা শিবলি দরজা খুলে রেখে ঘুমায়। এই নিয়ে নানুর সাথে কতবার যে মামার ঝগড়া হয়েছে। ছোট মামা কিছুতেই দরজা বন্ধ করে ঘুমুতে পারে না; তার নাকি মনে হয় দরজা বন্ধ করে ঘুমালে সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়বে আর কোনমতেই ঘর হতে বেড়িয়ে কাউকে ডাকতে পারবে না। শেষে তার লাশ নাকি দরজা ভেঙ্গে বের করতে হবে। অন্যদিকে নানুর কথা কোনদিন চোর-ডাকাত এসে সব লুটে নিয়ে যাবে, সাথে যাওয়ার সময় ছোট মামাকে খুন করে রেখে যাবে। যে মৃত্যুর ভয়ে দরজা খোলা রাখা, সেই মৃত্যু নাকি খোলা দরজা দিয়েই ঢুকবে মামার ঘরে। রন্তু বড়দের বেশীরভাগ কথাবার্তা বুঝতে পারে না। তাদের কথাবার্তার বেশীরভাগেরই কোন মানে নেই, রন্তুর ধারনা বড়দের বুদ্ধি একটু কমই হয়। কিন্তু তার স্কুলের টিচারদের তো বুদ্ধিমানই মনে হয়। রন্তু সবশেষে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তা হল তার বাসার সবার বুদ্ধি কম, এমন কি বাবারও।
সেদিনের পর থেকে রন্তুর বারবার বাবার কথা মনে পড়ে, হঠাৎ করেই কেন যেন বাবার প্রতি মায়া জন্মেছে ছোট্ট মনের মণিকোঠায়। কিন্তু সেদিনের পর বাবার এখনও দেখা পায় নাই। অবশ্য এখনও মাসখানেক সময় পার হয় নাই। বাবাতো মাসে একবার দেখা করতে আসে। ইদানীং রন্তু তার আঁকার খাতায় বাবার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। বাবার চেহারা মনে করতে গেলেই কেমন গুলিয়ে যায় সব কিছু। কখনো বাবার চোখের জায়গায় মা’র চোখ চলে আসে। কখনো নানুর হাসি, কখনো ছোট মামার মুখের অবয়ব। রন্তুর ছোট্ট মাথায় ধরে না কেন এই বিভ্রম ঘটছে। আসলে যতটা কাছে থাকলে একটা মানুষের মুখচ্ছবি আমাদের হৃদয়পটে বসে যায়, ততটা সময় বাবার সাথে কাটানোর সৌভাগ্য রন্তুর হয় নাই। সেই চার বছর বয়সে বাবা-মা ঝগড়া করে আলাদা হয়ে গেলে পরে বিগত বছর দুয়েকের বেশী সময় ধরে রন্তু তার মা শায়লার সাথে আছে নানু বাড়িতে।
ছোট মামাটা কেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে, দেখে মনে হয় একটা কাপড়ের পুঁটলি। রন্তুর নানু ছোট মামাকে এভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলেই বলবে কাপড়ের পোঁটলা। রন্তুর তখন খুব মজা লাগে, সে মাঝে মাঝে মামাকে পোঁটলা মামা বলে ডাকে। মামার মুড ভালো থাকলে মামা কিছু বলে না, কিন্তু মুড খারাপ থাকলে রন্তু’কে ধরে কান মলা দিয়ে দেয়। রন্তু মামাকে ঘুম থেকে না তুলে ছাঁদে হাঁটতে লাগলো ধীর পায়ে। কুয়াশা পড়ে ছাঁদটা কেমন ভেজা ভেজা হয়ে আছে। হালকা বাতাস বইছে, তাই রন্তুর শীত শীত লাগছে। এখন মোটামুটি শীতকাল বলা যায়, মা রন্তুর গরম