সিরিজের সব লেখা: Never Underestimate Anybody: জীবন থেকে নেয়া একগুচ্ছ প্রেরণার গল্প
বিকেল চারটার দিকে শিবলি ফোন করে বলল অফিস শেষে সরাসরি তার বাসায় চলে আসতে। শিবলি আমার কলেজ ফ্রেন্ড, এখনও যে কয়েকজন স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ আছে, শিবলি তার মধ্যে অন্যতম। ওর বাসার ছাদে পাটি বিছিয়ে গল্প করতে আমার দারুন লাগে। শিবলি’র বাসা পুরাতন ঢাকার একটু ভেতরের দিকে, পুরাতন আমলের একটি বাড়ী। ছাদের চারিদিকে পাঁচ ফিট উচু দেয়াল দেয়া আছে, পাটি পেতে সন্ধ্যার পর ছাদে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকলে ভীষণ ভালো লাগে। অফিস থেকে বেড়িয়ে তাই বাসায় না যেয়ে পুরাতন ঢাকার দিকে রওনা হলাম।
শিবলি বাসাতেই ছিল, আমি যেতেই আমাকে নিয়ে ছাদে চলে গেল। ও জানে ওদের ছাদটা আমার খুব পছন্দের। ছাদে যেতে এই অবেলায় ও বিরিয়ানি নিয়ে এলো। ওদের বাসায় এলে প্রায়ই এই সুখাদ্যটি ভাগ্যে জোটে, শিবলি’র আম্মা, আণ্টি বিরিয়ানি খুব ভালো রাঁধেন। বিরিয়ানি মাত্র মুখে দিয়েছি, শিবলি বলল, “দোস্ত কাল জাপান চলে যাচ্ছি...”
আমার মুখের খাবার গিলতে গিয়ে গলায় আটকে রেখে কোনমতে বললাম, ‘মানে... শেষ পর্যন্ত হল?...’
‘হ্যা রে দোস্ত...’।
শিবলি পুরাতন ঢাকার স্থানীয় পরিবারের ছেলে, যে পরিবারের আদি পেশা ব্যাবসা। কিন্তু শিবলি ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় খুব আগ্রহী ছিল। কিন্তু কষ্টের ব্যাপার ছিল সে তেমন মেধাবী ছিল না, টেনেটুনে গনিতে পাশ করতো। কিন্তু কথায় বলে না, ঘষতে থাকলে মরচে পরা লোহায় ধারালো ছুরী হয়। তেমনি নিরলস চেষ্টা করে করে শিবলি ছুঁয়েছে তার স্বপ্নকে।
‘শেষ পর্যন্ত তোর স্বপ্ন ধরা দিল?’
‘হ্যাঁ...’ বলে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। সন্ধ্যার শেষ আলোয় তার চোখের কোনায় ভেজা ভেজা প্রতিফলন দেখলাম মনে হল।
শিবলি মেট্রিক পরীক্ষায় নর্মাল ফার্স্ট ডিভিশন পায়, কোন ভালো কলেজে চান্স পায় নাই। তারপরও সে দমে নাই। লেগে ছিলো বইয়ের সাথে আঠার মত। বয়সের সাথে সাথে ম্যাচুরিটি আসতে থাকার সময়টায় তার মেধা খুলতে থাকে বোধহয়। ইন্টারমিডিয়েটে আশাতীত রেজাল্ট করে। কিন্তু ঝামেলা শুরু করে তার পরিবার। পড়ালেখা করে কি হবে? সেই ছাপোষা কেরানী আর নয়তো মাস্টার! বাসার সবাই চাপ দেয়া শুরু করে ব্যাবসায় জড়াতে, বাবার সাথে পারিবারিক ব্যাবসার হাল ধরতে। এই নিয়ে শুরু হয় বাক-বিতণ্ডতা। পরিবারের শত বাঁধা ডিঙ্গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বসে শিবলি। কিন্তু বিধিবাম, কোথাও চান্স পায় না।
‘নে চা নে ...’ শিবলি নিচে গিয়ে চা নিয়ে এলো এক ফাঁকে।
‘বাসার সবাই কি বলে?’
‘কি আর বলবে, সবাই মহা খুশী’
‘তোদের ব্যাবসার কি খবর?’
‘ব্যাবসা বন্ধ, দোকান বোধহয় বেঁচে দিবে।’
প্রথমবার কোথাও চান্স না পেয়ে যেন আরও রোখ চেপে গেল শিবলির। সারাদিন ছাদের উপরের ছোট্টো চিলেকোঠায় পড়ায় মত্ত। কি খারাপ সময় পার করেছে ছেলেটা! বাসার সবার টিপ্পনী, বন্ধুদের বাঁকা হাসি, বাসা থেকে সব ধরণের হাত খরচ বন্ধ। দুইটা টিউশনি সাথে কোচিং সেন্টারে টিচিং। এই করে করে ২য় বার চেষ্টায় ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া থেকে আজ এতদূর। আজ তার আয়ে সেই সংসার চলছে, আর দেবে গেছে সেই ব্যাবসা।
‘তোর মনে আছে মিতু নামের একটা মেয়ে পড়তো আমাদের সাথে...” শিবলি কথা বলার সময় তার মুখ কেমন ঝলমল করে উঠলো।
‘কোন মিতু? যার প্রেমে তুই হাবুডুবু খেয়েছিলি?’
‘আমি কারো প্রেমে হাবুডুবু খাই নাই। ফাও কথা বলবি না...’ কপট রাগ দেখিয়ে মুখ গম্ভীর করে ফেলল শিবলি।
‘আরে বাবু দেখি মাইন্ড খাইছে..., আচ্ছা সরি, তুই হাবুডুবু খাস নাই, গড়াগড়ি করেছিস...’ বলতেই শিবলি আমার দিকে তেড়ে আসলো।
কিছুটা আত্মরক্ষা করে শিবলিকে ঠাণ্ডা করে জানতে পারলাম, তার সহপাঠীণী মিতুও ওর সাথে বাংলাদেশ থেকে মনোবুশূ বৃত্তি পেয়ে পিএইচডি করতে জাপান যাচ্ছে। এই সেই মেয়ে যার জন্য ব্যাকুল ছিল শিবলির তরুণ মন, কিন্তু কখনো প্রকাশতো দূরের কথা, নিজের হৃদস্পন্দন থেকেও যেন লুকিয়ে রাখতে চাইতো। স্বপ্ন পূরণের অদম্য নেশায় মত্ত ছিল বইয়ের পাতায়। সহপাঠীরা তাকে দেখলে সমস্বরে বলে উঠতো, ‘আসলাম আর গেলাম, কিছুই দেখলাম না, কিছুই বুঝলাম না’। যেই দলে শিবলির প্রিয়মুখ মিতুও থাকতো।
এরপর সবকিছু ঘটেছে ছককাটা পথে। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে একটি আন্তর্জাতিক রিসার্চ অর্গানাইজেশনে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে জয়েন করে। এমফিল করতে যায় ডেনমার্ক উইথ ফুল স্কলারশিপ। এমফিল শেষে দেশে ফিরে আগের প্রতিষ্ঠানেই জয়েন করে গত তিন বছর চেষ্টা করে গেছে ভালো একটি স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে। আজ শেষে এসে মনোবুশু বৃত্তি পেয়ে পিএইচডি করতে যাচ্ছে জাপান। শিবলির দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটি কথাই বললাম, ‘নিজের ভেতর আত্মবিশ্বাস থাকলে আর পরিশ্রমের সাথে লেগে থাকলে মানুষ স্বপ্ন ছোবেই’।