প্রতিবারই এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে গ্রেডিং পদ্ধতি নিয়ে দুই ধরনের আলোচনা শুরু হয়। এক ধরনের আলোচনায় শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বকে ফোকাস করা হয়; অন্য ধরনের আলোচনায় গ্রেডিং পদ্ধতির সমালোচনার পরিমাণটা বেশি থাকে। স্বভাবতই দ্বিতীয় ধরনের আলোচনায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম থাকে। এখানে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে- যারা বর্তমান গ্রেডিং পদ্ধতির সমালোচনা করছেন, তাদের অনেকেই গ্রেডিং পদ্ধতির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানেন না। কিন্তু তারা তাদের স্বাভাবিক প্রজ্ঞা থেকে বুঝতে পারেন, বর্তমান গ্রেডিং পদ্ধতি মোটেই কার্যকর কিছু নয়। এর দ্বারা শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে গ্রেডিং পদ্ধতি কীরকম এবং কোন গ্রেডে কত পয়েন্ট, সেগুলো সবাই জানে। ফলে সেগুলো আর এখানে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো না। ইদানিংকালের গ্রেডিং নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনাগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়, সবাই মূলত দৃষ্টি নিবন্ধ করছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জিপিএ ৫ বা এ+ পাওয়ার ওপর। খুব কম সংখ্যকই মানুষই আগের মার্কিং সিস্টেমের সাথে বর্তমান গ্রেডিং পদ্ধতির তুলনা করে দুটির পার্থক্য দেখিয়েছেন। নির্মোহভাবে বলতে গেলে বলা যায়, আগের মার্কিং পদ্ধতির সাথে বর্তমান গ্রেডিং পদ্ধতির মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, কেবল ফলাফলের প্রকাশভঙ্গী ছাড়া। ৮০-এর উপরে নম্বর পেলে আগে যেখানে লেটার মার্কস বলা হতো, এখন সেখানে বলা হচ্ছে জিপিএ ৫। অর্থাৎ শুধু মূল্যায়নের স্কেলটি পরিবর্তিত হয়েছে। ৮০-কে এখন পাঁচ বা এ+ বলা হচ্ছে- এর বেশি কিছু নয়। এছাড়া আগের তিনটি বিভাগকে ভেঙ্গে এখন ইংরেজি লেটারে সেটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
এইভাগ আসলে এক ধরনের আইওয়াশ। শিক্ষাক্ষেত্রে মৌলিক কোনো পরিবর্তন না এনে এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির ভিত্তি পরিবর্তন না করে এভাবে গ্রেড পয়েন্ট দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আসলে নেই। শুধু উন্নত বিশ্বের সাথে নিজেদের ফলাফলটাকে মূল্যায়ন করা ছাড়া এর আর কোনো প্রায়োগিকতা নেই।
অথচ গ্রেডিং পদ্ধতির উৎসমূল ভিন্ন এবং চমৎকার। প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতির সাথে এর মিল সামান্যই। আমরা বর্তমানে যেটিকে গ্রেডিং পদ্ধতি বলছি তার পুরো নাম হচ্ছে GPA বা Grade Point Average। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিষয়ের গ্রেড পয়েন্টকে একত্র করে সেটির গড় বের করা হয় এবং তা দিয়েই শিক্ষার্থীর দক্ষতা চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু গ্রেডিং পদ্ধতির যে লক্ষ্য অর্থাৎ শিক্ষার্থীর যথাযথ মূল্যায়ন, সেটির আসল নাম হচ্ছে CGPA বা Cumulative Grade Point Average। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত দক্ষতা নির্ভর করে প্রশ্নপত্রের কাঠিন্যের ওপর এবং অন্য শিক্ষার্থীদের দক্ষতার ওপর। একটি উদাহরণ দিয়েই বিষয়টি খোলাসা করা যাক।
