আমি পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। ঘটনা এমন ঘটবে আমি তা বুঝতে পারিনি। ধানমণ্ডি দুই নম্বরের স্টার হোটেলে আমি চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছি। চায়ের কাপে প্রথমেই হুট করে লম্বা চুমুক দেয়া ঠিক হয় নাই। গত দুই ঘণ্টা ধরে আমি ঢাকা শহরের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে এখানে এসেছি এক কাপ চা খেতে, স্টারের চা আমি খুব পছন্দ করি। চায়ের উপরে স্বর পরে থাকায় আমি আন্দাজ করতে পারি নাই, প্রথমে চুমকেই জিহবা পুড়িয়ে আমি বোকা হয়ে গেলাম। শ্বাসনালীও বোধহয় পুড়েছে, চা যে কখনও এত গরম হতে পারে আমি তা কল্পনা করতে পারছি না। মেজাজটা এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, আজকে সন্ধার টিউশনিটা মিস হল, এই নিয়ে এ মাসে চার দিন মিস হল। বন্ধুর বোনকে ইমারজেন্সি রক্ত দিতে এসে আটকে গেছি, এক ব্যাগ রক্ত দিতে এসে গত দুই ঘণ্টা ধরে আমি আটকে আছি।
মেজাজ খারাপ করে হোটেল থেকে বের হয়ে এসে আমি সিটি কলেজের দিকে পা বাড়ালাম। অবাক কাণ্ড, আকাশে বিশাল একখানি চাঁদ উঠেছে, আজ পূর্ণিমা নাকি? অনেকদিন চাঁদের হিসাব রাখিনা। আমি চন্দ্রপ্রেমিক ছিলাম কোন এক কালে, আজকের এই সন্ধ্যারাতে আমাকে তা কাছে টানছে না। শরীর নিকোটিনের চাহিদা জানান দিচ্ছে, একটা সিগারেট ধরাবো কি না বুঝতে পারছিনা, এখনই আবার হাসপাতালে ঢুকতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ধানমণ্ডি পাঁচ নম্বরে পৌঁছে রাস্তা পার হলাম। লম্বা গাড়ির সারি সিগন্যাল পয়েন্টে অপেক্ষা করছে। গাড়িগুলোর ফাঁক গলে সর্পাকারে নিজেকে এপারে নিয়ে এসে সবুজ কাঁচ ঘেরা হাসপাতালে ঢুকে ওয়েটিং জোনের একেবারে কোনার দিককার একটি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে পড়লাম। বাইরে আকাশে বিশাল থালার ন্যায় একখানা রুপালী চাঁদ। ঝিম ধরে বসে বসে ভাবনার নানান ডালা মেলে দিলাম।
কতক্ষণ বসে আছি মনে নেই, হঠাৎ বাহির হতে ভেতরে দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি কালচে সবুজ রঙের শাড়ি পরা ছিপছিপে লম্বা এক মেয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি আশেপাশে তাকিয়ে নিশিত হলাম মেয়েটি আমার দিকেই তাকিয়ে। আমি নড়েচড়ে বসলাম, আমার মত ছন্নছাড়া, ম্যাড়ম্যাড়ে কোন মানুষ কোন অচেনা কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে ভেবে পুলকিত হলাম। মেয়েটির দিকে দ্বিতীয়বার তাকাতেই মেয়েটি মিষ্টি একটি হাসি দিল। আমি কি প্রতিত্তর দেব ভেবে না পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আবার বাইরের পানে তাকালাম। আমি হাসি দেখে এক লহমায় চিনতে পারলাম, আমার হৃদস্পন্দন যেন হঠাৎ করে আটকে গেল। শাড়ি পরিহিত থাকায় প্রথমে চিনতে পারি নাই, এ যে লুবনা, সেই লুবনা যার জন্য আজো মন কাঁদে।
