আমি একজন লেখক। মূলত উপন্যাস লিখি। গল্পও লিখি মাঝে মাঝে, তবে উপন্যাস লেখার চাপে এখন আর গল্প লেখার সময় হয়ে উঠে না। আপনারা নিশ্চয়ই বাজারে 'আজ কেন সখী এলো না', 'তুমি চাইলে বলেই তো আমি বিরহী হলাম', 'এ জীবনে তোমাকে চাওয়া ছাড়া আর কিছু নেই' কিংবা 'কতোটা সুখ তোমাকে দিতে পারি আমি' বইগুলো দেখেছেন। না পড়লেও হয়তো উল্টেপাল্টে দেখেছেন। কারণ আমার বইগুলোর প্রচ্ছদ একটু অন্যরকম। বড় বড় অক্ষরে এবং গাঢ় কালিতে বইয়ের নাম লেখা, গোলাপ ফুল কিংবা সিনেমার নায়িকাদের নিয়ে প্রচ্ছদ বানানো। কোনো বইতে হয়তো নায়িকা পূর্ণিমা মিষ্টি হাসছেন, কোনো বইতে হয়তো কাজলের বুক থেকে সরে যাওয়া শাড়ির আঁচল বসিয়ে দিচ্ছেন শাহরুখ খান। হ্যাঁ, আমিই ওই বইগুলোর লেখক। এই ধরনের বই যারা লিখেন, আমি মোটামুটি তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত।
আপনাদের অনেকেই হয়তো আমার নামও শুনেন নি, আমার বইগুলো দেখা তো দূরের কথা! আসলে মধ্যবিত্ত পাঠকের চাইতে শহুরে উচ্চ-নিম্নবিত্ত বা গ্রামের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পাঠকরাই আমার লেখার টার্গেট। ফলে এই বইগুলো আপনাদের রুচিতে বাঁধবে না, আমি জানি। আমি আজ পর্যন্ত যে কয়টি বই লিখেছি, একটি ছাড়া তার প্রত্যেকটির কাহিনী সত্য ঘটনা অনুসারে রচিত। প্রতিটিই নিটোল প্রেমের কাহিনী; কোনোটি শুরুর, কোনোটি বা শেষের। শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজ এখন প্রেমের কাহিনীগুলোকে এক ধরনের প্যানপ্যানানি বলে মনে করে শুনেছি, তবে গ্রামের মানুষগুলো কিন্তু এগুলোকে লুফেই নেয়। না হলে আমার বইয়ের এতো কাটতি হয়!
আমি প্রথম যে বইটি লিখেছিলাম, সেটি ছিলো একটি উপন্যাস। নাম- অন্তরযাত্রা। বইটির দুশ কপিও বিক্রি হয় নি। আমার কল্পনায় যে সমস্ত সুন্দর পারিবারিক কাহিনীগুলো ভাসতো, তারই একটির প্রতিফলন ঘটিয়েছিলাম এই উপন্যাসে। কিন্তু আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলাম- আমি এই কল্পনার কাহিনী পাঠককে মোটেই টানে নি। অথচ আমার মতে, কাহিনী হিসেবে এটিকে একেবারে উপেক্ষা করার মতোও না।
ভাবলাম হয়তো উপন্যাসের হাত আমার নেই। গল্প লেখা শুরু করলাম। নিজের কল্পিত কাহিনীগুলোকে আর খাতার পাতায় নিয়ে না এসে বন্ধুবান্ধবদের প্রেম-বিরহের কাহিনীগুলোকে কেন্দ্র করে আমার গল্পগুলো এগোতে লাগলো। একসময় লাল রঙের শক্ত কভারে বাধা মোটা খাতাটি ভরে উঠলো গল্পে গল্পে। আমার সেই উপন্যাসের প্রকাশকের বরাবরে যখন গল্পগুলো নিয়ে গেলাম, তিনি মোটামুটি সাগ্রহেই আমার লেখাগুলো টেনে নিলেন। বললেন- আপনার লেখায় শক্তি আছে। একবার ব্যর্থ হয়েই বসে গেলেন, এটা কিন্তু ঠিক না।
যাই হোক। বই বেরুল, নাম দিলাম 'জীবনের পথে বিছানো কাটায় তুমি গোলাপের সারি'। আপনারা কেউ বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, বইটির কাটতি হলো প্রচুর। এক মাস পর প্রকাশক যখন আমার হাতে দশটি হাজার টাকা দিয়ে পরবর্তী বইয়ের অঙ্গীকারনামা নিয়ে গেলেন, আমি তখন এটুকু বিশ্বাস করেছি- আমার মাথার ভেতর ভাসতে থাকা কল্পনাগুলো কোনোদিনই গল্প-উপন্যাস হয়ে উঠতে পারবে না। ওদের সেই শক্তিটুকু নেই। আমার দরকার বাস্তব ঘটনা। কিন্তু এতো ঘটনা আমি কীভাবে পাবো?