কাপড় বের করে দিয়েছেন। কিন্তু রন্তু মনে করে পড়ার কথা ভুলে যায়, আজ যেমন ছাঁদে আসার আগে মনে ছিল না। এখন আবার নীচে নামতে মনে চাচ্ছে না, কিন্তু শীতও ভালোই গায়ে লাগছে। রন্তুর শীতকাল মোটেও ভালো লাগে না, কারণ, শীত এলেই তার চামড়া শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। নানু বলে ‘ফাটা বাঙ্গী’, এই বলে তাকে খুব ক্ষ্যাপায়। আর শীত এলেই রন্তুকে রুটিন করে গ্লিসারিন, তেল, লোশন মেখে বাবু সেজে শীত কাপড় গায়ে চাপিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। এতো আয়োজনের সময়টুকু রন্তুর খুবই যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়। অবশ্য একবার সব শেষ করে ফিটফাট বাবু সেজে গেলে পরে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে। এখন খুব মিস করছে সেই ফিটফাট রূপ, ঠাণ্ডায় হাত-পা, নাক-কান যেন জমে যাবে। রন্তু ফের ছোট মামার ঘরে চলে আসলো, আস্তে করে মামার পাশে শুয়ে পড়ে মামার লেপের তলায় নিজেকে ঢেকে দিল।
‘কিরে, এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এখানে কেন?’ মামার কথায় রন্তু কিছুটা চমকে গেল, একটু কি ভয়ও পেল? সে ভেবেছিল মামা গভীর ঘুমে।
‘ঘুম ভেঙ্গে গেল যে...’
‘ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার জোড়া লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হয় এটা জানিস না?’
‘যাহঃ তা আবার হয় নাকি? কিসব যে তুমি বল না মামা...’
‘শোন রন্তু আমাকে ঘুমাতে দে, ঝামেলা করলে মাথায় একটা গাট্টা মারবো মনে থাকে যেন।’
‘ওমা! আমি কি তোমায় কিছু বলেছি নাকি? আমিতো ঠাণ্ডা লাগছিল বলে তোমার লেপের তলায় ঢুঁকে পড়লাম’
‘ঠিক আছে মুখ বন্ধ, যতক্ষণ ইচ্ছা বসে থাক, শুয়ে থাক... কিন্তু নো কথা... ওকে?’
‘ওকে...’ রন্তু বসে বসে ছোট মামার ঘরখানি দেখতে লাগলো। রাজ্যের জিনিসে মামার রুমখানি ঠাসা। এত্ত এত্ত বইপত্তর, তার সাথে নানান যন্ত্র, খেলার সরঞ্জাম, ম্যাগাজিন... আরও কত কি! কিন্তু রন্তুর কাছে ঘরটা খুব ভালো লাগে, মনে হয় তার যদি এমন একটা ঘর থাকতো! মামার দেয়ালে দুলতে থাকা ক্যালেন্ডারের পাতায় লাল রঙে ষোল তারিখ দেখে রন্তুর মনে পড়ল কাল বাদে পরশু দিনই ষোলই ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস! সাথে সাথে ছোট মামাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঠেলতে লাগলো।
‘রন্তু! মারবো কিন্তু একটা গাট্টা... ঠেলছিস কেন?’
‘মামা... ষোল তারিখ...’
‘কিসের ষোল তারিখ?’
‘বিজয় দিবস...’
‘হুমম বিজয় দিবস, তো ধাক্কাচ্ছিস কেন?’
‘পতাকা লাগাবে না মামা?’
‘হুমম...’
‘কবে?’
