বিকেলের এই স্বর্ণরঙা আলোর মায়াবী যাদুর খেলা মিথিলাকে সেই কিশোরীবেলা থেকেই মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। আজ এতো বছর পরেও সেই মুগ্ধতায় এতটুকু ভাটা পড়েনি, বরং মনে হয় দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে কতশত ছেলেমানুষি পাগলামো যে তার মাথায় ভর করে তা শুধু মিথিলাই জানে। কিন্তু সেই ভাবনাগুলো মনের মাঝে কড়া ধমক দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, ঠিক তেমনি করে, যেমন করে মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে কান্না জুড়ে দিলে ধমক দিয়ে সে ঘুম পাড়ায় তার বছর দেড়ের ছোট্ট ছেলেটিকে। কিন্তু বেয়ারা এই পাজির দল ভাবনাগুলো ঠিক তার ছেলেটার মতই জেদী আর একরোখা, যতই বকা দেয়া হোক না কেন, তার চাঞ্চল্যে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ে না। অবশ্য মিথিলা নিজেও কম যায় না, বছর দেড়েকের ছেলের মা হয়েও সেই কিশোরী চপলতা এখনও তার সারা অঙ্গে খেলে যায়। যদিও তা একান্ত গোপনেই থাকে মিথিলার মন-মন্দিরে, কখনো প্রকাশ পায় না পূর্ণরূপে, হয়ত ক্বচিৎ উঁকি দেয়ার সাহস জোটে দুষ্ট বেয়ারা ইচ্ছাগুলোর।
মিথিলার অফিস তেজগাঁও এর নাখালপাড়া আর বাসা হাতিরপুল, এই পথটুকু যাতায়াত করা এক মহা হ্যাপা। না বাসে যাওয়া যায়, না ট্যাক্সি বা সিএনজি অটোরিকশায়। কারণ, বাসে উঠা সেই ছোটবেলা থেকেই খুব পছন্দের নয় মিথিলার, তার উপর এখনকার ঢাকা শহরের বাসগুলোতে এতো মানুষের ভিড়ে বাসে উঠতে মন চায় না, চায় না বললেও কিছুটা ভুল, মন সায়ও দেয় না। আর এই স্বল্প দূরত্বে ট্যাক্সি বা সিএনজি অটোরিকশা চালকেরা সহজে যেতে রাজী হয় না, আর হলেও যে আকাশচুম্বী ভাড়া হাঁকে তাতে মিথিলার মত মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্মজীবী মেয়ের গায়ে লাগে। আর তাই শেষ ভরসা রিকশা, যদিও তাতে ঝামেলা কম নয়, দুবার রিকশা বদলের সাথে রয়েছে কারওয়ান বাজার থেকে সোনারগাঁ হোটেল এর সামনের সিগন্যাল পার হয়ে সেই বাংলামটরের সংযোগ সড়ক অবধি হেঁটে পার হওয়া। কিছু করার নাই, প্রাইভেট কার পোষা পোষায় না তার, তাই এইটুকু কষ্ট মাথা পেতে মেনে নেয়া। বাবু হওয়ার আগে প্রেগন্যান্সি’র সময়টায় কয়েকমাস একটা পুরনো মডেলের প্রাইভেট কার রিজার্ভ করেছিল, শুধু অফিসে যাওয়া-আসা করার জন্য, তাতেই তার বেতনের অর্ধেকের বেশী বের হয়ে যেত। তাই সে কথা আর ভাবনাতে আনে না।
প্রায় দিনই এই শেষ বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময়টুকু মিথিলা একান্ত নিজের করে পায়। এইসময়ের পুরোটাই তার নিজের। আর নইলে সেই সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাবুটা’র সব গুছিয়ে দিয়ে কাজের মেয়েকে সকল নির্দেশ পুনরায় মনে করিয়ে (যা রোজই সে করে) ছুটে অফিসের পানে। যদিও বাসায় শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন, তবুও মনটা পরে থাকে বাসায়, বাবুটার জন্য। মাঝে মাঝে মনে হয় চাকুরীটা ছেড়ে দেয়, সারাটা দিন তার সোনামণিটাকে বুকে জড়িয়ে কাটিয়ে দেয়। কিন্তু, শুধু আর্থিক কিছু ব্যাপারই নয়, আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণ মিলে বিশাল এক যুক্তি হয়ে ধরা দেয় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আর তাই এই ভাবনা হারিয়ে যায় বাস্তবতার প্রবল ঢেউয়ের মাঝে।
