ডিনারের বাগদা চিংড়ি’র মালাইকারীটা খুবই ভালো হয়েছে, তৃপ্তি করে খাচ্ছি, গিন্নি রেঁধেছে বটে... ফার্স্টক্লাস। ছেলে এইচএসসি’তে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, এই খুশীতে আজ বাসায় স্পেশাল ডিনার। সেই সময় হঠাৎ ছেলের এমনতর প্রশ্নে আমি বিষম খেলাম... ‘বাবা তোমার জিপিএ কত ছিল?’
আমার ছেলে তুষার, যে তার বড় দুই ভাইবোনের ন্যায় মেধার স্বাক্ষর রেখে এসএসসি আর এইচএসসি দুটোতেই গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। আমার বড়মেয়ে তন্দ্রা ডিএমসি’তে ফোর্থ ইয়ারে পড়ছে, তার ছোট শুভ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকনমিক্সে সেকেন্ড ইয়ারে। সবচেয়ে ছোটজন তুষার। দিন'তিনেক আগে রেজাল্ট হয়েছে, ঘরের সবাই খুশী, আমি আর গিন্নীতো মহাখুশী যাকে বলে। তো খাবার টেবিলে এই প্রশ্নশুনে ভিমরি খেলাম।
বড় দুইজন লুফে নিল কথাটা, হ্যাঁ ঠিকইতো, বাবা’র জিপিএ কত ছিল? খাওয়া শেষে মহা উৎসাহে পুরো পরিবার ঘিরে ধরলো, বাধ্য হয়ে আমার ফাইলপত্রের ভেতর হতে একাডেমীক সার্টিফিকেটের ফাইলখানি আলাদা করে খুঁজে পেতে বের করে দিলাম আমার মেট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েটের মার্কশিট। আর তাই নিয়ে ওরা তিন ভাইবোন ঝাঁপিয়ে পড়ল, সাথে বাচ্চাদের মত উল্লাসে যোগ দিল গিন্নী স্বয়ং।
আমি বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতির আঁধারের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম, আর রোজকার পায়চারী। প্রতিদিন ডিনার শেষে আমি এই ছোট্ট ব্যালকনিতে আধঘণ্টা’র মত পায়চারী করি, অনেকটা ব্যায়ামের মত। আজও তাই করছিলাম, কিছুক্ষণ পর ড্রইং রুম হতে সমস্বরে অনেকটা উল্লাস ভেসে আসলো। বড় মেয়ে এসে টানতে টানতে ড্রইং রুমে নিয়ে গেল। সবাই মুচকি হাসছে আমায় দেখে, প্রথম কথা বলল ছোট ছেলে...
‘ছিঃ বাবা, তোমার রেজাল্ট এত পুওর ছিল’
আমি ঢোক গিললাম, আমার রেজাল্ট আমাদের ইউনিয়নে সেরা ছিল, জেলায় প্রথম পাঁচজনে ছিলাম। আর সেই রেজাল্ট কি না পুওর!
মেয়ে বলল, ‘জানো তোমার জিপিএ কত এসেছে? অনলি ৪.২৫!’
আমি বললাম, ‘আমাদের সময় খাতা অনেক হার্ডলি দেখা হত। মাস্টারমশাই’রা এখনকার মত এত্ত এত্ত নাম্বার দিতেন না, বুঝলে’
‘বাবা ইটস নট ফেয়ার। এখন আমরা ভালো লিখছি বলেই নম্বর পাচ্ছি’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমরা আমাদের জেনারেশনের চেয়ে অনেক মেধাবী, কিন্তু এটাও সত্যি তোমরা এখন যেমন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছো আমাদের সময় তেমন ছিল না’
‘বুঝেছি, বুঝেছি বাবা, আর বলতে হবে না। এখন হেরে গিয়ে এত্ত এত্ত যুক্তি...’ ছোট ছেলের কথায় আমি একটু বিরক্ত হলাম, কিছুটা কষ্টও পেলাম। কেমন ঠাট্টামিশ্রিত কথাটা কানে বাজলো। আর সন্তানদের আমি বন্ধুর মত সঙ্গ দিয়ে বড় করলেও যথেষ্ট ভদ্রতা এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছি। তাই ব্যাপারটা হজম করতে আমার একটু কষ্ট লাগলো। সাথে দেখি গিন্নীও যোগ দিল ফোঁড়ন কেটে, ‘এই রেজাল্টেই সরকারী আমলা!’
মাস দুয়েক পরের কথা, ছোট ছেলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কোথাও টেকেনি। বাসায় সবার মন খারাপ, থমথমে মুখ করে সবাই ঘোরাফেরা করছে। আমি তুষারকে জোর করে ডিনারের টেবিলে এনে বসালাম। কোনোমত একটু মুখে দিয়ে উঠে যাচ্ছিল। আমি ইশারা করে বসতে বললাম। খাওয়া শেষ হতে ড্রইংরুমে ছেলেকে নিয়ে বসলাম। বাকী দুইজন আর তাদের মা’ও এসে বসলো। আমি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘দেখো বাবা কোন পছন্দসই পাবলিক ভার্সিটি’তে চান্স পাওনি, তো কি হয়েছে? প্রাইভেটে ট্রাই করবে, সেখানে না হলে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। সেখানে দেশের হাজার হাজার ছেলে মেয়ে পড়ছে না? আর কখনো মন ছোট করবে না। সবাইকেই ভালো কোথাও পড়তেই হবে এমন কোন কথা নেই; ভালো রেজাল্ট, ভালো ক্যারিয়ার, এগুলোই জীবনের সব নয়। মানুষ হিসেবে গোল্ডেন এ প্লাস সমতুল্য মানুষ হও জীবনে, ভালো ভার্সিটিতে নয়... স্থান করে নাও তোমার চারিপাশের মানুষের মনের মণিকোঠায়... তবেই মানব জীবন সার্থক হবে। বাবা হিসেবে আমি গর্বিত হব। এবার আমার দিকে চেয়ে একটু হাসো দেখি...’ বলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
বোকা ছেলে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল, ঘরের অন্য তিনটি মানুষও দেখি চোখ মোছায় ব্যাস্ত, কিন্তু খুব নীরবে। আমি হাসি হাসি মুখে চেয়ে দেখি, নিজেকে খুব সুখী মনে হয়। একসময় আমার চোখ হতেও সন্তানদের কল্যাণে আশীর্বাদ হয়ে দু’বিন্দু জল জমা হয়।
(ইহা একটি ছোটগল্প মাত্র যাহা প্রথম পুরুষে রচিত। গল্পের সাথে আমার কোন যোগসূত্র নেই। পাঠক যেন বিভ্রান্ত না হন, তাই এই ফুটনোট)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৪ রাত ২:২৫