“প্রত্যাশার পারদ” আসলেই খুব বাজে জিনিষ, একবার মনে একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট হয়ে গেলে তা থেকে নেমে আসা দুস্কর হয়ে দাঁড়ায়। গেল রোজার ঈদে এনটিভি’তে প্রচারিত “ছিন্ন” টেলিফিল্মটি দেখে আমি এতোই মুগ্ধ হই যে, সেই টেলিফিল্ম নিয়ে একটি রিভিউ পোস্ট লিখেছিলাম। নিজের ব্যাক্তিগত কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে আমার উড়নচণ্ডী মনকে ঘরে বেঁধে রেখেছিলাম, আর তাই ঈদের লম্বা ছুটির অবসর সময়গুলো কাটাই রঙ্গিন বাক্সের সম্মুখে বসে বসে, রিমোটের বাটন চেপে চেপে। চ্যানেল ঘুরে ঘুরে এই নাটক, সেই নাটক দেখি; কিন্তু মন ভরে না যে। “ছিন্ন”র মানের কোন নাটক খুজে পাইনা যে... হঠাৎ করেই ঈদের দ্বিতীয় দিন চোখে পড়ে বাংলাভিশন চ্যানেলে “রাতারগুল” নামের টেলিফিল্ম প্রচারিত হবে পরের দিন। নামের কারনেই পরের দিন বসে গেলাম টিভি’র সামনে টেলিফিল্ম “রাতারগুল” দেখতে।
শুরুতেই দেখা যায় শফি মণ্ডল (মামুনুর রশিদ) তার অল্প বয়স্কা সদ্য বিবাহিত স্ত্রী, করিমপুর গ্রামবাসী দরিদ্র কাশেম মিয়ার মেয়ে লাইলী(তিশা),’কে নিয়ে গ্রামের পথে যাচ্ছে, যাত্রাপথ রাতারগুলের জলামগ্ন সোয়াম্প ফরেস্ট। নাটকের পুরো শুটিংটাই রাতারগুল এবং সিলেটের বনাঞ্চলে হয়েছে। তিশা টাঙ্গাইলের মেয়ে, বিয়ের পর বয়স্ক বরের সাথে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। এই যাত্রায় তারা রওনা হয় মাঝি নাসির (রওনক হাসান) এর নৌকায় করে। নৌকা চলতে শুরু করলে বিভিন্ন জনের সাথে তাদের দেখা হয় এবং ক্রমে তিশা বুঝতে পারে সে নারী পাচারকারী মামুনুর রশিদের খপ্পরে পড়েছে। মামুনুর রশিদ এলাকার কুখ্যাত নারী পাচারকারী যে কিনা একশত’র উপর এমন ভুয়া বিয়ে করে স্ত্রীদের বর্ডারের ওপারে পাচার করে দিয়েছে। এমন তথ্য জেনে একই নৌকায় থাকা তিশা মুক্তির উপায় খুঁজে পেতে সামনে পায় মাঝি রওনক হাসান’কে। এরপর তরতর করে কাহিনী এগিয়ে যায়। পরতে পরতে রোমাঞ্চ আর সাসপেন্স নিয়ে কাহিনী এগুতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে দর্শক যখন কিছু একটা অগ্রিম ধারনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যায়, তখনই কাহিনী অন্যদিকে মোড় নেয়। আর এভাবেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে শেষ হয় অসাধারণ এই টেলিফিল্মটির। কিন্তু কি হয় পরিণতি তিশা’র? সে কি উদ্ধার পায় আসন্ন বিপদ থেকে? নাকি পায় না? আর যদি পায়ও তাহলে কিসের বিনিময়ে? কি সেই চরম মুল্য? নিজের সম্ভ্রম? নাকি অমুল্য প্রাণখানি? আর যেটাই খোয়াক কার হাতে? কিভাবে? এমন সব প্রশ্ন নিয়ে দেখতে বসে পড়তে পারেন টেলিফিল্ম “রাতারগুল”।
