‘এই খোকা কাঁদছো কেন?’
‘কই? কাঁদছিনাতো...’ বলে রন্তু সেই মানব জটলা ঠেলে রাস্তায় নেমে এল। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা রন্তুকে ভিজিয়ে দিতে লাগলো। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা রন্তুর ছোট ছোট অশ্রুকে গ্রাস করে নিতে লাগলো তার বিশাল জলাধারে। রন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কেন? সে নিজেও জানে না। এতো কান্না নয়, এ হল রন্তুর কালো আকাশ হতে ঝরে পরা বৃষ্টিকনা। রন্তুর জীবনের কালো আকাশে যে অনেক মেঘ জমেছে এই ছোট্ট সময়েই।
-------------------
'রন্তু'র কালো আকাশ' এখানেই শেষ হয়েছিল। কিন্তু গল্পটা লেখার পর থেকেই মনে হচ্ছিল না এই গল্পের শেষতো এখানে হয় নাই। এই গল্পের শেষ হয়েছিল আরও কঠিন কোন সময়ে। আর সেই সময়টা খুঁজে পেতেই 'রন্তুর কালো আকাশ' ছোটগল্প থেকে ধারাবাহিক হিসেবে লেখার এই অপপ্রয়াস। যারা প্রথম পর্ব মিস করেছেন তাদের জন্য লিংক দিয়ে গেলামঃ রন্তু'র কালো আকাশ
-------------------
২.
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো খুব তীক্ষ্ণ আজ, রন্তুর শরীরে সূচের ন্যায় বিঁধছে। একটু শীত শীত অনুভূতি, কিন্তু রন্তুর সেদিকে খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কেঁদে এখন অনেকটা শান্ত সে। সামনে বৃষ্টির ঘোলাটে পর্দা ভেদ করে কোন সুদূর পাণে তার দৃষ্টি তা বোধগম্য নয়।
একটানা বৃষ্টিতে সে ভিজে ভিজে হেঁটে চলেছে। হঠাৎ করে রাস্তার জমে থাকা পানির নীচের কোন এক খানাখন্দে হোঁচট খেয়ে সে পড়ে গেল এবং তখন বুঝি তার সম্বিৎ ফিরে এল। হঠাৎই তার খেয়াল হল তার ব্যাগের বইখাতা সব ভিজে একাকার। হায় হায় কি হবে এখন! ভাবতেই তার আবার কান্না পেতে লাগলো।
রন্তু খেয়াল করলো সে বাড়ীর রাস্তা ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছে, সে আবার উল্টা পথে হাঁটা শুরু করলো। রন্তু নানু বাসায় আসার পর প্রথম কয়েকদিন মা অথবা নানু তাকে স্কুলে আনা নেওয়া করেছে। এরপর একটা বুয়া ঠিক করা হল, কিন্তু প্রথম দিনই ঘটনা ঘটলো। বুয়া রন্তুকে স্কুল থেকে আনতে দেরী করলো, আর রন্তু নিজে নিজে বাসায় চলে আসলো। মা আর নানু তাকে সেই কি বকাটাই না দিল! কিন্তু লাভ হল একটাই, রন্তুকে স্কুল থেকে আনা নেওয়া করার জন্য আর কাউকে কষ্ট করতে হল না। সে প্রতিদিন একা একা বাসা থেকে স্কুল যাওয়া আসা করতে লাগলো। যদিও প্রথম দিকে নানু আর মা তাকে রোজ সাবধান করে দিত কারো সাথে রাস্তায় কোন কথা না বলতে অথবা কেউ কিছু দিলে যেন সে না খায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন কেউ আর এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। রন্তু নিয়ম করে রোজ স্কুলে যায়, আসে।
বাসার দরজায় রন্তু খুব হালকা করে কড়া নারে, কলিং বেল পর্যন্ত তার হাত যায় না। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর গেট খুলল নানু, রন্তুকে দেখেই তিনি হা হা করে উঠলেন।
‘এই ছেলে তুই এই বৃষ্টিতে ভিজে এসেছিস কেন? তোর বাবা কই...?’ বলে নানু দরজার বাইরে কাউকে খুজলেন।
কাউকে সেখানে খুঁজে না পেয়ে তিনি আবার রন্তুর দিকে দৃষ্টি দিলেন।
‘কিরে তোর বাবা আজ আসে নাই?’
