somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই পর্যালোচনাঃ সূর্য দীঘল বাড়ী

৩১ শে জুলাই, ২০১৫ ভোর ৬:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




উপন্যাসের একেবারে শুরুতেই ১৩৫০ বঙ্গাব্দ তথা ইংরেজি ১৯৪৩ সনে বাংলায় দুর্ভিক্ষের একটা বর্ণনা পাওয়া যায় । শহুরে ব্যবসায়ীরা মজুদ করে করে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে আংগুল ফুলে কলাগাছ । ক্ষুধার তাড়নায় যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, নানা জায়গায় মাথা কুটে মরে সামান্য সাহায্যও পায় না । এরকমই এক ভাগ্য-বিড়ম্বিতা নারী জয়গুণ, যিনি এই উপন্যাসের মূল চরিত্র ।

জয়গুণ তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন হাড়-সর্বস্ব চেহারায় । সন্তানদের বাঁচানোর তাগিদে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন ভিটে বাড়িটিও । কিন্তু মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো লাগবে ! জয়গুণ বাধ্য হন সূর্য-দীঘল বাড়িতে উঠতে ।

সূর্য-দীঘল বাড়ি । জানা গেল, যেসব বাড়ি পূর্ব-পশ্চিম দিকে অর্থাৎ, সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দিকে প্রসারিত সেগুলোই সূর্য-দীঘল বাড়ি হিসেবে পরিচিত । আর এসকল বাড়ি সম্পর্কে গ্রামে প্রচলিত একটা কুসংস্কার আছে যে, এসব বাড়িতে মানুষজন টিকতে পারে না । বংশ নির্বংশ হয়ে যায় । তাই পারতপক্ষে কেউ এরকম বাড়িতে থাকতে চায় না, এমনকি থাকার কোনো জায়গা না থাকলেও । জয়গুণের আপত্তিটাও ছিল সেটা নিয়ে । কিন্তু শেষমেশ এক ভণ্ড পীরের আশ্বাসে, উপযুক্ত উপঢৌকন দেয়া সাপেক্ষে তাবিজ-কবজ নিয়ে জয়গুণ আর জয়গুণের ভাবী, শফির মা তাঁদের তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সে সূর্য-দীঘল বাড়িতে ওঠেন ।

জয়গুণ অবশ্য পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, বাড়ির ওপর অভিশাপ লাগা, ওসব বাজে কথা । বেঁচে থাকার তাগিদে, জীবন সংগ্রামে অংশ নিয়ে এই গ্রাম্য অশিক্ষিত মহিলাটিও জেনে গিয়েছিলেন জীবনের একটি অপরিহার্য সত্যের কথা, কুসংস্কারকে না বলা ।

পরবর্তীতে উপন্যাসের পরতে পরতে এরকম নানা রকম কুসংস্কারের ঘটনার উল্লেখ দেখা যায় । আবু ইসহাকের লেখনীতে সামাজিক অসংগতির কথা ব্যাঙ্গাত্বকভাবে ফুটে উঠে এসেছে সবসময়ই । এই উপন্যাসেও দেখা যায় সেসময়কার প্রচলিত সকল কুসংস্কারের পরিচয়, বর্ণনা এবং পরিণতি ফুটে উঠেছে দারুণ বিদ্রুপ নিয়ে । তাছাড়া লেখক কেন্দ্রীয় চরিত্রে জয়গুণকে রাখলেও তার পরিধির মধ্যে টেনেছেন সে সমগ্র অঞ্চলের মানুষজনের নানা চিন্তা-চেতনা , আর সম্প্রসারিতভাবে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের মাধ্যমে তথাকথিত স্বাধীন হওয়া একটা দেশের প্রতি গণমানুষের আকাংক্ষা আর তার বিন্দুমাত্রও বাস্তবায়ন না দেখে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া । লেখক এই বিষয়টা তুলে ধরেছেন সূক্ষ্ণ কিছু ঘটনা দিয়ে, যেমন – ফুড কমিটির সেক্রেটারির ঘুষ নেয়া, ধনীদের সংকীর্ণ মনোভাব, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কোনো দুর্ভিক্ষ ছাড়াই হু হু করে চালের দাম বাড়তে থাকা ।
এছাড়াও লেখক বিভিন্ন সময়ে সেই সময়টাকে দেখিয়েছেন কখনো হাসু , কখনো মায়মুন (জয়গুণের দুই সন্তান) এর চোখে আবার কখনো দেখিয়েছেন জয়গুণের প্রাক্তন স্বামী করিম বকশের দৃষ্টিতে । এছাড়াও পার্শ্ব চরিত্রের মত শফির মা, গদু প্রধান এরা গল্পের প্রয়োজনে এসেছে , কখনো বড় ধরণের প্রভাবও ফেলেছে । ছোট কিন্তু শক্তিশালী একটা চরিত্র হিসেবে রমেশ ডাক্তারের চিন্তাভাবনা পাঠকদের চিন্তার খোরাক জাগায় নিঃসন্দেহে । কে বলবে এই উপন্যাস লেখা হয়েছে আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে !

মোটকথা, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সমসাময়িক বঙ্গদেশে চলমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সংস্কৃতি, পরিচয় – এসবকিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রামীণ এক পরিবেশকে কেন্দ্র করে কিন্তু একইসাথে তাতে ফুটে উঠেছে সমগ্র দেশ ! খুব কমসংখ্যক লেখকই তাঁদের লেখায় দেখাতে পারেন এমন সমগ্রতা, এতো সীমিত পরিসরে থেকেও । আবু ইসহাক কতখানি শক্তিশালী লেখক ছিলেন, তা সহজেই টের পাওয়া যায় তার এই বইটির মাধ্যমে, বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর ধারে ।

লেখক আবু ইসহাক ১৯৬২-৬৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পেয়েছিলেন । ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ উপন্যাসটি অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রটিও আন্তর্জাতিক ছয়টি পুরষ্কারের পাশাপাশি ১৯৭৮ সালে ‘শ্রেষ্ঠ ছবি’ হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার লাভ করে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৫ ভোর ৬:৩৭
৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। তোমরা সংযত হও, নাহলে আমি পদত্যাগ করবো।

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:০৬




প্রফেসর ইউনূস এখন কী করবেন? তার সামনে বিকল্প খুবই কম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার নেতৃত্ব অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে । হয় তিনি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবেন, না হয় পদত্যাগ করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পুতুল নাচের মাঝের গল্প : ওয়াকার বনাম ইউনূস !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:০৯


বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান অবস্থা দেখে একজন সাধারণ নাগরিক কি ভাবছেন? তাদের ভাবনার আদৌতে গুরুত্ব আছে কোনো ? দেশে ইন্টেরিম সরকার ক্ষমতায় থেকে টেনেটুনে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে নির্বাচন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে...

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:৪৪


পঞ্চগড় সদর উপজেলার পানিমাছপুকুরি এলাকায় তাওহীদ মডেল মাদরাসার এক শিক্ষার্থী (সুমনা)’র রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের দাবি, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

নিহতের বড় বোন আমেনা খাতুন জানান, কিছুদিন আগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরব বসন্তের মত ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের জুলাই বিপ্লব

লিখেছেন ইশতিয়াক ফাহাদ, ২৩ শে মে, ২০২৫ রাত ১:৫১

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের স্বৈরশাসনের একটি নিদারুণ চক্র যেন ক্রমাগত ফিরে এসেছে। প্রতিটি স্বৈরশাসকের শাসনকাল যেন পূর্বসূরির তুলনায় দ্বিগুণ সময় ছিল ।
শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি - জুলাই বিপ্লবের বিশ্বাসঘাতক

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৩ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৩:০১



ডক্টর ইউনুস আর এই দেশের ক্ষমতায় আর থাকতে চাচ্ছেন না। তবে এর দায় ভারতের নয়, পলাতক স্বৈরাচারী আওয়ামিলীগের নয়। এই দায় সম্পুর্নভাবে এই দেশের বৃহত্তম রাজনৈ্তিক দল বিএনপির।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×