মনে করুন, একটি শ্রেণীতে ১০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে এবং তারা গণিত পরীক্ষায় গড়ে ৮০ পেয়েছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে সবাই এ+ পেয়েছে। কিন্তু CGPA পদ্ধতিতে এই গড় মানটিকেই ধরা হবে বি+। এটি নির্ণয়ের জন্য কিছু গাণিতিক সূত্র রয়েছে, যা এখানে দেওয়া জটিল। এই সূত্রানুসারে, মোট পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত গড় মান, শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ মান এবং শিক্ষার্থীদের নম্বরপ্রবণতা ইত্যাদি কিছু বিষয়কে হিসেবের আওতায় আনা হয়। এই উদাহরণে মোট শিক্ষার্থী ১০০, গড় নম্বর ৮০, সর্বনিম্ন নম্বর ৩০ এবং সর্বোচ্চ নম্বর ১০০, নম্বরপ্রবণতা ৭৫ থেকে ৮৬-কে ভিত্তি ধরে হিসেব করলে ৮০ নম্বর হবে বি+-এর সমতুল্য। এর চেয়ে ৩ নম্বর যে বেশি পাবে, তার গ্রেড হবে এ-/এ (যে যেভাবে ধরতে চান)। ৩ নম্বর কম হলে পাবে বি। উল্লেখ্য, একটি গ্রেডের সাথে আরেকটি গ্রেডের মধ্যকার নম্বরের পার্থক্য কতো হবে, হিসাবনিকাশের ভিত্তিতে তাও এই সূত্রই বলে দেবে।
এই পদ্ধতিতে হিসাব করলে শিক্ষার্থীর একক কৃতিত্বও যেমন মূল্যায়ন করা সম্ভব; তেমনি সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমেও শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা সম্ভব। কোনো শিক্ষার্থী যদি ১০০ পায়, তাহলে অবশ্যই সে এ+ পাবে, কারণ সে সবচাইতে ভালো ফলাফল করেছে; কিন্তু আমাদের আলোচ্য উদাহরণে কোনো শিক্ষার্থী ৮০ পেলেও ভালো রেজাল্ট করেছে কিন্তু অন্যদের তুলনায় তার অবস্থানের কারণে তাকে মাঝামাঝি স্থানে থাকতে হচ্ছে । অর্থাৎ এই হিসাব আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে, ৮০ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর মেধা আসলে গড় মানের; যদিও প্রচলিত পদ্ধতিতে আমরা তাকে মেধাবী বানিয়ে দিচ্ছি।
সুতরাং, গ্রেডিং পদ্ধতি আসলে শিক্ষার্থীর যথাযথ মূল্যায়ন করতে সক্ষম নয়। দ্বিতীয় যে পদ্ধতিটির কথা এখানে বলা হলো, সেটি দিয়েই সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীর মেধা ও অবস্থা মূল্যায়ন করা সম্ভব। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া অন্যরা এটি বুঝতে সক্ষম নন; কিংবা তারা ওয়াকিফহাল নন। যারা বুঝতে সক্ষম, তারা আবার নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে নেই। ফলে সত্যিকার গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা যাচ্ছে না।
আরেকটি অসুবিধা আছে এখানে। যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি বা ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও আমরা সবাই সবকিছু বুঝতে চাই। যে কারণে আইনস্টাইনের নাম শুনেই আমরা মনে মনে প্রস্তুতি নেই থিওরি অব রিলেটিভিটি বুঝার। কিন্তু বুঝতে না পারলে নিজেদের অদক্ষতাকে সামনে না এনে হইচই বাধিয়ে দিই। সম্প্রতি কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্র নিয়েও এমন হইচই হয়েছে। এখন যদি CGPA পদ্ধতি দেশে চালু করা হয়, তাহলে এ সম্পর্কিত জ্ঞান না থাকার কারণে অধিকাংশ অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অন্যরা এ নিয়ে হইচই শুরু করে দিবে। বক্তৃতা-বিবৃতি আসবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে বলে। অথচ আমাদের দেশে যখন গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয় তখন এই CGPA-ই চালু ছিলো, GPA-নয়। বুয়েটের বেশ কিছু ডিপার্টমেন্টে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ কিংবা শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রথমে CGPA চালু থাকলেও অর্বাচীনদের প্রতিবাদের মুখে সেগুলো বন্ধ করে GPA পদ্ধতিতে ফেরত যেতে হয়।
শিক্ষিত মানুষ যেখানে মুর্খতার মাপকাঠি সেখানে জনসাধারণকে গালি দিয়ে কী হবে!