রন্তু মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে জানালো যে, বাবা আজ আসে নাই।
‘আমি এই জন্যই শায়লাকে বলি, ছেলেকে তার বাবা কেন মায়া দেখাতে স্কুলে আসবে। নিকম্মাটার যদি এতই ছেলের জন্য মায়া লাগে তো নিয়ে যা না তোর কাছে বাবা... সেই মুরোদতো নেই...’ নানু গজগজ করতে করতে ভেতরে চলে গেলেন।
রন্তুর এসব কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগে না। নানু কেন জানি বাবাকে দুচোখে একদমই দেখতে পারে না, বাবার নাম শুনলেই কেমন রেগে যায়। বাবা সম্পর্কে খুব বাজে বাজে কথা বলতে থাকে। রন্তুর কেন জানি বাবার জন্য খুব মায়া লাগে, কেন? সে নিজেও জানে না। বাবাকে ঘিরে তার তেমন জমাট স্মৃতি নেই, কিন্তু তারপরও বাবার জন্য তার খুব মায়া লাগে।
হঠাৎ করেই নানুর গলার স্বরে রন্তু সজাগ হয়।
‘এই যে রাজপুত্র, নবাবজাদা... ব্যাগটা খুলে দেন। বইপত্রতো সব ভিজিয়ে ছারখার করে নিয়ে এসেছেন। এগুলো শুঁকোতে দেই, আর আপনি গিয়ে ভেজা জামা কাপড় পাল্টে দ্রুত গোসল করে আসেন। এইবার যদি জ্বর আসে... রন্তু... তোকে ঐ বড় রাস্তার পাশে মসজিদের গেটে শুইয়ে দিয়ে আসবো...’
নানুর কথা শুনে রন্তু ফিক করে হেসে দিল। নানু
রেগে গেলে উল্টাপাল্টা কিসব যে বলে, শুনলেই রন্তুর খুব হাসি পায়।
‘এই বাঁদর কোথাকার, হাসছিস কেন? কি বললাম কথা কানে যায় না? হায় খোদা শায়লা নিজেও পুড়লো, আমাকেও পোড়ালো...’ বলে নানু গজগজ করতে করতে আবার ভেতরে চলে গেল।
রন্তু পায়ে পায়ে গোসলখানার দিকে গেল। জামা কাপড় খুলে কল ছেড়ে দিতেই বালতিতে জল পড়তে লাগলো, কেমন গরম মনে হচ্ছে কল হতে বের হওয়া পানিগুলোকে। রন্তু খেয়াল করেছে বৃষ্টিতে ভেজার পর গোসলখানার জল কেমন গরম লাগে, কি আশ্চর্য! অন্যসময় কিন্তু এমন হয় না, কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার পরপরই কেন যেন এমন লাগে। রন্তু দ্রুত গায়ে ঝপাঝপ পানি ঢালতে লাগলো। দরজায় নানুর আওয়াজ পেয়ে রন্তু ঘুরে তাকালো। নানু তার জন্য শুকনো জামা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে। রন্তুর সাথে কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে, এখানে সাবান দাও, তো সেখানে ভালো মত পানি দাও... উফ! নানুর যন্ত্রণা ভালো লাগে না।
গোসল শেষ করে শুকনো জামা গায়ে দিয়ে রন্তু খেতে বসলো। মা’কে কোথাও দেখা গেল না। রন্তু খুব ভয়ে ভয়ে ছিল, মা তাকে না আজ মেরেই ফেলে। গত সপ্তাহে সে স্কুলের হোমওয়ার্ক করে নাই, ম্যাডাম ডায়েরিতে তা লিখে রিপোর্ট করে দিয়েছিল গার্ডিয়ানের সিগনেচার এর জন্য। রন্তু মা’কে সেই ডায়েরি দেখাতেই মা কেন জানি খুব ক্ষেপে উঠলো। রন্তু আচ্ছা মত চড় মারতে লাগলো, এমন মার রন্তু তার জীবনে কখনো আগে খায় নাই। মা একসময় রন্তুরকে মাটিতে ফেলে তার উপর বসে তাকে মারতে লাগলো। মায়ের নখের আঁচড় লেগে রন্তুর বাঁ চোখের নীচের দিকে ছরে গিয়ে রক্ত বেড়িয়ে গিয়েছিল। নানু এসে মা’কে না থামালে মা বোধহয় তাকে মেরেই ফেলতো। রন্তু দ্রুত খাওয়া শেষ করে বিছানায় চলে আসলো। তার কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে।