লুবনা মেয়েটা আমার সাথে অনার্সে পড়ত, একই ক্লাসে আমরা সহপাঠী হওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে তার তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি লাজুক বা মুখচোরা টাইপের ছেলে না হলেও কেন জানি মেয়েদের সাথে তেমন মিশতে পারতাম না। সেই আমি মাসখানেকের মধ্যে এই মেয়ের প্রেমে ডুবে রসগোল্লা হয়ে গেলাম, রসগোল্লা বলেল ভুল হবে, একেবারে স্পঞ্জ রসগোল্লা। বাস্তবিক অর্থেই আমার নাওয়া-খাওয়া-ঘুম উবে গেল, চোখের নীচে কালি পড়ল নির্ঘুম রাতের ভালোবাসা জড়ানো বেদনাগুলোর কল্যাণে। দিনের দিনের পর দিন আমি দূর থেকে অপলক চেয়ে দেখতাম আমার স্বপ্নরানীকে। মাঝে মাঝে ধরা খেতাম যখন, লজ্জায় মাথা কাটা যেত আমার। লুবনাকে দেখতাম মুচকি হেসে কেমন করে একটা ভেংচি টাইপের মুখাবয়ব করতে।
প্রতি বছর আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে শিক্ষাসফরের নামে ভ্রমণে বের হত, যার উদ্যোক্তাদের অন্যতম একজন ছিল লুবনা। প্রতিবার আমার মন ব্যাকুল হত এই ভ্রমণের সঙ্গী হতে, কিন্তু অজানা কোন একটা কারনে কখনো যাইনি। ফোর্থ ইয়ারে এসে কিভাবে যেন সাহস করে, লজ্জার মাথা খেয়ে সঙ্গী হলাম ভ্রমণ দলের, লুবনার খুব কাছাকাছি কয়েকটা দিন থাকা যাবে ভেবে। সেই কয়েকটা দিন আমার জীবনের খুবই স্মরণীয় দিন ছিল। আমি সারাক্ষণ ব্যাকুল হয়ে আড়চোখে দেখতাম আমার লুবনাকে।
কিন্তু ভ্রমণ শেষে ভার্সিটিতে ফিরে দেখি সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। প্রথম কয়েকদিন ঘটনা কি বুঝতে পারি নাই, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে আবিস্কার করে ফেললাম ঘটনা। আমার লুবনার প্রতি দুর্বলতা সবাই বুঝে ফেলেছে। নানান টিপ্পনী, যার বেশীরভাগই অপমানজনক, আসতে লাগল আমার দিকে। আমি মানসিকভাবে খুবই ভেঙ্গে পড়লাম। কোনমতে অনার্স ফাইনালটা দিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে আসি। সেই দিনগুলো কি যে অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছে মনে পড়লে আজো হৃদয়ের কোন গোপন কুঠিরে রক্তক্ষরণ হয়। আজ এত বছর পর আমার কয়েক হাত দূরে আমার স্বপ্নরানী দাঁড়িয়ে!
“আপনি কি অনিক? মানে আপনার নাম কি অনিক?”
“জী না, আমার নাম অনিক নয়...” অবলীলায় মিথ্যা বলে দিলাম।
“আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
“জী না, কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।”
“না, মানে, আপনাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে।”
“হতে পারে, অনেক সময় অনেককে চেনা চেনা লাগেতে পারে...”
“সরি......” বলে লুবনা ওয়েটিং রুমের করিডোর ধরে মৃদু পায়ে পায়চারী করতে লাগল। আমি আগের মত রঙ্গিন কাঁচের ভেতর দিয়ে পূর্ণিমার রুপালী চাঁদের দিকে চেয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরালে দেখতে পেলাম লুবনা থেকে থেকে আমার দিকে অবাক হয়ে আড় চোখে দেখছে। হয়ত ভাবছে পথ চলার কোথাও হয়ত আমাকে দেখেছে। চার বছরে একই ছাদের নীচে ক্লাস করেছি, চেতনে না হোক অবচেতনে হলেও হয়ত আমার ছবি মনে গেঁথেছে। কিছুক্ষণ পর আমার বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়ে গেল রক্ত নেয়ার জন্য। রক্ত দিয়ে আমি নেমে এলাম ব্যাস্ত ঢাকার ফুটপাথে। রাস্তার অপর পাশের দোকান হতে গানের সুর ভেসে আসল কানে, নিজের মনে হেসে উঠলাম কাকতালীয়তা দেখে...
মনে পড়ে রুবি রায়
কবিতায় তোমাকে
একদিন কত করে ডেকেছি......
আজ হায় রুবি রায়
ডেকে বল আমাকে
“তোমাকে কথায় যেন দেখেছি...”
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:২২