অফিস ফেরতা এই সময়ে মিথিলা রিকশায় বসে ফোনে খোঁজ-খবর করে আত্মিয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের। প্রায় দিনই অবশ্য মা আর বড় আপুকে ফোন দেয় সাথে রয়েছে বাসায় ফোন দিয়ে বাবুটার খোঁজ-খবর নেয়া (প্রতি ঘণ্টায় দু’তিন বার এটা করে সে)। এর ফাঁকে একেকদিন একেকজনকে ফোন করে, আজ স্কুল লাইফের কোন ফ্রেন্ড তো কাল কলেজ লাইফের কাউকে, তার পরেরদিন হয়ত ভার্সিটির কোন একজন। কখনো কোন কাজিন, কোনদিন দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয়কে। এভাবে হুট করে ফোন দিতে মজাই লাগে মিথিলার। বেশীরভাগ সময়ই হঠাৎ করে ফোন পেয়ে প্রথমে কোন কথা খুঁজে পায় না ওপাশের মানুষটা, ফরমাল কথাবার্তা শেষ করে একটু ধাতস্ত হয়ে যখন জমিয়ে গল্প করার মুডে আসে, ঠিক তখনই মিথিলা ফোন রেখে দেয়, মজাই লাগে এই ফোন ফোন খেলায়।
কারওয়ান বাজারে রিকশা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে সোনারগাঁ হোটেল পর্যন্ত যাওয়ার পথটুকু প্রথম প্রথম পার হতে খুব অস্বস্তি হত মিথিলার। নানান রকম মানুষের ভিড়ে সয়লাব, তার সাথে কাঁচা বাজারের উৎকট গন্ধ! কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব কিছু সয়ে যায়, নিজের অজান্তেই মানুষ নিজেকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়, নিতে হয়। আর তাই এখন নিজের অজান্তেই এই এলাকায় পৌঁছানো মাত্রই সেই বুনো ঝাঁঝালো উৎকট গন্ধটা যেন ইন্দ্রিয়গুলো খুঁজে ফেরে। মাঝে মাঝে হুট করে কাঁচা বাজারে ঢুঁকে পড়ে মিথিলা, কখনো কোন সবজি পছন্দ হলে, বা কোন মাছটা পেলে কিনে নেয়। এখানে বাজার করাটা খুব মজার, কারণ, হাতিরপুল বাজার হতে অনেক অনেক সস্তায় সব বিকোয় এখানে। তবে প্রায় সময়ই পরিমানে অনেক বেশী কিনতে হয়। কিন্তু তার খুব মজা লাগে এই কাজটা করতে। ইদানীং সে কাপড়ের ছোট একটা ব্যাগ তার ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর রাখে, হুট করে কেনা কোন কাঁচাবাজারের জন্য। এখানে প্রায় দোকানীর কাছেই ব্যাগ থাকে না।
আজও ফোনে রুবিনা’র সাথে কথা বলতে বলতে এসেছে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত, কিন্তু আজ ফোনের লাইন কাটতে পারে নাই, কলেজের এই বান্ধবীটার সাথে কথা বলে আরাম পায় সে, অনেকদিন পর ফোন করলেও অন্যদের মত রোবোটিক ফরমাল কথায় যায় না সে, আর তাই মিথিলা গল্প করে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। কারওয়ান বাজারে রিকশা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে আসার সময় মিথিলা দেখল এক লোক কচুর লতি বিক্রি করছে, কি মনে করে কানে মোবাইল আটকে রেখে দরদাম করে ইয়া মোটা এক আটি লতি কিনে ফেলল। সাথে থাকা কাপড়ের ব্যাগে ভরে হাঁটা শুরু করল রুবিনার সাথে কথা বলতে বলতে, হাতের ব্যাগটা অনেক ভারী মনে হচ্ছে, কমপক্ষে সের পাঁচেক লতি মনে হয় হবে। ব্যাগের ভারে হাত টনটন করছে, এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে মোবাইল, তার সাথে কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ; ব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখে লতির আটি ব্যাগের বাইরে মাথা বের করে স্বগৌরবে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীদের অনেকেই আড়চোখে মিথিলা আর তার লতির ব্যাগের দিকে তাকাচ্ছে এটা মিথিলা কথায় ব্যস্ত থাকলেও বুঝতে পারছিল ঠিকই।