অবশ্য এর মধ্যেই কী করে যেনো একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক হয়ে গেলো! গল্প-উপন্যাসে যেভাবে মানব-মানবীর আনন্দঘন অনুভূতিকে মেলে ধরতে পারি, বাস্তব জীবনে সেটিতে একেবারেই ব্যর্থ। কিন্তু তারপরও কীভাবে যেনো ডুবে গেলাম তার মাঝে।
ভাবলাম, আমার জীবনের এই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়েই লিখি না কেন? ততোদিনে গল্পকে উপন্যাস বানাবার কৌশলটাও আয়ত্ত্ব করে ফেলেছি বলে নিজেরই মনে হলো- কিছু বাহুল্য যোগ করে গল্পকে টেনে নিলেই উপন্যাস হয়ে যায়। এই চিন্তা থেকে মেয়েটির সাথে আমার যেভাবে পরিচয় এবং সম্পর্ক- সেটাকেই কাহিনী বানিয়ে কিছু আশপাশ যোগ করে কয়েকদিনেই উপন্যাসটি নামিয়ে ফেললাম 'আমার বুকের ভেতরে রেখেছো হাত'।
এবারের বিক্রি আরো অভাবনীয়। আমি নিজেই স্তম্ভিত। মানুষের কল্পনার চাইতে তাহলে বাস্তব ঘটনাই পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে? সেটা কীভাবে সম্ভব? তা হলে তো আজকে রূপকথা থাকতো না, সায়েন্স ফিকশন থাকতো না; সবচেয়ে বড় ব্যাপার পাঠক যে জীবনে অভ্যস্ত, যে জীবন তার চারপাশের সাক্ষী, বইয়ের পাতায় সেগুলোকেই পছন্দ করবে কেনো? কোথায় যেনো শুনেছিলাম- আমাদের দেশের সিনেমার নায়িকারা মোটা হন, কারণ মূলত শ্রমজীবি মানুষই এসব সিনেমা দেখে থাকে। ঘরে গিয়ে হাড় জিরজিরে স্ত্রীকে দেখতে দেখতে বিরক্ত এই শ্রমজীবি মানুষরা মোটা বা স্বাস্থ্যবান শরীরের নায়িকা দেখে পুলক আনন্দবোধ করে। স্ত্রীর সাথে সঙ্গমরত অবস্থায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে নায়িকাদের সেসব স্বাস্থ্যবান ছবি। নিজের শুকনো স্ত্রীর মাধ্যমেই স্বাস্থ্যবান নারী সঙ্গসুখ আবেশে হলেও ভোগ করে তারা। তাহলে এক্ষেত্রে মানুষের এই বিপরীত আচরণ কেনো?