ঘর অন্ধকার, কেমন যেন কালো একটা জগৎ। রন্তু’র ঘুম ভেঙ্গেছে এই কিছুক্ষণ আগে। প্রথমে সে কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিল না, অনেক কষ্টে চোখ খুলল। পুরো ঘর অন্ধকার, এখন কয়টা বাজে? রন্তু ঠাওর করার চেষ্টা করল। সে স্কুল থেকে ফিরেছে দুপুর বারোটা নাগাদ। গোসল খাওয়া শেষে সে যখন বিছানায় গেল তখন দুপুরের আজান দিচ্ছে। ওমা! সে নিজে অবাক হল, কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? এখন কি রাত হয়ে গেছে? সবাই কি ঘুমিয়ে পড়লো নাকি? রন্তু’র খুব শীত করছে। তার গায়ে কে যেন একটা পাতলা কাঁথা দিয়ে গেছে, মা অথবা নানু হয়তো। তারপরও রন্তুর খুব শীত শীত করছে। মা’র কথা মনে হতেই রন্তুর খুব ভয় হতে লাগলো। আজ সে স্কুল থেকে ফেরার সময় সব বইপত্র ভিজিয়ে ফেলেছে। গত মাসে অংক বইটা হারিয়ে ফেলায় মা তাকে কত বকাঝকা দিল, আর আজতো সে সব বইপত্র ভিজিয়ে ফেলছে। আজ আর তার রক্ষা নেই, ভাবতেই রন্তুর খুব কান্না পেল।
কান্না ভেজা চোখ মুছতেই তীব্র আলো চোখে লাগলো, চোখে আলোটুকু সয়ে আসতেই রন্তু দেখতে পেল তার মা এই ঘরে এসেছে। ভয়ে ভয়ে রন্তু মা’র মুখের দিকে তাকালো। মা রন্তুর পাশে বিছানায় বসে তার কপালে হাত রাখলো।
‘রন্তু সোনা, খুব জ্বর এসেছে যে? বৃষ্টিতে কেন ভিজলে?’ মা’কে খুব শান্ত এবং মিষ্টি দেখাচ্ছে। রন্তু কোন কথা বলল না।
‘আজো বাবা আসে নাই’ শায়লা’র কথায় রন্তু ঘাড় নেড়ে জানালো যে না আসে নাই।
‘রন্তু সোনা, বাবাকে তোমার খুব ভালো লাগে?’
‘জানি না...’
‘জানি না মানে কি? তোর বাবা, তোর তাকে ভালো লাগে কি না সেটা তুই জানবি নাতো কে জানবে? আমি?’
মায়ের কথা শুনে রন্তু ফিচ করে হেসে দিল।
‘এই যে জ্বর বাঁধালি, এখন যদি নানু তোকে সত্যি সত্যি মসজিদের গেটে দিয়ে আসে? তো কেমন হবে?’ মা কেমন দুষ্টুমি মাখা স্বরে বলল।
‘জানি না...’
রন্তুর উত্তর শুনে শায়লা একটু হেসে উঠলো।
‘কিরে তোর সব উত্তর কি আজকে ‘জানি না’ দিয়েই হবে?’
‘মা পাখাটা বন্ধ করে দাও না... শীত করে...’
‘ওমা, পাখাতো বন্ধই। দেখি জ্বর বোধহয় আরো বেড়েছে... দেখি জলপট্টি নিয়ে আসি...’ বলে শায়লা উঠে যেতে নিতেই রন্তু তার ছোট্ট হাত দুটি দিয়ে তাকে টেনে ধরলো।
‘মা... ওমা...’
‘আবার কি হল?’ শায়লা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রন্তুর দিকে তাকালো।
‘আমি আর বৃষ্টিতে ভিজবো না, সত্যি... এইযে তোমায় ছুঁয়ে বললাম’
‘হুম বুঝলাম...’
‘মা আমার বইগুলো না সব ভিজে গেছে, তুমি আমাকে মেরো না। আমি আর বইখাতা নষ্ট করবো না’ বলেই অন্তুর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
শায়লা ছেলের পাশে বসলো। রন্তু এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শায়লা রন্তুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। জানালা দিয়ে দূরে ঐ আকাশে একটুকরো চাঁদ মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু আকাশে প্রচুর মেঘ থাকায় চাঁদ বারবার হারিয়ে যাচ্ছে মেঘেদের আড়ালে। শায়লার কাছে তার ছেলে রন্তু ঐ চাঁদের মত দামী। ঠিক হল কি ভাবনাটা? শায়লা নিজেকেই প্রশ্ন করে। ঐ চাঁদের জীবনে অমাবস্যা আছে, কলঙ্ক আছে। রন্তুর জীবনে সেগুলো আসুক শায়লা তা চায় না। কিন্তু না চাইতেও ঐ কালো মেঘের দল যেমন চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে, তেমনি রন্তুর জীবনেও না জানি কতশত কালো মেঘের দল ধেয়ে আসছে। ভাবতেই দুফোঁটা অশ্রুজল শায়লার চোখ হতে আবার ঘুমিয়ে পড়া রন্তুর গায়ে গিয়ে পড়ল।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৪