রাস্তা পার হয়ে সুন্দরবন হোটেলের কাছে গিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল মিথিলা, এতো লতি বাসায় নিয়ে কি করবে সে? তার শ্বশুর বাড়ীর কেউ তেমন একটা এইসব লতি-কচু জাতীয় খাবার পছন্দ করে না, তার উপর এতো লতি! এগুলো কে কুটবে? কে রাঁধবে? কে খাবে? তাকে এখন আবার এঙ্কর টাওয়ারের এইচএসবিসি ব্যাঙ্কে ঢুকতে হবে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার জন্য... ধুর, কি যে করে সে... নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হল সে।
“এই রাখি রে, পরে কথা হবে...” বলে মোবাইল ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে ভাবতে লাগলো কি করা যায়? কোথাও ডাস্টবিন দেখে ফেলে দিয়ে বুথে ঢোকাই শ্রেয় বলে মনে হল। আহ! ভাবতেই একটু স্বস্তি পেল, কিন্তু এতোগুলো খাবার ফেলে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। কাউকে যদি বেশীরভাগটুকু দিয়ে দেয়া যেত, তাহলে অল্পটুকু সে কাপড়ের ব্যাগে মুড়িয়ে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে বাসায় নিয়ে যেতে পারতো। এঙ্কর টাওয়ারের কাছে গিয়ে ডাস্টবিন খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেল তার আগেই ফুটপাথের উপর পলিথিন দিয়ে বাসা বেঁধে কয়েকটা মহিলা বাচ্চা নিয়ে সংসার পেতে বসেছে। ধীর পায়ে তাদের একটির কাছে এগিয়ে গিয়ে সঙ্কোচের সাথে একটা মহিলাকে বলল, “এই যে শোনেন, আমি যদি এই লতিগুলো আপনাকে দেই, আপনি কি নিবেন?” মহিলা প্রথমে একটু সন্দেহর দৃষ্টি হেনে মিথিলাকে পরখ করলো, তারপর হাসি মুখে হাত বাড়ালো, অম্নি আরও কয়েকজন মহিলা এগিয়ে এল, কাড়াকাড়ি শুরু করে দিল নিজেদের মধ্যে। কোথায় মিথিলা ভেবেছিল অল্পকিছু লতি বাসায় নিয়ে যাবে, এখন আর সে কথা মুখে উচ্চারণ করলো না। হাঁটা দিল ব্যাঙ্কের ভেতরে।
বুথ থেকে টাকা তুলে বের হতে না হতেই মাগরিবের আজান দিয়ে দিল, দ্রুত পা বাড়াল বাইরের দিকে। এখান থেকে রিকশা পাওয়া আরেকটা ঝামেলা, হেঁটে গেলে বাসা পর্যন্ত যেতে বিশ/পঁচিশ মিনিটের বেশী লাগে না, আবার রিকশা পেয়ে তাতে করে বাসায় যেতেও একই সময় খরচ হয়ে যায়। ধুর... কেন যে পাগলামি করে লতিটা কিনতে গেল? নিজেকে নিজেই মনে মনে ধমক দিল। লতির ঝামেলায় না গেলে আধঘণ্টা আগে বাসায় ফেরা যেত। বাবুটা বুঝি কেঁদে অস্থির এতক্ষণে। এঙ্কর টাওয়ার থেকে বের হয়ে বাসার দিকের রাস্তা ধরে আগে বাড়তেই নিজের অজান্তে ওপাশের ফুটপাথে চোখ গেল মিথিলার। আর তখন সে যা দেখলো তা তার এতক্ষণের বিরক্তি, মেজাজ খারাপ সব দূর করে অদ্ভুত একটা মন ভালো করা অনুভুতি এনে দিল পুরো চেতনা জুড়ে।
রাস্তায় ডেরা ফেলা তিনটা পরিবারের মহিলাগুলো কি উৎসাহ নিয়ে মিথিলার দেয়া লতিগুলো নিয়ে এই সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে কুটতে বসে গিয়েছে। আজ রাতে বুঝি তাদের ডিনারটা খুব জম্পেস হবে, এতটুকু পাওয়ায় কতটুকু আনন্দ খুঁজে পায় এই অনেক কিছু না পাওয়া মানুষগুলো। মিথিলার খুব ইচ্ছা হল এই মহিলাদের সাথে বসে পরে রান্না-বান্নায়, তারপর একসাথে খেতে বসে শুঁটকি দিয়ে রাঁধা লতি, সাথে গুড়ো চিংড়ি দিয়ে লতির ঝোল। কিন্তু এদের কি শুঁটকি বা চিংড়ি লাগে? নাকি জোটে? শুধু লতিই যে অমৃত! মিথিলা মনে মনে ঠিক করে, আরেকদিন লতির সাথে শুঁটকি আর গুড়ো চিংড়ি নিয়ে আসবে এদের জন্য। ভাবতেই এক অজানা আনন্দে আন্দোলিত হয় অনুভূতিগুলো, অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ছেয়ে যায় মনটা। অতি অল্পতেও অনেক সুখ লুকিয়ে থাকে, আনন্দ লুকিয়ে থাকে; শুধু জানতে হয় সেই আনন্দে অবগাহন করার গোপন মন্ত্রটুকু...
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৫:৩০