যাই হোক, আমার তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। আমার এই ক'দিনের সম্পর্কটাকে ঘিরেই এর মধ্যে বেশ কয়েকটা উপন্যাস নামিয়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যকার খুনসুটি, আনন্দ-বেদনাগুলো আমার কাছে একেকটি ঘটনা হিসেবে ধরা দেয়। আমি সেগুলোকে নামিয়ে দিই বইয়ের পাতায়, একটু বড় করে, একটু গ্ল্যামার মিশিয়ে।
একটু স্বীকারোক্তি দিয়ে রাখি এখানে। আমি যে এসব উপন্যাস লিখি, তা আমার ওই মানুষটি জানে না। আমাদের কাহিনীগুলোই যে একেকটি উপন্যাস হয়ে বেরিয়ে আসে, সেটি জানা তো অবান্তর। আসলে প্রথমদিকে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম না যে, উচ্চ-নিম্নবিত্তগোষ্ঠীর জন্য লেখা আমার এই উপন্যাসগুলোকে মধ্যবিত্ত এই মেয়েটি কীভাবে নেবে? নিশ্চিন্ত হতে পারি নি বলেই সে সময় আর এই পরিচয়টির কথা বলা হয়ে উঠে নি। তারপর যখন নিজেদের কাহিনীগুলো লেখা শুরু করলাম, তখন তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে- এই পরিচয়ের কথা তাকে এখন বলাই যাবে না।
বেশ চলছিলো লেখালেখি, আমার সম্পর্কও। দু'বছরেই সাফল্যের মোটামুটি শীর্ষস্তরে আমি। কিন্তু আমার প্রকাশক একদিন হঠাৎই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন- আমার লেখাগুলো নাকি ইদানিং বিরহের-অভিমানের হয়ে যাচ্ছে। আমি বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। প্রথমদিককার উপন্যাসগুলোতে যে সুখের তীব্রতা বইয়ের প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিলো, যতো দিন যাচ্ছে সেখানে দুঃখ কিংবা রাগ কিংবা অভিমান কিংবা বিচ্ছিন্নতার আবেগিক পরশ তীব্র কামড় বসাচ্ছে। প্রকাশকের অবশ্য অমত নেই এতে। বইয়ের বিক্রি যথারীতি দারুণ। তবে তিনি চিন্তিত- সব এক ধরনের হয়ে গেলে পাঠক না আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়!
প্রকাশকের পর্যবেক্ষণ আমাকে নাড়া দিলো। অনেকদিন পর সেদিন মাঠের কোনায় বড় গাছের নিচে নিজের মুখোমুখি হলাম। হ্যাঁ, ইদানিংকালে সম্পর্কের আলতো আলতো ঘটনাগুলো ক্রমশ জমাট বেধে উঠছে। যে ঘটনাগুলো একসময় দু'জনই উড়িয়ে দিতাম টিনএজারদের বলে, সেগুলোই এখন আমাদের সম্পর্কের বন্ধন হয়ে যাচ্ছে।
দু'জন দুটো বিচ্ছিন্ন জনপদের মানুষ ছিলাম। আমি যে দিকটার মানুষ, সেটি একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছাড়া আর কিছুই নয়! সেই দ্বীপে আমি আসলে একা, যদিও সেখানে সুখের প্রবল তারল্য রয়েছে, রয়েছে চাইলেই পাওয়া যায় এমন রমণীয় উপাদানগুলোও। কিন্তু ওপারের যে কোলাহলময় দ্বীপের বাসিন্দাটি সাথে আমার সেতু গড়ার চুক্তি হয়েছে, সেটিই আমার এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের লক্ষ্য বলে এদিককার জীবন আমাকে টানে নি কখনোই।
ওপারের ওই বাসিন্দার অবস্থা হয়তো আমার মতোই ছিলো। না হলো নিজেদের মাঝখানে বয়ে যাওয়া প্রবল বাধার খালের ওপর পাকা সেতু গড়লাম কেনো আমরা দু'জন? কই, এতো পাকা সেতু তো আর কখনো গড়ি নি আমি? সে তো গড়ে নি কখনো!