ঈদের ৩য় দিন দুপুর ২টা ১০ মিনিটে বাংলাভিশনে প্রচারিত হয় সুমন আনোয়ার এর রচনা এবং পরিচালনায় টেলিফিল্ম “রাতারগুল”। নাটকের গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ, লোকেশন আর নির্মাণ খুবই উচ্চমানের। ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড একটু দুর্বল ছিল। নাটকে একটা অংশে তিশা রওনক হাসানের সহায়তায় মামুনুর রশিদের কাছে থেকে পালিয়ে বনের ভেতর দিয়ে ছুটতে থাকে। সেই দৃশ্য’র একটা অংশ দেখে আপনার মনে হবে এমাজনে চিত্রায়িত কোন এনাকোন্ডা বা জুরাসিক পার্ক জাতীয় হলিউড মুভি’র ক্লিপ। একটি লোকেশনকে ফোকাস করে অতি মানবিক এবং সিরিয়াস ইস্যু নিয়ে চমৎকার এমন নির্মাণ খুব কমই দেখা যায়। তথাকথিত অনেক সিনেমার থেকে বহু গুণ এগিয়ে থাকবে সুমন আনোয়ারের এই টেলিফিল্মটি। অভিনয়ে মামুনুর রশিদ, তিশা, রওনক হাসান খুবই ভালো করেছেন যথারীতি। তবে গল্পের প্রয়োজনে কিছু সাহসী দৃশ্যের দরকার ছিল, যা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, হাজার হলেও ঈদের টেলিফিল্ম। টেলিফিল্মের শেষাংশ ভালো লেগেছে হঠাৎ অন্যরকম এক সমাপ্তির কারণে।
‘গত তিন দিন ধরে আমরা বৃষ্টির সাথে যুদ্ধ করছি…। আজকে ক্যামেরা ওপেন করতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হয়…। কোনো রকম একটা শট নিয়ে এখন আমরা সবাই দশটা নৌকার মধ্যে বসে আছি…। আমাদের এই যুদ্ধ দর্শক কোনো দিন বুঝবে না…।’ নির্মাতা সুমন আনোয়ার গত ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দেন। ফেসবুকে দেওয়া কিছু ছবিই বলে দিচ্ছে, যুদ্ধই বটে! তবে সে যুদ্ধ বৃষ্টির সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে। দর্শকেরা বুঝুন না বুঝুন, রাতারগুল টেলিছবির ইউনিট ঠিকই বুঝছে বৃষ্টি কাকে বলে! শুটিং বন্ধ করে বসে থাকা ছাড়া যেন কিছুই করার নেই তাদের। রাতারগুল নামের এই টেলিছবিটির শুটিং করতে সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের জলাবন রাতারগুলে গিয়েছিলেন নির্মাতা সুমন আনোয়ার। সেখানে যাওয়ার পর থেকেই বৃষ্টির কবলে পড়ে শুটিং ইউনিট। গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে পুরোদমে শুটিং শুরু করার কথা থাকলেও সেদিন মাত্র কয়েকটি শট নিতে পেরেছেন তিনি। পরদিনও একই অবস্থা। বৃষ্টি থামার ফাঁকে ফাঁকে চলেছে শুটিং।
শেষ কথা বলি, আমি একজন দেশীয় ভ্রমণ পাগল মানুষ। তাই বাংলাদেশের ভালো ভালো চমৎকার লোকেশনে চিত্রায়িত যে কোন নির্মাণ দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু তার সাথে যদি যোগ হয় এমন শক্তিশালী কাহিনী এবং চিত্রনাট্য, আর চমৎকার নির্মাণ তবে তো সোনায় সোহাগা। যদি না দেখে থাকেন এই টেলিফিল্মটি তবে এই লিঙ্ক থেকে দেখে নিতে পারেন এই টেলিফিল্মটি। অনেক সিনেমা’র চেয়ে দৈর্ঘ্যে বড় এই টেলিফিল্ম কিন্তু আরও অনেক ক্ষেত্রেই টেক্কা দিবে সিনেমা’কে...