‘উফ রন্তু ঘুমাতে দে... পতাকা আগামীকাল লাগাবো। আর একটা কথা বললে কিন্তু কান ধরে নীচে দিয়ে আসবো, আর আগামী এক সপ্তাহ উপরে আসার ভিসা ক্যান্সেল হয়ে যাবে’
মামার এই কথা শুনে রন্তু ভয় পেল, সে মামার ‘ভিসা ক্যান্সেল’ শাস্তি খুব ভয় পায়। আর তাই চুপ করে কিছু সময় বসে থেকে ধীর পায়ে প্রায় নিঃশব্দে খাট থেকে নীচে নেমে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ঘরে হতে বের হবে এমন সময় মামা লেপের তলা থেকে মাথা বের করে রন্তুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বিকেল বেলা রেডি থাকিস, চকবাজার যাবো পতাকা কিনতে’। বলেই কচ্ছপের মত আবার মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। রন্তু খুশী মনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আগত দুতিন দিনের সম্ভাব্য আনন্দমুখর সময়ের কথা ভেবে ভেবে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। কি কি করবে ভেবেই হয়রান হতে হতে হঠাৎ মনে হল, ইস... এসময় যদি বাবাও তাদের সাথে পতাকা সাজাতে চলে আসতো, তবে কতই না মজা হত। বাবার সাথে কখনো পতাকা সাজানো হল না রন্তুর। এরকম আরও কতশত না পাওয়ার অনুভূতি গড়ে উঠবে রন্তুর জীবনে বাবাকে ঘিরে? আগত সময়ই তা বলে দিবে। রন্তুদের জীবনে না পাওয়ার হিসেব করেই পাওয়ার হিসেব মিলাতে হয় যে।
=============================================
'রন্তু'র কালো আকাশ' প্রথমে একটি এক পর্বের ছোট গল্প আকারে লিখেছিলাম। কিন্তু 'রন্তু' আমার খুব প্রিয় একটি চরিত্র বিধায় আমি সিদ্ধান্ত নিই ২৫ পর্বের একটি ধারাবাহিক আকারে উপন্যাস লিখবো (যদিও জানি সে যোগ্যতা আমার নেই, তারপরও অপচেষ্টা আরকি)। সেই থেকে এই লেখা। তবে প্রতিটি পর্ব আমি এমনভাবে লেখার চেষ্টা করছি যেন একেকটা পর্বই একটা ছোট গল্প হিসেবে পাঠক পড়তে পারে। গত জুলাই মাসে শেষ পর্ব-৪ লিখেছিলাম। এরপর অনেক লম্বা বিরতি পড়ে গেল। এরপর পর্ব-৫ সহ একসাথে পাঁচ পর্ব দিয়ে পোস্ট করলাম গত সেপ্টেম্বর মাসে; তারপর আরও দুটি পর্ব ৬ এবং৭ লিখে আবার লম্বা বিরতি পড়ল। আসলে আমি নিজেই শিওর না কোন ধারাবাহিক গল্প লেখার যোগ্যতা আমার আছে কি না তা নিয়ে। আসলে আমি কোন গল্পকার নই, তারপরও নিজেকে গল্পকার হিসেবে ভাবতে ভালো লাগে। আর তাই মাঝে মাঝে গল্প লেখার এমন অপপ্রয়াস ঘটাই। এখন থেকে প্রতি সপ্তাহান্তে বিরতি দিয়ে এই ধারাবাহিক উপন্যাস হিসেবে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো। একজন পাঠক হিসেবে আপনাদের পাশে পাবো এই আশা রাখি। রন্তু আমার খুব প্রিয় একটা চরিত্র, আর তাই আমি এই উপন্যাস শেষ করবোই, আর তা সম্ভবত ২৫ পর্বে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
(রন্তু সিরিজ পুনরায় শুরু করতে পারার জন্য প্রিয় ব্লগার বন্ধু ডি মুন এর কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা থাকবে। নিয়মিত তাগিদ দিয়ে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। গতকাল করা উনার কমেন্টের প্রেক্ষিতেই গতকাল ছুটির দিনে বসে বসে রন্তু সিরিজের এই নতুন পর্ব লিখে ফেললাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় ডি মুন, তাগিদ দিয়ে রন্তু সিরিজ পুনরায় লিখতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। সবসময় সাথে থেকে মায়ার বাঁধনে জড়ানোয় ভালবাসার ঋণে জর্জরিত হলাম

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:২০