সম্পর্কের জোড়াগুলো আসলে একেকটা টেকটোনিক প্লেটের মতোই। কোনো একটি উপাদান সামান্য বাস্তুচ্যুত হলেই নড়ে উঠে পুরো কাঠামো। আমাদের সম্পর্কের কয়েকটি উপাদান একসময় একবার নড়ে উঠেছিলো, তাতে যে ভূমিকম্প হয়েছিলো- সম্পর্কের সেতুটি আসলে ভেঙেই পড়েছিলো তখনই। দু'জন মিলেই আবার নতুন করে সেতুটি তৈরি করেছিলাম; অবশ্য সেটা পাকা সেতু নয়, বেইলি ব্রিজ। সম্পর্কের সক্ষমতার ক্ষমতা দু'জনই হারিয়ে ফেলেছিলাম হয়তো।
এরপর থেকে এরকম অসংখ্যবার আমাদের এই কাঠামো নড়েছে। প্রবল ভূমিকম্প হয়েছে আমাদের মাঝে। প্রতিবারই এই মানসিক যোগাযোগের সেতুটি হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, নয় ভেঙেছে। কোনোবার আমি, কোনোবার সে- কেউ না কেউ এগিয়ে এসে মেরামত করেছি। অবস্থা এমন হয়েছে যে- এখন সেখানে কেবল খুঁটি দিয়ে ঘেরা একটি বাঁশ ছাড়া কিছু নেই। একজনের কাছে আরেকজন যেতে হলে অনভ্যস্ততায় টলমল করে প্রবল কষ্টে যেতে হয়।
গাছের নিচে বসে এগুলো নিয়ে যখন ভাবছি, তখনই আমি পরিষ্কার বুঝলাম- কেনো সর্বশেষ উপন্যাসটি লিখতে আমার এতো কষ্ট হয়েছে, এতো সময় লেগেছে। গত দু'বছরে এই সম্পর্কের সময়টাতে যখনই লিখতে বসেছি, তখনই কোনো না কোনো ঘটনা আমাকে বলে গিয়েছে সেটিকে নিয়ে লিখতে। কিন্তু গত ক'দিনে ঘটার মতো কোনো ঘটনা আমার জীবনে ঘটে নি; এমন কিছু ঘটে নি যা নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখতে পারি। আমি এখানে বসে, সেতুর কাছ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়েও বুঝতে পারছি- আমাদের সেতুটি চোখের সামনে আছে, কিন্তু কেউ একজন চড়তে গেলেই ভেঙে পড়বে সশব্দে। সম্পর্কের ভার বহন করার মতো সেতুটি এখন আর যথেষ্ট শক্ত নয়।
সেতুটির জন্য আমার পৃথিবীর লালিমাময় বিকেলও অস্পষ্ট হয়ে গেলো। সেতুটি ছিলো আমার প্রেরণা, সারাদিনের আশ্রয়, বেঁচে থাকার অবলম্বন। দু'জনই যখন সেতুটি নষ্ট করেছি তখন সেটি থেকে আমি আর কিছু পাওয়ার আশা করি কেনো? আমি বুঝতে পারছি এই সেতুটি ভেঙে গেলো আমি আর লিখতে পারবো না; টিকে থাকার প্রেরণা পাবো না। অন্যের সেতু থেকে একসময় বাঁচার উপাদান সংগ্রহ করলেও নিজের সেতু হওয়ার পর সেই অভ্যাসটি মুছে ফেলেছি চিরতরে। কখনো ভাবি নি এতো শক্ত একটি সেতু ভেঙে যাবে!
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়ালাম, আমি এখন যাবো আবার আমার সেতুটির কাছে। আমি চড়বো তার উপর। আমি জানি, আমি উঠামাত্রই সেটি ভেঙে পড়বে। পড়ুক। সম্পর্কের সেতু ভাঙার দায় আমি খামোকা তার ওপর চাপাবো কেনো? তার চেয়ে আমি নিজেই সেতুতে চড়ে দেখি সেটিকে জোড়া লাগানো ব্যর্থ চেষ্টা চালানো যায় কিনা। ভেঙে পড়ার নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ যেহেতু নেই, এটুকু চেষ্টা করাই যায়! যদিও সেতুতে চড়ামাত্রই সেটি ভেঙে পড়বে, আমি তলিয়ে যাবো মাঝারি স্রোতের এই খালের হিমগভীরে, বিলুপ্তি ঘটবে উচ্চ-নিম্নবিত্তের জন্য লেখা কিছু উপন্যাসের একজন লেখকের। বেদনা এটুকুই- সে জানবে না সেতু গড়তে গিয়ে এক লেখক ভেঙেছে নিজেকে; সে ভাববে আস্তে আস্তে ভাঙতে থাকা সেতু এখন একবারেই ভেঙে পড়লো। সেতুর ভাঙন দেখা যায়, লেখকের মৃত্যু দেখা যায় না।